রবীন্দ্রনাথ “সেকুলার” নয়, “প্রথমে একজন হিন্দু এবং শেষেও একজন হিন্দু” ছিলেন। এ মূল্যায়ণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ত্বরিকুল ইসলাম-এর। ” ধার্মিক হিন্দু রবীন্দ্রনাথ ও সেকুলারবাদের ফ্যালাসি” প্রবন্ধে লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথকে ‘সেকুলার দেবতা’ বানিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠার যে-নিরন্তর প্রয়াস চলছে সেটা ‘দেউলিলয়াপনা’।…” “প্রকারান্তরে ভারতীয় ধর্মীয় হিন্দুত্ববাদকে সম্প্রসারণ ও অনুপ্রবেশের পথকে সুগম করে দেওয়া।”
ধার্মিক রবীন্দ্রনাথকে যারা সেকুলার বানিয়ে প্রগতিশীলতার রাজনীতি করছেন, তারাই মূলত রবীন্দ্রচিন্তার শত্রু। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী হলেও কালচারালি হিন্দুই ছিলেন। ধর্মীয় হিন্দুত্ব (হিন্দুত্ববাদ নয়) ত্যাগ করার মতো আহাম্মক বা হীনম্মন্য তিনি ছিলেন না। হিন্দুত্ব নিয়েই তিনি প্রগতিশীল থাকতে পেরেছিলেন। তার সময়ে তার চেয়ে বড় প্রগতিশীল আর কে ছিলেন?
আগাগোড়া হিন্দুত্ব ধারণ করা ধার্মিক রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে তার সময়কালে ছিলেন সবচে অগ্রসর সাহিত্যিক এবং আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত ও নোবেল বিজয়ী কবি। তিনি সেকুলার ছিলেন না। এমনকি তার কোনো লেখায় সেকুলারিজমের নামগন্ধও খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং রবীন্দ্রনাথ নিজেই হিন্দু-মুসলিম স্বাতন্ত্র্য বা পার্থক্য বিলুপ্ত করাকে ‘আত্মহত্যার নামান্তর’ বলে একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার হিন্দুত্ব নিয়ে ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন:-
“আমরা যে-ধর্মকে গ্রহণ করিয়াছি, তাহা বিশ্বজনীন তথাপি তাহা হিন্দুরই ধর্ম। এই বিশ্বধর্মকে আমরা হিন্দুর চিত্ত দিয়াই চিন্তা করিয়াছি, হিন্দুর চিত্ত দিয়াই গ্রহণ করিয়াছি। শুধু ব্রহ্মের নামের মধ্যে নহে, ব্রহ্মের ধারণার মধ্যে নহে, আমাদের ব্রহ্মের উপাসনার মধ্যেও একটি গভীর বিশেষত্ব আছেই— এই বিশেষত্বের মধ্যে বহুশত বৎসরের হিন্দুর দর্শন, হিন্দুর ভক্তিতত্ত্ব, হিন্দুর যোগসাধনা, হিন্দুর অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান, হিন্দুর ধ্যানদৃষ্টির বিশেষত্ব ওতপ্রোতভাবে মিলিত হইয়া আছে। আছে বলিয়াই তাহা বিশেষভাবে উপাদেয়, আছে বলিয়াই পৃথিবীতে তাহার বিশেষ মূল্য আছে।” (রবীন্দ্র রচনাবলী)
বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তক ও গবেষক ফরহাদ মজহার তার ‘রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ’ বইতে লিখেছেন, “পারিবারিক ও ধর্মীয় পরিচয়, মনন, দর্শন, পঠন, পাঠন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে-মনোগাঠনিক প্রক্রিয়া ও প্রকাশ সচল ছিল তার সম্পৃক্তি হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে, কিন্তু বৌদ্ধ বা ইসলামী ঐতিহ্যের সঙ্গে নয়। রবীন্দ্রনাথ কখনো ভোলেননি যে তিনি হিন্দু।” (পৃষ্ঠা: ৩৯)।
অথচ আমাদের দেশের মুসলিম প্রগতিশীলরা প্রধানত ইসলামী ভাবধারার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েই প্রগতিশীল হওয়ার কোশেশ করেন। আর প্যারাডক্সিক্যালি ব্রাহ্মধর্মী হিন্দু রবীন্দ্রনাথই কিনা তাদের সেকুলার প্রগতিশীলতার আইডল!! কী সেলুকাস! রবীন্দ্রজপ না করলে তাদের আচার-অনুষ্ঠানে সেকুলার আমেজটাই নাকি আসে না!
ডেইলি স্টারের কলামিস্ট অধ্যাপক তাজ হাশমী রবীন্দ্রনাথবিষয়ক আমার এক পোস্টে ইংরেজিতে একটা নাতিদীর্ঘ কমেন্ট করেছিলেন, যা গুরুত্বপূর্ণ। সেই কমেন্টের একটা অংশ অনুবাদ করে উদ্ধৃত করছি-
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা হিন্দুরাজ্যের স্বপ্ন দেখতেন, যদিও তিনি অফিসিয়ালি হিন্দু ছিলেন না। তার দাদা ব্রহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি ছিলেন একজন ব্রাহ্ম। কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে একজন হিন্দু এবং শেষেও একজন হিন্দু। তবে সবচেয়ে বিরক্তিকর এবং আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এমনকি বাঙালি কমিউনিস্টরা (আগেকার চীনপন্থী এবং মস্কোপন্থী) রবীন্দ্রনাথকে তাদের দেবতা হিসেবে প্রশংসা বা বন্দনা করতো। অথচ কমিউনিজমে দেবতা বা ঈশ্বর বিষয়ক কোনো ব্যাপার নেই। আর সেই রবীন্দ্রনাথই কিনা কমিউনিজম সম্পর্কে অত্যন্ত নোংরাভাবে লিখেছিলেন! তবুও তার স্তাবক বাঙালি কমিউনিস্টরা এখনো তাকে ভালোবাসে। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ (১৯২৭) নামক বিখ্যাত বইয়ের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন (ইংরেজিতে ভাষান্তরিত থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত): “এখন কমিউনিস্টরা জমিদারি এবং মহাজনি ব্যবস্থা বিলোপের দাবি তুলছেন, যেন জমিদারি এবং মহাজনি ব্যবস্থা (গলাকাটা সুদে ঋণব্যবসা) না থাকলে দুনিয়াটা স্বর্গে পরিণত হবে। কমিউনিজম এবং ফ্যাসিজম হচ্ছে একই দৈত্যের দুই দিক।”
বস্তুতপক্ষে, আজকে আইরনিক্যালি সেকুলার প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের বড় রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ! আর এই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে বাঙালি মুসলমানের ইসলামী ভাবচেতনা দমনের জন্য, সেকুলার ভণিতার মধ্য দিয়ে।
অথচ রবীন্দ্রনাথ তার কবিতা ও সাহিত্যের মৌলিক উপাদানগুলো নিয়েছিলেন হিন্দু ধর্মের ইতিহাস-ঐতিহ্য, উপনিষদ, পুরাণ ও হিন্দু সংস্কৃতি থেকে। ইউরোপ থেকেও নিয়েছিলেন। তবে তথাকথিত প্রগতির বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তার ছোটগল্প ‘প্রগতি সংহার’ পড়লেই সেটা বুঝা যাবে।
কিন্তু নিজে ফারসি চর্চা করলেও, ফারসি মুসলিম কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও এবং ইসলামী ব্যক্তিত্বদের সাথে তার পরিচয় ও সম্পর্ক থাকলেও রবীন্দ্রনাথ সচেতনভাবেই নিজের চিন্তা ও সাহিত্যকর্মকে ইসলাম ও মুসলিম উপাদান বা ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই জায়গায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ বা বিরাগ নেই, বরং নিজের ধর্মীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করেই তিনি যে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, তাতে আমি মুগ্ধ ও অভিভূত।
হিন্দুত্বকে ধারণ করেই তিনি বিশ্বমানবতার কবি বা বিশ্বকবি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই জায়গায় অত্যন্ত শক্তিশালী। যেমনটা শক্তিশালী মহাকবি আল্লামা ইকবাল। উভয়ের কেউই সেকুলার ছিলেন না, বরং ধর্মানুরাগী ছিলেন। আর অন্যদিকে, কবি হয়েও রাজনৈতিক জায়গায় ইকবাল ও রবিঠাকুর থেকেও কাজী নজরুলের অবস্থান আরো শক্তিশালী। কারণ, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে নজরুল ছিলেন হিন্দু-মুসলিম মিলনের ঐতিহাসিক অগ্রদূত। এটা ঐতিহাসিকভাবে তার রাজনৈতিক অবস্থান, একে সরাসরি আক্ষরিক বা নিছক ধর্মহীন সেকুলার পজিশন বলা ভুল হবে।
কারো ‘পবিত্র রবীন্দ্রানুভূতি’তে আঘাত দেওয়া আমার লক্ষ্য নয়। এমনকি এখানে আমি কবি ও সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে বিচার করতে বসি নাই, বরং বায়ান্ন’র ভাষা-আন্দোলনের কাল থেকে আজতক রবীন্দ্রনাথকে ‘সেকুলার দেবতা’ বানিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠার যে-নিরন্তর প্রয়াস চলছে, সেটার প্যারাডক্স ও দেউলিয়াপনাকে বোঝার চেষ্টা করছি।
এই ম্যানিপুলেটেড রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথের প্যারাডক্স বা বৈপরীত্যগুলো আনফোল্ড করার চেষ্টা করছি। যদিও কবি ও সাহিত্যিক রবিঠাকুরের ব্যাপারে আমি বরাবরই মুগ্ধ, কিন্তু তাই বলে তাকে দেবতার মতো পূজা করারও পক্ষে নই।
এদেশের একশ্রেণির গাণ্ডু সেকুলারদের কর্তৃক ম্যানিপুলেটেড রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথকে আমি আমাদের জাতিরাষ্ট্রের জন্য কালচারাল হুমকি মনে করি। কারণ ভূরাজনৈতিক পরিচয়ে তিনি ‘ভারতীয় বাঙালি কবি’ হিসেবেই সর্বজনস্বীকৃত। তাই, আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে কোনোভাবেই তাঁকে ‘বাংলাদেশের কবি’ বলার সুযোগ নেই।
অবশ্য, সর্বজনীনভাবে তাকে ‘বাংলার কবি’ বলা যেতে পারে। সুতরাং এদেশে রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হলো, প্রকারান্তরে ভারতীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদকে সম্প্রসারণ ও অনুপ্রবেশের পথ সুগম করে দেওয়া।
হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূতরূপে আমরা নজরুলকে পেলেও রবীন্দ্রনাথকে আমরা ধার্মিক হিন্দু সাহিত্যিকরূপেই পাই। খেয়াল করলে দেখবেন, হিন্দু-মুসলিম মিলনের ঐতিহাসিক অগ্রদূতরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও নজরুলকে ঘিরে কিন্তু বিশেষ ধরনের কোনো সেকুলার প্রকল্প বা প্রজেক্ট দেখা যায় না।
নজরুলের হিন্দু-মুসলিম মিলনের বিষয়টি তথাকথিত সেকুলারিজম নয়, বরং তা ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে গণঐক্য ও গণলড়াই সংগঠিত করার রাজনৈতিক সংগ্রাম।
নজরুলের হিন্দু-মুসলিম মিলনের বিষয়টি ইসলামবিদ্বেষী রেডিক্যাল সেকুলার ভাবধারার সাথেও সম্পর্কিত না। সেজন্যই সেকুলার প্রগতিশীলরা নজরুলের লাইনের সেকুলারগিরি করেন না। বরং তাদের লাইনের সেকুলারগিরির জন্য নজরুল অনুকূল নন। কারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য অসংখ্য ভক্তিমূলক গানের রচয়িতা ও শ্যামাসঙ্গীতের স্রষ্টা নজরুলের মধ্যে একইসাথে ইসলামী ভাবচেতনাও শক্তিশালীরূপে পাওয়া যায়। এই জায়গায় রবীন্দ্রনাথের চেয়েও নজরুল অনেক বড় ও মহান।
তাই, এদেশে সেকুলার বিভ্রম তৈরি করে বাঙালি মুসলমানের ইসলামী ভাবচেতনার বিরুদ্ধে আপাত সেকুলার পজিশনের নজরুলের চেয়েও একজন হিন্দু সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অধিকতর সুবিধাজনক।
আমার আফসোস, এখানেই মূলত রবীন্দ্রনাথের চরম অমর্যাদা ঘটে। তার ‘শ্রী’র হানি হয়। এখানেই বঙ্গীয় সেকুলারদের দেউলিয়াপনা উদামভাবে ধরা পড়ে!।
নিতান্তই ধার্মিক রবীন্দ্রনাথকে সেকুলার বানিয়ে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা রবীন্দ্রস্বভাব ও রবীন্দ্রচিন্তার একেবারেই বিপরীত। এভাবেই ঊনিশ শতকে শুরু হওয়া এবং রবীন্দ্রযুগের বিশ শতক পর্যন্ত প্রবহমান বাংলার হিন্দু রেনেসাঁসের অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে-আধুনিক হিন্দু-মানস গড়ে উঠেছিল, সেটাকে আড়াল করার সেকুলার বঙ্গীয় ধূর্ত প্রচেষ্টাকে আমি মোকাবেলা করতে চাই।
পরিশেষে দুঃখ করেই বলবো, বাংলা সাহিত্যে হিন্দুত্ব থাকলে সেকুলারদের জাত যায় না, কিন্তু ইসলাম থাকলেই বজ্জাতি ঘটে যায়!!
রবীন্দ্রনাথের হিন্দু-মুসলমান বিভেদের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের সাথে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সেকুলার শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রধান ড. কুদরত-ই-খুদার কথোপকথনে। পূর্ববঙ্গের মুসিলম বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের একজন ছিলেন ড. মুহম্মদ কুদরত-ই-খোদা।
তিনি ১৯৩৬ সালে রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কেন হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্বের উপর আরো লিখেননি যেটি দেশের স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল?’
জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্ব অসম্ভব। হিন্দু সমাজকে আমি যতোটা জানি তুমি ততোটা জানো না।’
উদ্বিগ্ন কুদরত-ই-খোদা জিজ্ঞাসা করেন, ‘তাহলে সমাধান কী?’
রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘স্বাধীনতা তখনই আসবে যখন পুরো দেশ হয় হিন্দু না হয় মুসলমান হবে।’ (মুহাম্মদ কুদরত-ই-খোদা, ‘কবি স্মৃতি’, ইকবাল ভুইয়া, পৃ-৩৬১)।
ত্বরিকুল ইসলাম
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত)
সৌজন্যে: www.ourislam24.com