ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে ৪১ জন বঙ্গসন্তানের ফাঁসি হয়েছিল শহীদ বসন্ত বিশ্বাস ছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম তিনি ছিলেন ষষ্ঠ বাঙালি হিন্দু শহীদ । নীলবিদ্রোহের মহানায়ক দিগম্বর বিশ্বাসের নাতি ছিলেন তিনি। কৃষক পরিবারের এই বিপ্লবী সন্তান বাংলা থেকে বহুদূরে পঞ্জাবের অম্বালা জেলে ২০বছর ৩মাস ৬দিনের মাথায় আত্মীয়, বন্ধু বান্ধবহীন দেশে বসন্ত কুমার বিশ্বাসের ফাঁসি হয় ১১ই মে ১৯১৫।যখন ১৬ বছর বয়স বসন্ত বিশ্বাস বিপ্লবের পথে পা বাড়ায় , যখন ধরা পড়েন তখন বয়স ১৯ বছর ২১ দিন।
পিতৃবিয়োগের কারণে ১৯১৪র ৫ই ফেব্রুয়ারি বসন্ত বিশ্বাস লাহোর থেকে দেশের বাড়িতে আসেন। ঘাটশ্রাদ্ধের দিন কেনাকাটার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণনগরে তাঁর কাকা প্রতাপচন্দ্রের বিশ্বাসের বাড়িতে এলে প্রতাপ বাবুর এক নিকট আত্মীয় পুলিশকে খবর দিয়ে বসন্ত বিশ্বাস কে ধরিয়ে দেয় (২৪ শে ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার দুপুরে)। বসন্ত বিশ্বাস কে দেশের কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ক্ষীরোদ গাঙ্গুলী। যুগন্তর গোষ্ঠীর একজন পুরনো সদস্য আদি বাসস্থান ছিল ঢাকার তারাজ্ঞেওর গ্রামে। তিনি ছিলেন মুড়াগাছা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস “যুগান্তর ” দলের সদস্য ছিলেন।১৯১০ সালে তিনি স্কুল জীবন ত্যাগ করে যুগান্তর দলের সদস্য বিপ্লবী ‘অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘ সঙ্গে যোগ দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। এরপরে কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে সমবায় সমিতিতে বিপ্লবী ‘রাসবিহারী বসু’র সঙ্গে আলাপ হয়। পরবর্তীকালে রাসবিহারী বসুর কাছে থেকে সশস্ত্র কর্মকাণ্ডে দীক্ষা নেন। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে বসন্ত বিশ্বাস দেরাদুনে চলে যান। সেখানে গিয়ে ‘ পি.এন ঠাকুর’ ভিলার আমবাগানে ‘বসন্ত বিশ্বাসকে ‘ বোমা নির্মাণ ও বোমার নিক্ষেপ ট্রেনিং দেওয়া হয়।বসন্ত বিশ্বাসের বৈপ্লবিক কাজকর্ম সম্পর্কে তাঁর গতিবিধি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি যে, রাসবিহারী নেতৃত্বে দিল্লি ও লাহোরের বোমা বিস্ফোরণের যে ঘটনা ঘটেছিল তাঁর সাথে প্রত্যক্ষভাবে বসন্ত বিশ্বাস জড়িত ছিলেন। দিল্লির চাঁদনিচকের প্রকাশ্য রাজ পথে সুশোভিত শোভাযাত্রায় হাতির পিঠে চড়ে ভারতের গভর্নর লর্ড হার্ডিঞ্জ এগিয়ে এলে মহিলার পোষাকে বসন্ত বিশ্বাস এগিয়ে আসে (বসন্ত বিশ্বাসের ছদ্মবেশ ছিল লীলাবতী নামে এক স্ত্রী লোকের বেশে)।লর্ড হার্ডিঞ্জ কে বোমা মেরে আহত করে পালিয়ে যায় ।
কাশীতে বিপ্লবী কাজকর্মে সাথে জড়িত ছিলেন বসন্ত বিশ্বাস, পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী বসন্ত বিশ্বাস ১৯১০ সালের শেষের দিকে কাশীতে আসেন। ১৭মে ১৯১৩ লাহোর বোমা বিস্ফোরণ কাণ্ডে অভিযুক্ত হন দিল্লির চাঁদনীচকে ও লাহোর গার্ডেনে যে দুটি শক্তিশালী বোমা ব্যবহার হয়েছিল সে দুটি বোমা বানিয়েছিল বাংলা চন্দননগরে বিপ্লবী গ্রুপের মণীন্দ্রনাথ নায়ক। বোমা দুটি কলকাতাতে আনেন নলিনী দত্ত॥ সেই দুটি বোমা চেক করে দেন বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যাপক সুরেশচন্দ্র এবং দিল্লিতে পৌঁছে দেন চন্দননগরের জ্যোতিষচন্দ্র সিংহ। পুলিশের শত অত্যাচার সহ্য করেও বসন্ত ছিল নির্বিকার ধরা পাড়ার পরও নিজের মুখে কোন দিন কিছু স্বীকার করেনি। দিল্লির দয়ার আদালতে বসন্ত সমেত ১১ জনের বিরুদ্ধে খুনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয় বসন্ত সহ ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় বাকিদের যাবজ্জীবন কারদণ্ড হয়।
১৯১৫ সালের ১১ই মে অম্বালা জেলে বসন্ত বিশ্বাস সহ চারজনের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয় । অমর শহীদ বসন্ত বিশ্বাস আজ মরেও অমর আজ ১১ই মে ২০১৯ বসন্ত বিশ্বাসের ১০৫ তম আত্মবলিদান দিবস। তাঁর স্মরণে দিল্লীতে ‘ বসন্ত বিশ্বাস রাজকীয় সর্বদয় বিদ্যালয় ‘ নামে স্কুল স্থাপন করা হয়েছে।
আর আমরা ! অকৃতজ্ঞ শিক্ষিত বাঙালিরা ! যেন খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই তাঁকে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছি আমাদের হীনম্মন্যতার কারণে ।
বসন্ত বিশ্বাসের জন্মভিটা পোড়াগাছায় নাদিয়া জেলায় নাকাশিপাড়ায় । আজও ভগ্নঅবস্থায় রয়েছে বসন্ত বিশ্বাসের বসতবাড়ি। গ্রামের ঢোকার মুখে রয়েছে তাঁর একটি অবক্ষমূর্তি । বসন্ত বিশ্বাসের স্কুলের সামনে শহীদ বসন্তের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে যার উদ্বোধন করেছিলেন বিপ্লবী ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। কৃষ্ণনগরের রবীন্দ্রভবনের সামনে একটি শহীদ স্তম্ভ আছে বসন্তের নামে। না বসন্তের স্মৃতিতে সরকারি ভাবে কোন অনুষ্ঠান হয় না স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও ।
সৌমেন ভৌমিক