“বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল;পূণ্য হউক, পূণ্য হউক, হে ভগবান।”
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক দিন। সুপ্রাচীন বঙ্গভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করার ব্রিটিশ সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার জন্য বিল পাস করা হয়। সেই সময় ভাইসরয় ছিলেন লর্ড কার্জন (১৮৯৮ – ১৯০৫)। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রথম বিবেচিত হয় ১৯০৩ সালে। কার্জনের প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা প্রশাসনিক কার্যকারিতা কে সামনে রেখে হলেও পরবর্তীতে দেখা যায় এটিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতিকে ভৌগোলিক ও সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভক্ত করে তাদের উপর ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে ব্রিটিশ সরকার।
১৯০৩ সালের শেষের দিকে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের মূল প্রস্তাব গুলি প্রকাশিত করে। এই সময় থেকেই বাঙালিদের মনে এর তীব্র বিরোধিতার প্রকাশ দেখা যায়। কার্জনের এই সিদ্ধান্তকে বাঙালি সংস্কৃতির ও জাতীয়তা বোধের বিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার পূর্ববাংলায় মুসলিমদের প্রভাব বৃদ্ধি করে শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান শক্তিমত্তাকে হ্রাস করতে চেয়েছিল। তৎকালীন বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের যে তীব্র উচ্ছ্বাস তার শ্বাসরোধ করতে চেয়েছিল এই পরিকল্পনার মাধ্যমে। লর্ড কার্জন চেয়েছিল বঙ্গভাষী সমগ্র জনগণের ক্রমবর্ধমান একতা, সংহতি ও জাতীয় চেতনার ওপর সুচিন্তিত আঘাত হানতে। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। কলকাতা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের বৈপ্লবিক আন্দোলন এর ধারাকে ছত্রভঙ্গ করে তার কার্যকারিতা হ্রাস করতে চেয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
বিট্রিশ সরকারের এই পরিকল্পনার প্রথম থেকেই তীব্র প্রতিবাদ করে আসছিল বঙ্গসমাজ। তবুও ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই ব্রিটিশ সরকার এক চূড়ান্ত সংকল্প পত্র ঘোষণা করে যাতে বলা হয় ১৯০৫ -এর ১৬ অক্টোবর তারিখে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হবে। জাতি মাত্রই ঐক্য হলো আত্মোন্নতি ও আত্মরক্ষার প্রধান সম্বল। তাই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থসমূহকে একত্রিত করে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ানো হয়েছিল। আমাদের জন্মস্থান আমাদের কাছে মাতৃভূমি। তাই বঙ্গ বিভেদের এই সিদ্ধান্ত বঙ্গবাসীর কাছে মাতৃদেবীর অঙ্গচ্ছেদের সমান। জাতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গকে ‘বিভক্তিকরণের মাধ্যমে শাসন’ -এর প্রচেষ্টা আখ্যা দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ন মনোভাবকে তুলে ধরে। ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনির মাধ্যমে জাতীয়তাবোধকে জাগরিত করে বঙ্গ বিভেদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করার লক্ষ্যে জাতীয় কংগ্রেসের জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠে ‘বন্দেমাতরম’ গানটি।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, কৃষ্ণ কুমার মিত্র এর মত নেতৃবৃন্দ বিলাতি দ্রব্য ও বিলাতি প্রতিষ্ঠান বর্জনের ডাক দেন (জুলাই ১৯০৫)। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ৭ আগষ্ট, ১৯০৫ কলকাতার টাউন হলে একটি জনসভায় বাংলার নেতৃবর্গ ঘোষণা করেন – যতদিন না বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রত্যাহার করা হচ্ছে ততদিন বিলাতি পণ্য বর্জন করা হবে ও স্বদেশী পণ্য গ্রহণ করা হবে। এইসময় রজনীকান্ত সেনের সৃষ্টি বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান -“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই;দীন দুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।”স্বদেশী আন্দোলনকারীদের কন্ঠে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন সারা বাংলায় তথা দেশে তুমুল সাড়া ফেলে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশগ্রহণ করেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের মধ্যে চরমপন্থী ভাবধারার উত্থান ঘটে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দি বেঙ্গলি’ পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গকে ‘একটি জাতীয় দুর্যোগ’ বলে উল্লেখ করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমূখ সাহিত্যিকেরা দেশাত্মবোধক গান রচনার মাধ্যমে জাতীয় সংহতির প্রচার করেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গভঙ্গের আইন কার্যকর হওয়ার কথা, তাই ওই দিন কলকাতায় অরন্ধন পালিত হয়। সমগ্র বাঙালি জাতির ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে কবিগুরুর আহ্বানে ওই দিন অর্থাৎ ১৬ অক্টোবর ‘রাখী বন্ধন’ উৎসব পালিত হয়। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেন, যেটি পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়।
১৯৯৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রক্রিয়া ভারতের রাজনীতিতে সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে গঠন মূলক কার্যকলাপ গৃহীত হয় – যা ছিল আত্মশক্তির প্রতিরূপ। স্বরাজ অর্জনের লক্ষ্যে চরমপন্থী নেতৃবৃন্দের আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় মেলে। বিভিন্ন জেলায় ব্রিটিশবিরোধী সভা ও সমিতি গড়ে ওঠে – ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘যুগান্তর’ প্রভৃতির এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় – বোমার ব্যবহার শুরু হয়।
তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। ভারতের জাতীয় ইতিহাসে বাংলার পরিশ্রমী প্রচেষ্টার সাফল্য জাতীয়তাবোধের বিকাশ কে উদ্বুদ্ধ করে।
সুচরিতা চৌধুরী