হাথরসের ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তদন্তের জন্য স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা এসআইটি গঠন করেছেন। উত্তরপ্রদেশের স্বরাষ্ট্র সচিব ভগবান স্বরূপের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে অন্য দুই সদস্য হলেন রাজ্যের ডিআইজি চন্দ্র প্রকাশ এবং আইপিএস অফিসার পুনম। এছাড়া ফাস্ট ট্রাক কোর্টে বিচার হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
হাথরসের এই ঘটনা যে ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে, দুটো বিষয় দেখানো হচ্ছে:
- যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে মেয়েরা সুরক্ষিত নয়। সেখানে গণধর্ষণ হলে তার রিপোর্ট পুলিশ নেয় না।
- মেয়েটির পরিবার থেকে যে অভিযোগ জানানো হয় তাতে অভিযুক্ত চারজন যাদেরকে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তারা সবাই তথাকথিত উচ্চবর্ণ হিন্দু। অর্থাৎ বিজেপির রাজ্যে দলিত মেয়ের বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের হিন্দু যদি গণধর্ষণ করে সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনরকম অ্যাকশন নেয় না।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন তোলা হচ্ছে। অথচ এখনও পর্যন্ত কোন রকম ত্রুটি দেখা যায় নি। 15 দিন ধরে মেয়েটি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে দিল্লী সফদরজঙ্গ হাসপাতালে মারা যায় গতকাল মঙ্গলবার, 29 শে সেপ্টেম্বর। তারপর থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয় মেয়েটির নাম দিয়ে ন্যায় বিচার চাওয়ার নামে মিথ্যা খবর পরিবেশন। প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা অত্যন্ত খারাপ। সেটা নিয়ে তীব্র জনগণের ক্ষোভের সৃষ্টি করা হয়েছে যা সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তদের ধর্ম, জাতি, বর্ণ কোন কিছু না দেখেই উত্তরপ্রদেশ পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। মেয়েটির বাড়ি থেকে কোনরকম গণধর্ষণের অভিযোগ জানানো হয়নি। অথচ কংগ্রেসের বিভিন্ন স্থান থেকে তনুশ্রী পান্ডে, প্রিয়াঙ্কা ভদ্রা, রাহুল গান্ধী এবং অন্যান্যরা ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে মেয়েটি দলিত হবার জন্য উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগ নিতে অস্বীকার করছে।
গত 14 ই সেপ্টেম্বর 19 বছরের মনীষা বাল্মীকি বলে দলিত সমাজের এই মেয়েটির উপর অকথ্য শারীরিক অত্যাচার চালায় গ্রামের চার যুবক। একাধিক জায়গায় গভীর ক্ষত, শিরদাঁড়ায় ছিল মারাত্মক আঘাত, মুখমণ্ডল ও জিভে ছিল ভয়ঙ্কর কামড়ের চিহ্ন। হাসপাতালে ভর্তি করার সময় তার দুই পা এবং একটি হাত অসাড় ছিল।
এই অভিযোগের যখন দেশজুড়ে প্রচার হচ্ছে তখন মেয়েটির মেডিকেল রিপোর্ট বেরিয়ে আসে যাতে দেখা যাচ্ছে যে তার সঙ্গে কোনো রকম যৌন অত্যাচার করা হয়নি। তাকে প্রচন্ড জোরে গলা টিপে ধরা হয় যাতে ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়। এই মেডিকেল রিপোর্ট করানো হয়েছে আলীগড় জে. এন. মেডিকেল কলেজ থেকে যেখানে মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল। গত সোমবার অবস্থার অবনতি হলে দিল্লীতে সফদরজঙ্গ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে মঙ্গলবার সকালে মারা যায় সে।
ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায় যে 14 ই সেপ্টেম্বর মেয়েটি তার মায়ের সঙ্গে মাঠে গরুর জন্য ঘাস কাটতে গেলে গ্রামের চারজন ছেলে হামলা করে। মেয়েটির ভাই পুলিশে যে অভিযোগ জানায় তা আইপিসি 307 ধারায় অর্থাৎ প্রাণ হানির চেষ্টা। এরপর এই অভিযোগের ভিত্তিতে সন্দীপ নামে একটি ছেলেকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু এরপর মেয়েটি 161 এবং 164 ধারা অনুযায়ী নিজের বয়ান পুলিশকে দিলে আরও তিনজনের বিরুদ্ধে রেপের অভিযোগ করা হয় এবং পুলিশ 376D ধারায় গণধর্ষণের মামলা দেয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মেয়েটির জিভ কেটে নেওয়া হয়েছে বলা হচ্ছে। যার জিভ নেই সে বয়ান দেয় কিভাবে কারণ তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব অসাড় ছিল মারাত্মক আঘাতের প্রভাবে। যে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হয়েছে তারা হলো সন্দীপ, লবকুশ, রাম কুমার এবং রবি। এদের সবার বিরুদ্ধে এখন আইপিসি 302 ধারা অনুযায়ী অভিযোগ করা হয়েছে। সবাই এখন জেলে আছে।
মেয়েটির মা মিডিয়াকে প্রথম থেকেই বলে আসছেন যে মেয়ের সঙ্গে তিনি মাঠে ঘাস কাটতে গেলে মেয়ে আগে আগে যাচ্ছিল আর একটু দূরে মা তাঁর পিছনে ছিলেন। সেই সময় সন্দীপ নামের ছেলেটি পিছন থেকে এসে মেয়েটির গলা টিপে ধরে খুব জোরে। তারপর তাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে গ্রামবাসীরা অকুস্থলে পৌঁছালে অভিযুক্ত সন্দীপ পালিয়ে যায়। মা এবং ভাই দুজনের বয়ান অনুযায়ী এই অভিযোগ জানানো হয় বলে পুলিশ যথেষ্ট সংশয়ে পড়ে যায় গণধর্ষণের নতুন অভিযোগে।
উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফ থেকে জেলা প্রশাসন এখনো পর্যন্ত মেয়েটির পরিবারকে 10 লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য করেছে।
এই ঘটনায় যদি ধরেও নেওয়া হয় যে মেয়েটিকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল, তাহলেও যেমন অভিযুক্তদের কঠোরতম শাস্তি প্রাপ্য। আবার যদি গণধর্ষণ নাও হয়ে থাকে, তবুও তাদের কঠোরতম শাস্তি প্রাপ্য। কোন অবস্থাতেই অভিযুক্ত চারজন যেন নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বেকসুর খালাস না হয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশ সরকার অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গেই চারজনকেই জেলে পাঠিয়েছে। এখনও পর্যন্ত তদন্তের কোন গাফিলতি নেই। মেয়েটির যথাযথ চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে। একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। অভিযুক্ত চারজন হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও তাদের পরিচয় কোথাও লুকানো হয়নি।
অন্যান্য গণধর্ষণ মামলায় আমরা কিন্তু বহুবার দেখেছি, অভিযুক্ত যখনই কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম মতাবলম্বী হয়, তখন তাদের পরিচয় গোপন করা হয়। অথবা বারবার উল্লেখ করা হয় যাতে তাদের সম্প্রদায়ের কোন দায় বা দোষ নেই। অভিযুক্ত কত সহজ সরল ছিল, তাও ঘটা করে বেরোতে দেখেছি আমরা। অন্য দিকে এই ঘটনার জন্য পুরো উত্তরপ্রদেশের শাসনব্যবস্থার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছে যারা তারা কি কখনো নিজেদের দিকে আঙ্গুল তুলেছে? কংগ্রেসের আমলে এই দেশে নির্ভয়ার মত খোদ রাজধানী শহরে ভয়ঙ্কর গণধর্ষণ হয়েছিল। সমগ্র দেশবাসী তার ভয়াবহতা এখনো মনে রেখেছে। আইনের মারপ্যাঁচে অপরাধের সময় একজন নাবালক হবার জন্য মাত্র তিন বছরের সাজা ভোগ করে বেরিয়ে আসে। পরে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এর আম আদমি পার্টি তাকে সেলাই মেশিন দিয়ে নতুন জীবনের নতুন অধ্যায়ের জন্য সাহায্য করে। এক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত এমন কিছুই হয়নি। মেডিকেল রিপোর্টে গণধর্ষণ বলে কোথাও উল্লেখ করা নেই। মেয়েটির পরিবার, তার মা, ভাই কোথাও গণধর্ষণের কথা অভিযোগে জানায় নি। রিপোর্টে পাওয়া না গেলে সেই নিয়ে মানুষকে মিথ্যা প্রচার করে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক সুবিধা নেবার যে ঘৃণ্য রাজনীতি এই দেশে বরাবর হয়ে আসছে তার উত্তর কে দেবে? আর যারা এত কথা বলছে তারা তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করুক। যদি গণধর্ষণ প্রমাণিত হয়, অবশ্যই সেই অনুযায়ী কঠোরতম শাস্তি হোক। কিন্তু যেভাবে এখন এদের অভিযুক্তদের নাম ‘রাম’ বা ‘লবকুশ’ এর সঙ্গে জুড়ে হিন্দু ধর্মের আবার অহেতুক অবমাননা করা হচ্ছে, সেটা যখন অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে নামের সঙ্গে ‘মহম্মদ’ থাকে, তখন হলে এভাবেই এতটাই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে তো? যেভাবে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি শাসিত অঞ্চলে কোন অপরাধ হলে এরা টুইট করে প্রতিবাদ করে, মহারাষ্ট্রে সাধুদের পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনায় এদের মুখে তালা লাগায় কে? নাকি হিন্দু সাধু ছিল বলে, তাদের গায়ে গৈরিক বস্ত্র ছিল বলে, যে কোনো অজুহাতে মেরে ফেলার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে? এই দেশ পৃথিবীর এমন একমাত্র দেশ যেখানে পীড়িত এবং অভিযুক্ত, এদের ন্যারেটিভ ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। প্রতিবার মনে হয় যেন হিন্দু হয়ে জন্মে আমরা এই দেশে আসলে অপরাধ করে ফেলেছি। তাই জম্মু-কাশ্মীরের ছোট্ট ফুলের মতন শিশুকে, যার নাম আসিফা ছিল, তাকে যৌন অত্যাচার করে মেরে মন্দিরে ফেলে রেখে গেলে দোষ হয়ে যায় সমগ্র হিন্দু সমাজের। যদিও পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয় যে সেখানেও অভিযুক্তরা মুসলিম ছিল। কিন্তু তারপরেও তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে না কেউ। অপরাধের ধর্মীয় কারণ যদি বারবার প্রতিবাদের চালিকা শক্তির আধার হতে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ যে একদিন ভাঙ্গবে, এটা অবশ্যম্ভাবী।
এই ঘটনায় আমরা ফাস্ট ট্রাক কোর্টে চার অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হবার পর কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হোক এই আশা করি। এবারে যেমন কোনভাবেই এদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ না দেখে উত্তরপ্রদেশ সরকার সব রকম ভাবে এগিয়ে এসেছে, ঠিক একই ভাবে সব ক্ষেত্রেই সব রাজ্যের প্রশাসন সহযোগিতা করবে।
পরিশেষে বলি, সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা যে কোনো খবর দেখে, তার ন্যারেটিভ না বুঝে, তাকে পোস্ট করছেন বা ট্রেন্ড করাচ্ছেন, তাদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, আগে খবরের সত্যতা বিচার করুন, বিভিন্ন নিউজ লিঙ্ক নিজেরা দেখুন, যাচাই করুন। অথবা এমন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কিংবা কোন নির্দিষ্ট মিডিয়াকে নিরপেক্ষভাবে ফলো করার চেষ্টা করুন যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন নেই। সামনে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট। আর ভোটের আগে প্রতিদিন এইরকম নতুন নতুন খেমটা নাচ আমরা দেখতেই পাবো। আমরা সেই নাচ দেখে কতটা প্রতিক্রিয়াশীল হব, সেটা ভাববার মতন এবার সময় এসেছে।
দেবযানী হালদার