“যা দেবী সর্বভূতেষু জাতিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।” [শ্রী শ্রী চণ্ডী, দেবীদূতসংবাদ।। ৫ অধ্যায় ৪৩ শ্লোক।] সারা বৎসর বঙ্গবাসী মাত্রই প্রতীক্ষা করে থাকেন আশ্বিনের দুর্গোৎসবের জন্য। হয়তো কোনো ভক্ত পাঠক বলতে পারেন যে আমি দুর্গাপূজা না বলে দুর্গোৎসব বললাম কেন?

তাদের জন্য জানাই যে আজ পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল, প্রতিমা, আলোর রোশনাই-এর ঐশ্বর্য, বৈভব প্রদর্শনের ইঁদুর দৌড়ে সনাতনী দুর্গাপূজার ওষ্ঠাগত প্রাণ! যেন গেঁয়োর পাঁচতারা হোটেল দর্শন। পূজার সরঞ্জামাভাব হলে পাড়ার দাদারা পূজারিকে বলেন “যা আছে ঐ দিয়ে চালিয়ে দিন কোনো ভাবে।” এদিকে মাইকের সামান্য টিউন বেস সাউন্ড নিয়ে তারা উন্মত্ত প্রায়। আজও কিন্তু মনের গভীরে ধ্বনিত হয় “আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে।” সঙ্গে সঙ্গে জাত পাত ধনী দরিদ্র সবাই যাই মিশে।

পুনরায় প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। এবার আমরা জাতি বিন্যাসের উপর আলোকপাত করব। প্রশ্ন উঠতে পারে যে মায়ের আবার জাতি কি? এর উত্তর দিতে হলে মায়ের সঙ্গে আসা তাঁর সন্তানদের এবং তাঁর আংশিক রূপের বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। যাঁরা পূজার্চনাদির সঙ্গে অল্প বিস্তর জড়িত তাঁরা জানেন যে গণেশের পূজা না করে কোনো দেবদেবীর পূজা হয় না। প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন? পুরাণ মতে গণেশ এবং কার্তিকেয়র মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হলে নারদের পরামর্শ মতো তাঁরা আপোষের মাধ্যমে এক সমাধানে আসেন যে, যিনি বিশ্বকে একবার আবর্তন করে আগে ফিরে আসবেন তিনিই প্রকৃত শক্তিমান। তৎক্ষণাৎ কার্তিকেয় বেড়িয়ে পড়লেন ময়ূরে চড়ে। কিন্তু গণেশ? তিনি কি করবেন? ইঁদুর বাহন সম্বল যাঁর! তিনি করলেন কি বুদ্ধি করে সোজা চলে এলেন কৈলাশে। সেখানে তাঁর পিতা-মাতা অর্থাৎ হর-পার্বতী বার্তালাপে রত। সেখানে গিয়ে তিনি তাঁদেরকেই তিন বার প্রদক্ষিণ করে ধপ করে মায়ের কোলে বসে পড়লেন। এদিকে তিনদিন পর কার্তিকেয় গলদঘর্ম হয়ে ফিরে এসে বললেন “আমিই জিতেছি।” কিন্তু রায় গেল বিপক্ষে। পিতা মহাদেব পুত্র গণেশকে তাঁর বুদ্ধির জন্য দিলেন বিঘ্ননাশের বর; সঙ্গে গণেশের পূজা না করে কেউ অপর কোনো পূজা করলে তার পূজা সিদ্ধ হবে না — এই বরও। তাই কোনো বিঘ্ন যাতে পূজার সময় না ঘটে সেজন্য গণেশের পূজা আগেই করতে হয়। এবং সহজে সিদ্ধিলাভও এর উদ্দেশ্য। তাই তিনি একাধারে বিঘ্নেশ্বর আবার অপরাধারে তিনি সিদ্ধেশ্বরও।

এত গেল পুরাণের কথা। বাস্তব সত্য হল আমাদের খাদ্য ও উৎপাদনের দেবতা হলেন গণেশ। তাই সকল শক্তির উৎস খাদ্য ও উৎপাদনের যোগানদার এই দেবতার পূজাই সর্বাগ্রে হয়। উল্লেখ্য যে মনুসংহিতাতে বলা হয়েছে, গৃহস্বামী সর্বাগ্রে গৃহে কর্মরত ভৃত্যদের, বাড়ির শিশু, বৃদ্ধদের পূর্ণ তুষ্টি করে তবে গৃহস্বামী ও গৃহস্বামিনী ভোজন করবেন। পেটে খেলে তবেই না পীঠে (মাথায়) সয়ার প্রশ্ন! যদি তাঁকে আমরা বিশ্লেষণ করি তবে দেখবো গণপতি অর্থাৎ জনগণের যিনি ইষ্ট বা ঈশ সেই খাদ্য বা প্রথম চাহিদার যোগানদায়ী দেবতা গণেশ আমাদের শূদ্রজাতির প্রতিভূ। উৎপাদন কার্য তা কৃষি কার্য বা শিল্পকর্ম যাই হোক না কেন আমাদের সমাজকে শূদ্ররাই দান করেন। তাই সেই শূদ্র জাতি সর্বজাতির প্রথমপূজ্য

কায়িক শ্রমিকদের কথা গেল, এবার আসি উদ্বৃত্ত উৎপাদনের বণ্টনের অর্থাৎ ট্রেড অ্যাণ্ড কমার্সের কথায়। যা আয়ের উৎস, যা বস্ত্র, বাসস্থান, বিদ্যা, স্বাস্থ্য, বিনোদন প্রভৃতির সহায়ক; যার প্রতিভূ হলেন মা লক্ষ্মী, তিনি বৈশ্যা।

সুধী পাঠকবৃন্দের কাছে অনুরোধ ইঁদুর পেঁচাকে কটাক্ষ করে তাঁরা যেন ময়ূরের রূপে মোহিত হয়ে না যান। তাঁর স্বভাবে সে যুদ্ধপ্রিয় , কণ্ঠস্বরে তার যুদ্ধের রণশিঙা; অর্থাৎ রক্ষণাবেক্ষণের ইঙ্গিত। পুরাণের পুর্বোক্ত গল্প অনুযায়ী পিতা মহাদেব গণেশের মাতৃপিতৃ ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে দু’দুটি মোক্ষম বর গণেশকে দিলেন ঠিকই, কিন্তু ক্ষাত্রতেজী উদ্যমী কার্তিকেয়কে দিলেন দেব সেনাপতিত্বের বর। তাই ডিফেন্সের দায়িত্বে রইলেন কার্তিকেয়

উৎপাদন, আয়, ব্যয় তথা সঞ্চয় সবই তো হল; কিন্তু সামলে চালাবেন কে? যিনি বাক্, বুদ্ধি, মেধা, স্মৃতিদাত্রী সেই দেবী সরস্বতী। এখানে তিনি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা পরিচালিকা। তিনি পৌরোহিত্য করেন বলেই তিনি ব্রহ্মাণী বা ব্রাহ্মণজাতির প্রতিভূ

এইবার আসি দেবী দুর্গার আলোকদর্শনে। মা দুর্গার পা সমস্ত দেহের ভারবহণকারী, উৎপাদন শক্তির সহায়ক, তাই নিম্নতঃ তিনি গণেশ। যেখানে পাদ্য, অর্ঘ্য, পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আমরা দেশের প্রধান শক্তিকে সম্মানিত করি। মায়ের উদর হলেন লক্ষ্মী; যিনি সর্বাঙ্গে পুষ্টি বণ্টন করেন এবং ভবিষ্যতের জন্য স্নেহ পদার্থ সঞ্চয় করেন । বর্ম্ম পরিহিত অস্ত্র সজ্জিত বক্ষস্থল ও হাতগুলো কার্তিকেয়; যিনি শত্রুর হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করে চলেছেন। এভাবেই সর্বোচ্চ উর্দ্ধাংশ তথা দেবীর মস্তক হলেন দেবী সরস্বতী; যিনি পরিচালনা করে চলেছেন। এই সমস্ত দেহাংশ ও দেবাংশ নিয়ে গঠিতা মা দুর্গা দেশমাতৃকা। “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়য়সী” তাই এই দুর্গা বা দেশমাতৃকার পূজা আমাদের পরম প্রাপ্তি এবং একান্ত কাম্য।আর মাথা-হাত-পা প্রভৃতির অর্থাৎ সর্বজাতির চিন্তা করার জন্য তো রইলেন হৃদয় রূপী বিষ্ণু বা কৃষ্ণ। তাই আমরা ভাবার কে? সেজন্যই তো তিনি গীতায় জ্ঞান যোগে বললেন, “চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।/তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।।” প্রকৃতির ত্রিগুণ ও কর্মানুসারে আমি মানুষ্য-সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ করেছি। প্রস্তুত প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অর্কতা ও অব্যয় বলে জানবে।

এযুগের শ্রীকৃষ্ণ তথা শ্রীরামকৃষ্ণ এবং তাঁর পরম প্রিয় শিষ্য স্বামীজির মুখে শুনি ধনী-দরিদ্র-মুচি-মেথর-চাষী-তাঁতি-ব্রাহ্মণ সবাই আমার ভাই, সবাই আমারই রক্ত। “বহুরূপে সম্মুখে তোমার,/ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?/জীবে প্রেম করে যেই জন,/সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”

(শ্রী কুমারকান্ত ভট্টাচার্য, অধ্যাপক)

শ্রী কুমার কান্ত ভট্টাচার্য্য (Shri Kumar Kant Bhattacharya)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.