ভগত সিংয়ের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে মার্কসবাদী বিপ্লব বলে অভিহিত করার আগে যে কোনো মানুষের “কেন আমি নাস্তিক” (Why I am an Atheist) পড়া উচিত। তিনি এই গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠায় পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন যে, হিন্দুস্তান রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন-এর (এইচআরএ) প্রতিষ্ঠাতা শচীন সান্যাল এবং রাজেন্দ্র লাহিড়ী সহ এই আন্দোলনের প্রায় কেউই মার্কসবাদী ছিলেন না।
হিন্দুস্তান রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা শচীন সান্যাল মার্কসবাদকে অপছন্দ করতেন, বন্দিজীবনে স্পষ্টভাবে তার উল্লেখ করেছিলেন। তিনি “সমাজতন্ত্র” শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন কারণ তৎকালীন সময়ে এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদের যে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত একটি বহুল প্রচলিত শব্দ ।
ভগত সিং তাঁর পরিবারের কাছ থেকে তাঁর বিপ্লবী সত্ত্বাটি অর্জন করেছিলেন, যারা ছিলেন শিখ আর্য সমাজী (ধর্মতত্ত্ব নয়, ভাষা নিয়ে বিভক্ত হওয়ার আগে দুটি সংগঠনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল)। “হিন্দু জাতীয়তাবাদী” নেতা লালা লজপত রায়কে হত্যার প্র্তিবাদে ভগত সিং ও তার সহযোগিরা লাহোরের তৎকালীন পুলিস সুপার স্যান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন। এরপর ভগত সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত ইংরেজ সরকারের জনবিরোধী বিলের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় আইন সভায় বোমা নিক্ষেপ করে গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাদের ফাঁসি হয়।
ভারতীয় কমিউনিজমের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় তবে পরবর্তীকালে তিনি এই আন্দোলন ছেড়ে চলে যাওয়ায় তাকে সহজেই সবাই ভুলে গেছেন। এরপরে এই আন্দোলনটি ব্রিটিশ কমিউনিস্টদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল যাদের মধ্যে রজনী পাম দত্ত ছিলেন অন্যতম।
মজার বিষয় হল, কিছু এইচআরএ বিপ্লবীরা জাতীয়তাবাদী হিসাবে কারাগারে গিয়েছিলেন এবং 1930 এর দশকে কমিউনিস্ট হয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। তারা আমাদের জন্য সাক্ষ্য রেখে গেছেন যে ব্রিটিশ কারা কর্তৃপক্ষ তাদের কারাগারে বেশিরভাগ মার্কসবাদী সাহিত্য সরবরাহ করত। কিন্তু কেন?
এই বিপ্লবীদের কমিউনিজমে রূপান্তরকরণের প্রক্রিয়া ব্রিটিশদের পক্ষে কার্যকারী হয়ে উঠেছিল কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা ব্রিটিশদের হয়ে তাদের প্রাক্তন সহকর্মীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল।
1930 এর দশকে বিপ্লবী আন্দোলনে অনুপ্রবেশ হল কমিউনিস্টদের আসল সাফল্য। তবে যাদের কমিউনিস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে দাবি করা হয় তারা মার্কসবাদী হওয়ার আগেই তাদের বিপ্লবী অবদান রেখেছিলেন।
দেখুন ভগত সিং তাঁর আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শচীন্দ্রনাথ সান্যাল সম্পর্কে “আমি কেন নাস্তিক” এ যা লিখেছিলেন ।
এছাড়াও ভগত সিং “কেন আমি নাস্তিক” এ রাম প্রসাদ বিসমিল এবং রাজেন্দ্র লাহিড়ীর বিশ্বাস ও আচরণ সম্পর্কে যা লিখেছিলেন যারা সাহসের সাথে ফাঁসির মুখোমুখি হয়েছিলেন।
কুতুবউদ্দিন নামে একজন মার্কসবাদী কীভাবে শচীন বাবুকে মার্ক্সবাদীতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছিল সে সম্পর্কে শচীন সান্যালের বক্তব্য এখানে রয়েছে। তিনি শুধু যে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আকৃষ্ট হননি, কুতুবউদ্দিনের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও অত্যন্ত সন্দিহান ছিলেন।
এখানে সুবোধ রায় আমাদের বলছেন যে ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে কনিষ্ঠ বিপ্লবীরা কীভাবে কারাগারে সুপরিকল্পিতভাবে মার্কসবাদীতে পরিণত হয়েছিল যাতে তারা তাদের পূর্ববর্তী জাতীয়তাবাদী বিশ্বাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং পূর্ববর্তী প্রজন্মের বিপ্লবী নেতাদের কথায় কান না দেয়।
ভগত সিং তাঁর স্বল্প আয়ুষ্কালের শেষের দিকে মার্কসবাদের প্রতি আগ্রহী হন। তবে তিনি তাঁর বৈপ্লবিক সত্ত্বা থেকে তা গ্রহণ করেননি, তিনি ভারতে কোনো কমিউনিস্ট আন্দোলনও খুঁজে পাননি। আজকের কমিউনিস্টরা তাকে এমন একটি আন্দোলনের অংশ হিসাবে স্মরণ করে যা কোনো মতেই মার্কসবাদী ছিল না।
বিপ্লবী আন্দোলনে কমিউনিস্ট অনুপ্রবেশ তার নেতাদের কাছে উদ্বেগের বিষয় ছিল। ১৯৮৮ সালে শচীন সান্যালকে লেখা রাসবিহারী বোসের একটি চিঠি এখানে রয়েছে।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়, রাসবিহারী স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছিলেন যে কীভাবে ব্রিটিশরা তাদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলন ভাঙ্গতে কমিউনিস্টদের ব্যবহার করতে পেরে বেশ খুশি হয়েছিল। যদিও জাপানের প্রতি তাঁর দুর্দান্ত বিশ্বাস ভুল জায়গায় প্রতিভাত হয়েছে।
এটা পরিষ্কার হওয়া উচিত যে উপনিবেশিক সরকার কীভাবে তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অনুপ্রবেশের জন্য রজনী পাম দত্তের মতো ব্রিটিশ কমিউনিস্টদের ব্যবহার করছিল সে সম্পর্কে ভারতীয় বিপ্লবীরা যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। লেখক যশপাল নিখাদ তথ্যদাতাদের একটি মাত্র উদাহরণ।
এখানে আরও একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে যেখানে রাসবিহারী বসু শচীন সান্যালকে কংগ্রেসের মধ্যে নেতাজিকে সমর্থন করতে বলেছিলেন। সাধারন বিশ্বাসের বিপরীতে, কংগ্রেসে অনেক বিপ্লবী ছিলেন যাদের সমর্থনেই নেতাজি গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন।
১৯৩৮ সালে, এক দশক কারাগারে থাকার পরে শচীন সান্যালকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। রাসবিহারী বসু জিডি বিড়লাকে শচীন সান্যালের পরিচয় দিয়ে পত্র লিখেছিলেন, যেখানে শচীন সান্যালকে সাহায্য ও উপদেশ দেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করে ছিলেন। খুব কম লোকই জানেন যে জিডি বিড়লা ১৯১৪ সালে রড্ডা অস্ত্র লুন্ঠনের লুন্ঠিত অস্ত্র লুকিয়ে রেখে বিপ্লবীদের সাহায্য করেছিলেন।
Translator : Debaditya Bhaduri