গণতন্ত্রের বিষয়ে নিষ্ঠাযুক্ত আলোচনায় ব্রতী হলে আমাদের অন্তরে দুটি ভাবনাকে পুনরুজ্জীবিত অবস্থায় খুঁজে পাই। বিষয় দুটো নতুন কিছু নয়; কিন্তু এদের সার্থক প্রয়োগ যে-যে দেশে আমরা দেখতে পাই, তাদের ভূয়সী প্রশংসা না করে উপায় থাকে না। প্রথমটি হলো ব্যক্তিস্বাধীনতা, দ্বিতীয়টি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকারবোধ সেখানেই প্রতিষ্ঠিত, যেখানে সর্বশ্রেণীর মানুষই রাজনীতিতে যোগ দিতে বাধামুক্ত এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীর কনস্পিরেসি হালে পানি পায় না। ইতিহাস চর্চা করলে আমরা দেখতে পাব, বহু শত বছর পূর্বেও মানুষের মনে গণতন্ত্র লাভের আকাঙ্ক্ষা ছিল তীব্র, যদিও শিরোনামে পৌঁছে থাকার মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। ইতিউতি গণতান্ত্রিক কাঠামো নজরে এলেও, তাতে পুলকিত হবার যোগ্য আবহমানুষ পায়নি। যিশুর জন্মের ৫১৫ বছর আগের গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সে গণতন্ত্রের আংশিক প্রয়োগ ঘটেছিল। আংশিক শব্দটি ব্যবহার করলাম এই কারণে যে, তখন এথেন্সে মহিলা ও ক্রীতদাসদের কোনও ভোটাধিকার ছিল না। কালান্তরে গ্রিসের অন্যান্য দেশেও গণতন্ত্রের কিছু কিছু আভাস আমরা দেখতে পাচ্ছি। যুগের প্রেক্ষিতে ওই যে উন্নত আয়োজন, তার পিছনে রয়েছে গ্রিক দার্শনিক ও রাজনীতিজ্ঞদের ধারাবাহিক চর্চা ও অভিমত। যেমন প্রাচীন গ্রিসের বিশিষ্টচিন্তাবিদ পেরিক্লিস বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র সর্বত্র স্বাগত। কারণ, গণতন্ত্রেই মৌলিক সৃজনশীলতা যথাযথ সম্মান পায়। এই ব্যবস্থা মানবিকতারও রক্ষাকবচ।তাই গণতন্ত্রকে বিশুদ্ধতার সঙ্গে লালন করা উচিত। কিন্তু গ্রিসের অন্য দুই বরেণ্য দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল অত দরাজভাবে গণতন্ত্রের আইকনিজকে সমর্থন জানাননি। তারা বললেন, রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে লালন করা দুষ্কর। নীতিকথা অনেক সময় নির্মম কল্পকথা হয়ে দাঁড়ায়। যা ছিল উজ্জ্বল, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় মসিলিপ্ত। কারণ নাগরিকরা একই উচ্চতায় দাঁড়িয়ে নেই। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল যে কারণে গণতন্ত্রকে সার্টিফিকেট দিতে ব্যগ্র হননি, বহুযুগ পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল তার ব্যাখ্যা করেছেন এই ভাবে : ‘গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে দুইটি শর্ত পূরণের ওপর। প্রথমত, এমন আর্থিক সাম্য যেন সংশ্লিষ্ট দেশটিতে থাকে, যার প্রভাবে অর্থের বিনিময়ে একজন ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির অভিমতকে স্বপথে টেনে আনতে অসমর্থ হন। দ্বিতীয়টি হলো শিক্ষা। যে দেশে অধিকাংশ নাগরিক শিক্ষিত নন, গণতন্ত্র সেখানে একটি সোনার পাথরবাটি মাত্র।
স্টুয়ার্ট মিলের এই উপলব্ধির সত্যতা অনস্বীকার্য হওয়ায় আমাদের মধ্যে বেশ কিছু মানুষ বিমর্ষ হতেই পারেন। নির্বাচনী প্রচারে নেমে রাহুল গান্ধী যখন ‘ন্যায়’ শীর্ষক ধ্বনিকে উচ্চকিত করে তোলেন স্রেফ ভোট কেনার তাগিদে, আমরা একটু চিন্তা করলেই স্টুয়ার্ট মিলের ব্যাখ্যাকে টেনে আনতে সমর্থ হব। স্রেফ ভোট কেনার জন্য এই যে মেধাশূন্য আকুলি-বিকুলি, ইদানীং আমাদের দেশে তা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অজ্ঞানেই ইত্যাকার অশিষ্টাচারের জন্ম। ইতালির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেকিয়াভেলি সেই মধ্যযুগেই বলে গেছেন, “যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্নীতির আখড়া, জনসাধারণের নৈতিক কর্তব্য হলো সেই আখড়াকে পদদলিত করা। এর জন্যই প্রয়োজন, গণতান্ত্রিক দেশে একটি মজবুত সংবিধানকে কার্যকর করা।
মেকিয়াভেলির এই শেষোক্তে মন্তব্যকে স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের মেনে নেওয়া উচিত যে, সংবিধানই হলো একটি গণতান্ত্রিক দেশের। সর্বাপেক্ষা পবিত্র দেবপ্রতিম আয়ুধ। এই আয়ুধকে অতীতে যিনি বা যাঁরা মান্যতা দেননি, বর্তমানেও যাঁরা একে নানাভাবে অপব্যবহার করতে চান, জনতার সমবেত ধিক্কারে তারা যেন নিক্ষিপ্ত হন আবর্জনার স্তুপে। স্বাধীন ভারতের সংবিধান বিশ্বের বৃহত্তম সংবিধান। প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সবিস্তার বর্ণাঢ্যতায় টানা সরলরেখায় এই মহান গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল সর্বজন বরেণ্য ড. আম্বেদকরের নেতৃত্বে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে ওই অজটিল গ্রন্থনাকেই জটিল ও কলুষিত করবার মতো দুবৃত্তরা জুটে যান, যদিও তাদের সরাসরি চিহ্নিত করবার প্রয়াস। আজও লক্ষণীয় নয়। বিষয়টা সামান্য খুলে বলতে চাই। ওই মহাগ্রন্থ লেখা হয়েছিল কালি ও কলম দিয়ে। এবং গ্রন্থটির চিত্রায়নের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল কালজয়ী প্রতিভাদীপ্ত চিত্রকর নন্দলাল বসুর ওপর। নন্দলাল বসু সেই হস্তলিখিত গ্রন্থটিতে সংযোজিত করেন অনেকগুলি অসাধারণ ছবি। ছবিগুলির বিষয়। ছিল রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের একাধিক ঘটনা; ছিল গৌতমবুদ্ধ সমেত প্রাচীন ও ঐতিহ্যময় ভারতের গর্ব বেশ কয়েকজন সাধু-সন্তের অবয়ব। আজ ভাবতে ঘৃণা বোধ হয় যে, সংবিধান মুদ্রণকালে দেখা গেল ওই অমূল্য চিত্রগুলিকে কে বা কারা বিনষ্ট করে ফেলেছেন। একটি ছবিও খুঁজে পাওয়া গেল না। বলাবাহুল্য, ক্ষমতার তখতে তখন আসীন জওহরলাল নেহরু- যিনি ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চপ। সামান্যতম দুঃখপ্রকাশেও কুঁড়েমি।
এর পরবর্তীকালে আরও এমন একটি ঘটনা ঘটে, যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই সমকালীন সরকার হয় আয়েশি নতুবা হিংস্র হয়ে উঠেছে। আমাদের আদি সংবিধানের প্রস্তাবনায় Socialist এবং Secular এই শব্দ দুটি ছিল না। সংবিধান প্রথম মুদ্রিত হবার ২৭ বছর বাদে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ওই দুই শব্দকে নিঃশব্দে ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু কোনও তারিখ বা স্বাক্ষর বা ব্যাখ্যা রাখেননি। পাঠ করলে মনে হবে স্বয়ং আম্বেদকরই বুঝি ‘প্রস্তাবনায় শব্দদুটিকে স্থান দিয়ে গিয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে এক ধরনের লুকোচুরি। পরবর্তী প্রজন্ম যাতে অন্যান্য শপথের সঙ্গে ওই সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকেও সম গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়, তার একটা বন্দোবস্ত করে গেলেন শ্রীমতী গান্ধী। কে আর অত অতীত ইতিহাস ঘেঁটে এই সমস্ত লুকোচুরির হদিশ খুঁজতে বের হবে? সেই থেকে ধর্মভিত্তিক দেশভাগের পরও এই খণ্ডে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অত বোলচাল ও তরিবত উপচে পড়া আবেগ। ভারতের ইতিহাসের অনেক পর্বই এভাবে অবিরত শয়নে নিশ্চল। আড়মোড়া ভাঙবার দায়িত্ব নিতে হবে এই প্রজন্মকেই।
শেখর সেনগুপ্ত
2019-05-09