” কিন্তু শুধু সূর্য সেনেকেই ধরলে চলবে না, সেই সঙ্গে প্রীতিলতাকেও চাই। কিন্তু প্রীতিলতা তখন কোথায়?”- আমি সুভাষ বলছি
ইংরেজদের হাতে প্রাণ দেবেন না, পটাশিয়াম সায়ানাইড গিললেন প্রীতিলতা
১৯১১ , ৫ মে অধুনা বাংলাদেশে জন্মেছিলেন প্রিতিলতা ওয়াদ্দেদার।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। নামটা ভুলিনি হয়তো আমরা। কিন্তু কেন মনে রাখতে হতো, সেসব বিস্মৃত হয়েছি বোধহয়। চট্টগ্রামে (অধুনা বাংলাদেশ) বড় হওয়া প্রীতিলতা ছাত্রী হিসেবে ছিল বেশ চোখে পড়ার মতোই। ছাত্রাবস্থাতেই বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই জড়িয়ে পড়া ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে। এরকমই এক মহিলা বিপ্লবী ছিলেন লীলা নাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। লীলা ছিলেন সুভাষ চন্দ্রের খুব কাছের। পরে তিনিই তৈরি করেন দীপালি সংঘ।
উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় পড়তে এলেন প্রীতিলতা। দর্শন নিয়ে ভর্তি হলেন বেথুন কলেজে। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল সূর্য সেনের। প্রীতিলতা ডাকতেন ‘মাস্টার দা’ বলে। এভাবেই সূর্য সেনের দলে যোগ দেওয়া তাঁর।

১৯৩০ এর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় প্রীতিলতার বয়স কুড়ি। গান্ধীর অহিংস নীতি তখনও চট্টগ্রামের যুবশক্তিতে ভরপুর বাস্তববাদী বাঙালি হৃদয়ে আঁচড় কাটতে পারে নি। সূর্য সেন, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, অম্বিকা চক্রবর্তী, আনন্দ প্রসাদ গুপ্ত, ত্রিপুরা সেন, কল্পনা দত্ত, হিমাংশু সেন, বিনোদ বিহারী চৌধুরী, সুবোধ রায় এবং মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে প্রীতিলতা এবং দলের অন্যান্যরা ঠিক করলেন ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুট করবেন তাঁরা, টেলিফোন আর টেলিগ্রাফ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। অখন্ড ভারতকে পুনরায় ক্রর বিদেশি আক্রমনকারীদের হাত থেকে পরাধীন করবেন। অস্ত্রাগার লুট করতে যদিও সফল হননি তাঁরা, তবে টেলিফোন আর টেলিগ্রাফের সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা গেছিল।

দলের অনেকেই গ্রেফতার হলেন। প্রীতিলতা আর দলের অন্য কয়েকজন সদস্য পালাতে সফল হলেন। তারা ব্রিটিশ শাসকদের বুকে এক অপরিসীম ভয় সংচার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পরবর্তী ঘটনা অগ্নিযুগের ইতিহাসের একটি বিশেষ স্মরনীয় অধ্যায়- বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে পাহাড়তলীর ইওরোপীয়ান ক্লাব আক্রমন।
মাস পাঁচেক পর সুর্য সেনের ভাবনা মতোই পাহারতলীর ইওরোপিয়ান ক্লাব হামলার পরিকল্পনা ছিল। সেই দলের প্রধান ছিলেন প্রীতিলতা। ইওরোপিয়ান ক্লাবের বাইরে তখন গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকত “ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ান্স আর নট অ্যালাউড”।

১৯৩২ সাল। ২৪ সেপ্টেম্বর।
বিদায় নেবার আগে মাস্টারদাকে প্রণাম করে ভাবাবেগে বললেন প্রীতিলতা, “মাস্টারদা জন্মের মত যাই। আশীর্বাদ করুন আপনার ইচ্ছার পূর্ণতা সম্পাদনে আমি যেন অযোগ্য না হই”।
রাত তখন দশটা। ক্লাবের ভেতরে প্রচুর শ্বেতাঙ্গ নর- নারী তখন নাচ গান এবং পানাহারে নিয়ে মত্ত। এমন সময় পুরো ঘর কেঁপে উঠল প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দে- বুম্ ম্ ম্ ম্। সেই সঙ্গে বেপরোয়া গুলি বর্ষন- দ্রাম! দ্রাম! দ্রাম! এমনি করেই তোমারা একদিন নিরপরাধ ভারতবাসীর বুকের রক্তে জালিয়ানওয়ালাবাগের মাটি ভিজিয়ে দিয়েছিলে। আজ তাকিয়ে দেখ শিবাজী- রানা প্রতাপের বংশধর ভারতবাসী তার প্রতিশোধ নিতে জানে কিনা! তাও আবার একজন নারীর নেতৃত্বে। যে যুগে ইউরোপীয় মহিলারা তাদের পুরুষদের দাসত্ব করছে, সে যুগেই এদেশের মানুষেরা শক্তিকে দেবী রূপে আরাধনা করছে। কিন্তু ভাগ্যের এমন নিঠুর পরিহাস যে এযুগে এসে “সুরক্ষিত নারী সুরক্ষিত বাংলা” স্লোগান দিতে হচ্ছে। যাই হোক, আবার ফিরে আসা যাক চট্টগ্রামের সেই ক্লাবঘরে যেখানে স্বয়ং দেবী দুর্গা নিজের মানবরূপে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মাধ্যমে প্রকটিত হয়েছেন। কিন্তু ততক্ষণে ব্রিটিশরা পুরো জায়গাটা ঘিরে ফেলেছে এবং পোট্যাশিয়াম সায়েনাইডও ভারতমাতার আরও একজন বীর সন্তানকে অমরত্ব দান করেছে। সেদিন হয়তো ভারত স্বাধীন হয় নি কিন্তু চট্টগ্রামের দামাল যুবশক্তির রক্ত বিপ্লবের মাটিকে বহুগুণে উর্বর করে তুলেছিল।

” মাগো, তুমি আমায় ডাকছিলে? আমার মনে হল তুমি আমার শিয়রে বসে কেবলি আমার নাম ধরে ডাকছো, আর তোমার অশ্রুজলে আমার বক্ষ ভেসে যাচ্ছে। মা, সত্যিই কি তুমি এত কাঁদছ? আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না- তুমি আমায় ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেলে….” – প্রীতিলতার অন্তীম চিঠির প্রথমাংশ।

ময়ূখ দেবনাথ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.