ঝগড়ভঞ্জনী চণ্ডী – দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব 

পূর্বেই বলেছি দেবী ঝগড়াইচন্ডী বড়ই জাগ্রত এবং জনপ্রিয়। আজও রাঢ় অঞ্চলের নানান প্রান্ত থেকে বহু মানুষ পূজা দিতে আসেন মায়ের থানে। মানত করেন তাঁরা। এখানে দেবীর নিত্যাসেবা পূজা হয়। তবে , শনি ও মঙ্গলবার দেবীর বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। এই দুইদিন দূরদূরান্ত হতে ভক্তরা এসে পূজা দেন , মানত করেন। রাঢ় অঞ্চলের এক সুদীর্ঘ এলাকার মানুষ বিশ্বাস করেন যে মা ঝগড়াইচন্ডী বা ঝগড়ভঞ্জনীকে সংসারের কলহ থেকে দূর করে থাকেন। জনশ্রুতি আছে দেবীর নিকট প্রার্থনা করলে অতিবড় ও জটিল মামলা মকোদ্দ্মাতেও জয়লাভ হয়। এই কারণেও বহু দূর দূরান্ত থেকে পুণ্যার্থীগণ আসেন দেবীর থানে পূজা দিতে। 


তাছাড়াও, লৌকিক বিশ্বাস আছে যে দেবী বহু রোগ জ্বালা নিরাময় করেন।  দেবীর স্নানজল, ফল , বেলপাতা ইত্যাদি নিয়ে অনেকেই আপন গৃহে রেখে দেন রোগ , শোক , তাপ থেকে তারণ পাওয়ার জন্য।  এসব দীর্ঘকালের বিশ্বাস। রাঢ় অঞ্চলের কুলদেবতা ধর্মঠাকুর হলেও  মহামায়া আদ্যাশক্তি এখানে নানাভাবে , নানা রূপে বিরাজ করেন । 


ঝগড়াইচন্ডী আচন্ডালের দেবী। তিনি বৃক্ষতল বাসিনী এক সুপ্রাচীন কাল থেকে। স্থানীয় সন্তকী পরিবার বর্তমানে দেবীর সেবা পূজা করেন।  তবে, সন্তকী পরিবার বৈতলের আদি বাসিন্দা নয় বলেই অনেকে মনে করেন। তবুও, একটি দীর্ঘ সময় উক্ত পরিবার নিস্থাসহকারে দেবীর উপাসনা করে আসছেন। পরিবারের নবীন প্রজন্মের সদস্য এবং ঝগড়ভঞ্জনীর নবীন পূজারী হলেন সঞ্জয় সন্তকী। পূর্বে তাঁদের পদবী ছিল চট্টোপাধ্যায় বা চ্যাটার্জি। মল্লরাজারা তাঁদের উপাধি দেন #সন্তকী। পরিবারের অনেকগুলি শরিক পালা করে পূজা সেবা করে থাকেন।  পূজার দায়িত্বে যিনি থাকেন তিনি সেদিনের অন্নভোগ রান্না করেন।  ভাত, তরকারী ও মাছ এই রান্না হয় ভোগের জন্য প্রতিদিন। ভক্তজনের ভোগ খান। মন্দিরে পাশেই পৃথক পাকশালা আছে। 


বর্তমানে যে পুরোহিতগণ দেবীর পূজায় রত , তাঁরা হলেন –

ক) গোপাল সন্তকী 

খ ) সুনীল সন্তকী

 গ ) অসীম সন্তকী

 ঘ) বিকাশ সন্তকী 

ঙ ) বিবেকানন্দ সন্তকী

 চ) শ্যামাপদ সন্তকী 

ছ) কাজলকান্তি রায় ( দৌহিত্র )

 জ) সঞ্জয় সন্তকী ( পূজারী অসীম সন্তকীর পুত্র ) ।
চন্ডী মন্ত্র উচ্চারণ সহ দেবী দুর্গার পূজার সকল বিধি মেনে মা ঝগড়াইচন্ডীর পূজা হয়। তবে, বহু লৌকিক আচারও দেবীর থানে অনুষ্ঠিত হয়। যেমন -কাদাখেলা।

প্রতি শারদীয়া বিজয়ায় কেন এখানে কাদাখেলা অনুষ্ঠিত হয় তা আমি পূর্বেই বলেছি। বর্তমানে এই অনুষ্ঠান একটি পরম্পরাগত অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিজয়ার প্রভাতে ঘটা করে দেবীর পূজার পর , দ্বিতীয় প্রহরে মানত উৎসর্গ করা হয়। তারপর মন্দির প্রাঙ্গনের পূর্বদিকে বড় মাটির বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এরপর, সাতটি পুষ্করিণীর জল এনে সেই বাঁধ নির্মিত প্রাঙ্গনে ভরে দেওয়া হয়। মন্দিরের পূজার জল, ফুল পাতা, বাঁকুড়ার রাঙা মাটি, রাঙা ধূলা সব সেই সাতপুকুরের জলে মিলে মিশে এক হয়ে যায়। শুরু হয় কাদাখেলা। আবালবৃদ্ধবণিতা , সকল বর্ণ নির্বিশেষে এই খেলায় মাতেন। যাঁরা এই খেলায় মাতেন তাঁরা নিজেদের পুণ্যার্থী মনে করেন। পরষ্পর পরষ্পরকে জল কাদা ছিটিয়ে কাদাখেলার আনন্দ উপভোগ করেন। বৈতল সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি থেকেও লোকজনের সমাগম ঘটে বিজয়া পূজা এবং খেলায় অংশ গ্রহণের জন্য। সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে খেলা।  শেষ হয় যখন জলের সঙ্গে বাঁকুড়ার মাটি মিশে একে বারে কাদা হয়ে যায়। 

বিজয়ার দিন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পার্শ্ববর্তী হিজলডিহা গ্রামের জমিদার বংশের উত্তরপুরুষ আসেন।  বক্সী পরিবারের প্রতিভূ নিজে বাঁধের জল কেটে দেন এবং শেষ হয় কাদাখেলার অনুষ্ঠান।  শোনা যায় বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা হাতির পিঠে চড়ে এসে এই বাঁধ কাটতেন। 

ময়নাপুর , কুচিয়াকোল, মাগুরা, জরকা ইত্যাদি গ্রামের থেকে বহু জনসমাগমে বিজয়ার দিন দেবীর থান গমগম করে। মল্লরাজার দ্বারা সূচিত এই জয়ের উৎসব জয়, আনন্দ অশ্রু, বীরত্ব , রক্ত ইত্যাদি সবকিছুর প্রতীক। 

জয়, বিজয় ও বিজয়া দশমীর মিলনে অপরাজিতা পূজা বা এমন উৎসব বঙ্গে খুব কমই দেখা যায়। এটা কেবলমাত্র বিশ্বাস নয় , এটা সুপ্রাচীনকাল হতেই জয়ের উৎসব। দেবী বিজয়ার দিনই মহিষাসুর নামক অশুভশক্তিকে পরাজিত করেছিলেন। রাম হারিয়েছিলেন রাবণকে। তাই ,সুপ্রাচীন রাজা মহারাজা এবং সাধারণ নানা প্রাচীন জাতিগুলির মধ্যে বিজয়ার দিন জয়ের উৎসব পালন করা হতো। শবর , বাগদি, লোধা প্রমুখরা বিজয়ার দিন দেবীকে স্মরণ করে গায়ে লতাপাতা ,কাদা মেখে আনন্দ করতেন। তাই বিজয়ার দিন যে রামলীলা পালন করা হয় দেশের নানা স্থানে , তা কেবলমাত্র রামের জয় নয়। তা দেবী আদ্যাশক্তির জয়ের উৎসব। অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয় উল্লাস। 

থানে কাদাখেলার উৎসব স্বতন্ত্র পরম্পরা এবং বিশ্বাসের মহিমা। রাঢ় অঞ্চলে কিংবদন্তি আছে যে , মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ বিজয়ার দিন চেতুয়া বরদার অভিযান করে যখন দেবীর থানে ফিরে আসেন তখন প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির জলে থানের মাটি, ধূলা কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে। তারমধ্যে রাজা ও তাঁর সুবিশাল বাগদী, ডোম ,বর্গক্ষত্রিয় প্রমুখ দ্বারা নির্মিত সেনাবাহিনী মেতে ওঠেন আনন্দোৎসবে। সেই পরম্পরা আজও চলে আসছে। ঢাক ঢোল বাদ্যযোগে উৎসব হয়। 

এছাড়াও পৌষ সংক্রান্তিরদিন নবান্নে খিঁচুড়ি ভোগ, আষাঢ় মাসে বিপত্তারিণী , শ্রাবণ মাসে অরন্ধন উৎসব পালিত হয়। দুর্গাপূজায় পৃথকভাবে বোধন হয় না। কারণ ঘট প্রতিষ্ঠিত। সন্ধি পূজার বদলে বিজয়ার দিন বলি হয়। এখানে  বলি প্রথার বিশেষত্ব হল , #চ্যাং_মাছ_বলি। চ্যাং মাছ বলি দিয়ে কাদাখেলার সূচনা হয়। 

সেই কোন এক প্রাচীন কাল থেকে বটবৃক্ষের তলায় বিরাজিতা দেবীর জাগ্রত মহিমা ও মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবীর জনপ্রিয়তা আজও স্বতন্ত্র গাম্ভীর্যে অবস্থান করছে। প্রাচীন ঋষি মুনি এবং ধর্মঠাকুরের বিস্তৃত ভূখণ্ডে অগণিত মানুষের হৃদয়ে , বিশ্বাসে মা ঝগড়াইচন্ডী মহামায়া হতে লৌকিক মায়ে পরিণত হয়ে নানা কিংবদন্তি নিয়ে আজও রহস্যময়ী হয়ে অবস্থান করছেন। 
#সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী

(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত)
তথ্যঃ ১ ) পথে প্রান্তরে বাঁকুড়া টেরাকোটা

২) বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি

৩) বৈতলের ঝগড়াই চণ্ডী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.