গত ১৮ ই সেপ্টেম্বর, লোকসভায় কৃষি সংক্রান্ত তিনটি বিল পেশ করা হয়। ২০ তারিখ রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে যায়। ২৭ শে সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেন। যুগান্তকারী তিনটে বিল কৃষি ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে বলে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী বক্তব্য রাখলেও এদের বিরোধিতা করা হচ্ছে।
তিনটে বিল সম্বন্ধে আগে একটু জেনে নেওয়া যাক।
১. কৃষকের উৎপাদন ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার ও সুবিধাদি) বিল, ২০২০
এই বিলটি কৃষি বাজার সংক্রান্ত। এই বিলে বলা হয়েছে এমন একটি ইকো সিস্টেম তৈরি করা হবে, যেখানে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা রাজ্যের কৃষি পণ্য বাজার কমিটির আওতায় কৃষিমান্ডিগুলির বাইরেও কৃষিজাত পণ্যের বেচাকেনার স্বাধীনতা পাবে।
রাজ্যের ভিতরে ও বাইরে কৃষি উৎপাদনের বাণিজ্যে কোন রকম বাধা থাকবে না।
বিপণন ও পরিবহন ব্যয় কমবে, যার ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের আরও ভাল দাম পাবেন।
কৃষকদের ই-কমার্সের জন্য একটি সুবিধাজনক পরিকাঠামোও সরবরাহ করবে এই বিল।
২. কৃষকদের (ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষা) মূল্য আশ্বাস এবং খামার পরিষেবার চুক্তির বিল, ২০২০
এই বিলটি চুক্তিভিত্তিক চাষ সংক্রান্ত। এতে বলা হয়েছে যে কৃষকরা ভবিষ্যতের কৃষি পণ্য বিক্রির জন্য কৃষিবাণিজ্য সংস্থা, প্রক্রিয়াকারক সংস্থা, হোলসেলার, পাইকারি ব্যবসাদার, রফতানিকারক বা বড়মাপের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে প্রাক-সম্মত মূল্যে চুক্তি করতে পারবেন।
এই চুক্তির মাধ্যমে পাঁচ হেক্টরের কম জমির মালিক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা লাভবান হবেন (ভারতের মোট কৃষকদের ৮৬ শতাংশই প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষক)।
এতে করে অপ্রত্যাশিত বাজারের ঝুঁকি কৃষকদের কাঁধ থেকে তাদের স্পনসর সংস্থাগুলির কাঁধে স্থানান্তরিত হবে।
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষকদের আরও ভাল তথ্য পেতে সক্ষম করবে।
বিপণনের ব্যয় কমিয়ে কৃষকদের আয় বাড়াবে।
মধ্যস্থতাকারীদের এড়িয়ে কৃষকরা সরাসরি বিপণনে জড়িত থেকে সম্পূর্ণ দাম নিজেরাই পেতে পারবেন।
প্রতিকারের সময়সীমা বেঁধে বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যকরী প্রক্রিয়া তৈরি করা হবে।
৩. অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) বিল, ২০২০
এই বিলটি পণ্য সম্পর্কিত। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে খাদ্যশস্য, ডালশস্য, তৈলবীজ, পেঁয়াজ এবং আলু জাতীয় পণ্য সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে এই বিলে। যুদ্ধের মতো কোনও ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি’ বাদে এই জাতীয় পণ্যগুলির মজুতে কোন ঊর্ধ্বসীমা আরোপ করা হবে না।
এই বিধান বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা দূর করবে। ফলে বেসরকারী ক্ষেত্র / বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কৃষিক্ষেত্রে আকৃষ্ট হবে।
এতে করে, কোল্ড স্টোরেজের মতো কৃষি পরিকাঠামো এবং খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খলকে আধুনিকীকরণের জন্য বিনিয়োগ আসবে।
দামে স্থিতিশীলতা এনে কৃষক এবং গ্রাহক উভয়ই সহায়তা করা হবে।
প্রতিযোগিতামূলক বাজারের পরিবেশ তৈরি করে কৃষিপণ্যের অপচয় বন্ধ করা হবে।
এই তিনটি বিল নিয়ে যে বিরোধ তা মূলত ন্যূনতম মূল্য সমর্থিত ক্রয় মূল্যের যে ব্যবস্থা ছিল তা বন্ধ হয়ে গেলে কৃষক অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। যে মাণ্ডির মাধ্যমে সে বেচাকেনা করত তার দরকার থাকবে না যদি কৃষক বাইরে বিক্রি করে। সেক্ষেত্রে রাজ্যের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখা দেবে কারণ মাণ্ডি ফি বন্ধ হয়ে যাবে। রাজ্যের যারা ‘কমিশন এজেন্ট’ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট উদগ্রীব সব রাজ্য সরকার। এছাড়াও বলা হচ্ছে যেহেতু কৃষকের হাতে কোথায় বিক্রি করবে বা কার থেকে স্পন্সর নেবে তাতে নাকি কৃষিতে পুঁজিবাদীদের দখল বাড়বে। কিন্তু ন্যূনতম সমর্থন বেঁধে দেওয়া হয়েছে বহু আগে, কতটা ভাল আছে কৃষকরা? কৃষক আর ক্রেতার মাঝখানে ফড়ের এত বেশী উপদ্রব যে কৃষক ও ক্রেতা কারোর অবস্থা ভাল নেই। এত বছর এই সিস্টেম থাকার পরও বাজারের মূল্য নির্ধারণ করে পড়ে। চাষীর উৎপাদন যাই হোক, বিক্রি করতে সে বাধ্য ছিল কারণ অন্য কোন উপায় বা সমান্তরাল পরিকাঠামো ছিল না। ন্যূনতম সমর্থিত মূল্য চাষী কি কখনোই একচেটিয়া ভাবে পেয়ে তার জীবনকে সুনিশ্চিত ও সুরক্ষিত করতে পেরেছে? না, পারে নি। পারলে কৃষিকাজ থেকে মানুষ অন্য জীবিকায় সরে যেত না। কৃষি এখনও লাভজনক ব্যবসা নয়। প্রান্তিক কৃষক এখনও মহাজন আর ফড়ের মাঝখানে পিষে মরছে। ফসলের সঠিক মূল্য না পেয়ে দেনার দায়ে সে এখনও আত্মহত্যা করে। অথবা কৃষকের প্রথম লক্ষ্যই থাকে যাতে তার সন্তান কৃষক না হয়। এদেশে কষ্টের অবস্থান হলে নেহাত নিরূপায় বলেই সে চাষবাস করছে। যদি ন্যূনতম সমর্থিত মূল্য এত প্রয়োজনীয় ছিল তবে কৃষকের দুরবস্থা কেন এত?
এই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বড় অদ্ভুত, দীর্ঘকালীন কোন পরিকল্পনা নয়, সবটাই ফাটকা আর গিমিক নির্ভর। তাই সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো সবাইকে ব্যবহার করে তাদের ক্ষুদ্র রাজনীতির স্বার্থে। আসল সমস্যা হচ্ছে ফড়ে শ্রেণীর নির্মূল হলে বিপুল সংখ্যক মানুষের রুটি রুজি বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ক্রমাগত লোক ঠকিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া কোন রোজগারের সঠিক উপায় হতে পারে না। কৃষকের কৃষিজাত পণ্যের বিক্রি কোথায় করবে সেটা কৃষক নির্ধারণ করুক। পণ্য মজুত করতে যখন সমস্যা নেই তখন ক্লোড স্টোরেজ নির্মাণ হোক। সেটাও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে। কৃষক যেন কোন ভাবেই কোন সিস্টেমের জন্য অসহায় বোধ না করে। সে কোথা থেকে স্পনসর নেবে বা কিভাবে বিক্রি করবে, তার সিদ্ধান্ত যেন সে নিজে নিতে পারে। বারবার তাকে পচনশীল কৃষিজাত পণ্যের ভয় দেখিয়ে তাকে বাধ্য করা না হয়। আর সাধারণ মানুষ একটু দাম কমলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এত বড় দেশে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করে কৃষিকাজ করা হলে কৃষকরা সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে। আর ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে যখন মূল্যহ্রাস হবে। তার খরচ এদিকে কমলে সেই টাকা অন্য খাতে খরচ করলে প্রায় ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে অর্থনৈতিক চাপ হয়ত কমতে পারে। কৃষকের কাছে বিক্রি করার নানা পথ ও উপায় খুলে গেলে কৃষিকাজ অনেক বেশী মুনাফা দেবে। তিনটি বিলের এমন মারাত্মক বিরোধিতা না করে একে স্বাগত জানালে সবাই লাভবান হবে। ফড়ে যারা তারা কর্মহীন হয়ে পড়বে, এটা অবশ্যই একটা বড় সমস্যা। তাদের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে কৃষকের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে।
দেবযানী হালদার (Debyani Haldar)