সুদূর আয়ারল্যান্ডে ১৮৬৭ সালে ২৮শে অক্টোবর জন্ম , বাবা স্যামুয়েল রিচার্ডস্ নোবেল ছিলেন একজন মানবতাবাদী এবং সমাজকর্মী গির্জার কাজে যুক্ত একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ । মা মেরি ইজাবেল নোবল্ । মাত্র ১০ বছর বয়সেই পিতৃহারা হলেও বাবার ঈশ্বরমুখি সৎ চরিত্রের ছায়া পড়েছিল এলিজাবেথ মার্গারেট নোবলের মনের গভীরে । পিতৃহীন হবার পর দারিদ্রতার জন্য ইল্যান্ডের এক চ্যারিটেবল বোর্ডিং স্কুলে মানুষ । মাত্র ১৭ বছর বয়সে সংসারের হাল ধরার জন্য শিক্ষকতার শুরু । ১৩ বছরে প্রায় ৫ টি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন ।১৮৯২ এ উইমবলডনে নিজস্ব একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করে নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষা ব্যাবস্হা শুরু করেন ।
মার্গারেটের আধ্যাত্মিক ধর্ম পিপাসু মন খ্রীষ্ট ধর্মে সব উত্তর খুঁজে পেলেন না । বৌদ্ধধর্ম নিয়েও তিনি পড়াশুনা করলেন । কিন্তু তাঁর ধর্ম সংসয় নিরসন হলনা তাতে । এমন সময় লন্ডনে এক বান্ধবীর দ্বারা নিমন্ত্রিত হয়ে এক ধর্ম আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে দর্শন পেলেন স্বামী বিবেকানন্দের । (১৮৯৫) স্বামীজির ধ্যানমগ্ন মূর্তী দর্শন মাত্রই যেন সব প্রশ্নের উত্তর পেলেন তিনি । তাঁর বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যা তাঁর ধর্ম পিপাসু মনকে আকর্ষিত করল ।স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও আধ্যাত্মিকতা প্রবলভাবে প্রভাবিত করল তাঁকে ।ভারতের সনাতন ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষিত হয়ে বিবেকানন্দের ডাকে ১৮৯৮ এর ২৫শে জানুয়ারী কলকাতা বন্দরে এসে স্বয়ং বিবেকানন্দ তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন ।
স্বামীজি বিশ্বাস করতেন ভারতের মুক্তি মায়েদের দ্বারাই সম্ভব তাই নারী জাতিকে শিক্ষিত করার জন্য তিনি এমনই একজনের খোঁজে ছিলেন যাঁর দ্বারা ভারতীয় নারীদের শিক্ষার দ্বারোদ্ঘাটন হবে এবং তাদের সামূহিক চেতনা ও ভাবনার বিকাশ ঘটবে ।১৮৯৮ এর ২৫ শে মার্চ তিনি তাঁকে শিষ্যত্ব দান করে নিজের মানসপুত্রি রূপে স্বীকার করলেন । দীক্ষাদানের সময় তিনি বললেন যাও, সেই মহান ব্যাক্তিকে অনুসরণ করো যিনি লোককল্যানের জন্য ৫০০ বার জন্মেছেন এবং লোককল্যানে নিজের জীবন সমর্পিত করে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি করেছেন । স্বামীজির মানসকুসুমে প্রস্ফুটিতা ভারতের জন্য শ্রেষ্ঠ অর্ঘ হিসাবে তিনি তাঁর নাম রাখলেন নিবেদিতা । অর্থাৎ ঈশ্বরের জন্য সমর্পিতা ।
নিবেদিতা গুরুর সেই বিশ্বাসের পূর্ণ মর্যাদা রেখেছিলেন । তিনি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন ।শিক্ষাব্রতী ছিলেন । শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞা ছিলেন । কুসংস্কারমুক্ত ভারত গড়ার কাজে ব্রতী হলেন তিনি । আর্তের সেবায় , ১৮৯৯ এর ভীষণ প্লেগের প্রাদুর্ভাবে প্লেগ রোগীদের সেবায় , নারী শিক্ষায় বিলিয়ে দিলেন নিজের জীবন ।
বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর তিনি গুরুর অপূর্ণ কার্য সম্পূর্ণ করায় ব্রতী হলেন । বাগবাজার অঞ্চলের ১৬ নম্বর লেন নিজের বাসভবন নারীশিক্ষার জন্য দান করে প্রতিষ্ঠা করলেন “”নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়। “” মা সারদাকে দিয়ে উদ্বোধন করালেন এই স্কুলের।সারদা মা কে তিনি ডাকতেন “ছোটমা” বলে । আর তিনি ছিলেন ছোটমার আদরের “খুকি ।” পায়ের ব্যাথায় কষ্ট পেলে তিনি মাকে কোলে করে দোতালায় পৌঁছে দিতেন । বড় সন্তুষ্ট ছিলেন মা তাঁর এই বিদেশিনি খুকির উপর।
ইংরেজদের প্রথমে সমর্থন করলেও তাদের সর্বগ্রাসীনীতির প্রতি ক্রমশঃ বিরক্তি জন্মায় তাঁর। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দলনে ভারতের শোষণ নীতির বিপক্ষে গিয়ে তিনি অনেকাংশেই জড়িয়ে পড়লেন স্বদেশিদের সাথে । অনুশীলন সমিতির সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল তার ।শ্রী অরবিন্দর সাথে ছিল সখ্যতা। তাঁর ব্যক্তিত্বে আগুনের ফুলকি দেখে তিনি নাম দিলেন শিখাময়ী। সেই অগ্নিশিখার ছোঁয়ায় শিক্ষায় ও নির্ভিকতায় মেরুদন্ডহীন জাতিয়তাবোধ ও জ্ঞানের আলো জ্বলে উঠেছিল যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে । যেন এক পরশমনি বা যাদুকাঠি ছিল নিবেদিতা । বহু স্বদেশীভাইকে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করতেন ।
এক জাতি এক প্রাণ ও একতাই ছিল তাঁর ধর্ম। তিনি নিজেকে মনে প্রাণে ভারতীয় মনে করে গর্ব বোধ করতেন। কিন্তু তাঁর রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বেলুর মঠের নিয়মের অন্তরায় হওয়ায় বুদ্ধিমতি তিনি বেলুরমঠের থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় মুক্ত করে নিলেন ।তখন তিনি বাস করতেন ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেন এর বাড়িতে এবং ঐ বাড়ি তিনি সারদা মঠ কে উৎসর্গ করে যান । যদিও মৃত্যুদিন অবধি তাঁর সংস্রব ছিল গুরুভাইদের সাথে ও বেলুড় মঠের সাথে ছিল নিরন্তর যোগাযোগ ।
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী লেডি অবলা বসুর বিশেষ প্রিয় পাত্র ছিলেন তিনি।বিজ্ঞানের ছাত্রী হবার সুবাদে তাঁর অনেক কাজে সাহায্য করতেন তিনি । তাঁর বহু জার্নাল তিনি ইংরাজীতে অনুবাদ করেছিলেন । ।শিক্ষা এবং শিল্প তে বিশেষ প্রীতি ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট । অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিবেদিতার অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি করলেন বিখ্যাত “ভারত মাতা”চিত্রটি । রামানন্দ চট্যোপাধ্যায় ও নন্দলাল বসু তাঁর কাজে আগ্রহী ছিলেন ।নন্দলাল বসুকে নিজের খরচায় তিনি পাঠান অজন্তা য় । বিদেশী চিত্রকর ওকাকুর কাকুজার লিখিত বই এ তার অবদানের স্বীকৃতি আছে ।।রবীন্রনাথ তাঁকে উপাধি দিলেন “লোকমাতা”, স্বয়ং বিবেকানন্দ তাঁর মধ্যে দেখেছিলেন “সিংহিনী”। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত ও যদুনাথ সরকার তাঁর কর্মের ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন।
তিনি সুবক্তা , সুলেখিকা , সঙ্গীতজ্ঞা এবং চিত্রকর ছিলেন । তাঁর লেখা “কালী দী মাদার “, “ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ”,”ক্রেডল্ টেইলস্ অফ হিন্দুইজম্,” “মাই মাস্টার অ্যাজ আই স হিম্”, এই বইগুলি প্রমান করে তিনি ভারতের ভাবধারা কে কতখানি অন্তর থেকে গ্রহন করেছিলেন । তিনি একাধিকবার কালীঘাটে যেতেন এবং তাঁর লেখা কালী দী মাদার তখন স্বদেশপ্রেমি দের বীজমন্ত্রের কাজ করতো ।শ্রী অরবিন্দ ও এই বইএর দ্বারা বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনে তিনি বিপ্লবাগ্নির মতো জ্বলে উঠে সেই তেজরাশি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের মধ্যে ।
গুরুর মৃত্যুর তাঁর অসম্পূর্ণ কাজের ভার গ্রহণ করে শিব জ্ঞানে জীবসেবা , আপামর হিন্দু ও ভারতবাসীকে নিজের ভাই বলে আপনকরে নেওয়া , দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করাই ছিল তাঁর ব্রত । গুরুর মত ই শরীর চর্চা ও খেলাধূলাকে তিনি প্রধান্য দিতেন এবং দেশের যুব সম্প্রদায়কে নিজের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় জাগিয়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ। অমৃতবাজার ও বিভিন্ন ইংরাজি পত্র পত্রিকায় তিনি লিখতেন তাঁর জ্বালাময়ী লেখা ।
তিনি প্রথম ভারতের জাতীয় পতাকার নকশা অঙ্কন করেন । লাল রঙের পতাকায় সোনালী রেশমের বজ্র দিয়ে। লাল রঙ স্বাধীনতা ও হলুদ বা সোনালী রঙ বিজয়ের প্রতীক । ।স্বার্থশুন্য মানুষ ই বজ্র, সেই নিঃস্বার্থপরতার সন্ধান আমাদের করতে হবে যাতে দেব হস্তের বজ্র হয়ে উঠতে পারি – এই ছিল তার ভাবনা ।
অতিরিক্ত পরিশ্রম , ভারতের বিপরীত জলবায়ু সব মিলিয়ে তিনি অসুস্হ হয়ে পড়েন । এবং হাওয়া বদলের জন্য দার্জিলিঙ যান বসু পরিবারের সঙ্গে । সেখানেই লেডি অমলা বসুর সান্নিধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয় । মৃত্যুশয্যাতেও তিনি উইল রচনা করে তাঁর যাবতীয় যেখানে যা কিছু ছিল বেলুড়ে বিবেকানন্দ স্বামীজি মঠের ট্রাস্টিদের ভারতীয় নারীদের জাতীয় প্রনালীতে জাতীয় শিক্ষা প্রচলনের জন্য সব দান করে যান ।
কিন্তু দুঃখের ,দার্জিলিঙে যেখানে টয় ট্রেন গুলি দাঁড়ায় তারই পাদদেশে একটি ছোট্ট হিন্দু শ্মশান ভূমিতে এক গুরুভাইএর হাতে সম্পূর্ণ হিন্দুমতে মুখাগ্নি করে তাঁর মরদেহর সৎকার করা হয় , দার্জিলিঙের নির্জন শ্মশানে একটি ফলকে আজ ও লেখা আছে “”এখানে ভগিনী নীবেদিতা শান্তিতে শায়িত আছেন , যিনি ভারতবর্ষ কে তাঁর সর্বস্ব অর্পন করেছিলেন ।”” এই ফলক টিও নির্মান করেছেন অভেদানন্দ রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ ।
ভাগ্যিস। নইলে যে মহিয়সী নারী নিজের দেশ বা স্বজন, স্বধর্ম ছেড়ে এই সুদূর ভারতবর্ষ কে নিজের কর্মভূমি এবং হিন্দুধর্মকে নিজের ধর্ম বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এবং জগতে তা প্রমান ও করার জন্য নিজের জীবন দিয়ে গেলেন তাঁর শেষ আশ্রয় টুকুও আমরা খুঁজে পেতাম না । পাশেই একটি ছোট্ট গ্রাম নিবেদিতা গ্রাম নামে পরিচিত । অনেক বাঙালী সারা বছর দার্জিলিঙ এ ছুটি কাটাতে যান । তাদের মধ্যে ক’জন এই স্মৃতিফলকটির খোঁজ করেছেন জানতে বড় ইচ্ছে করে । সার্ধ শতবর্ষে হয়তো মহা ধুমধামে তাঁর জন্মোৎসব পালিত হবে । কারণ বাঙালী উৎসবমুখি । কিন্তু তবু কি আমরা পারব এই মহান নারীর সত্যিকারের সম্মান দিয়ে তাঁর শেষ আশ্রয়টুকুর যোগ্য মর্যাদা দিতে !! সময় তার উত্তর দেবে । আর প্রশ্ন রইল উত্তর প্রজন্মর কাছে ।
মিতালী মুখার্জী ।
৮|১০|২০২০।।