ঋতম বাংলার প্রতিবেদন ২০ শে সেপ্টেম্বর। স্বাভিমানী স্বাবলম্বী চাষী ছাড়া দেশ কৃষিতে আত্মনির্ভর হতে পারে না। অনেক গবেষক কেবল পেপার তৈরি করেন, কৃষক কী পেলেন তার খোঁজ রাখেন না, বেতন নিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে কৃষক বীজ কিনে ঠকে যাচ্ছেন, আত্মহত্যা করছেন। কৃষকের একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, কৃষি থেকে লাভ হয় না। যাদের অন্য কোনো উপায় নেই তারাই একমাত্র কৃষিকাজ করেন। চাষের প্রতি বিশ্বাসই চলে গেছে। গ্রামে যারা থাকেন কৃষির সঙ্গে অন্য ব্যবসা না করলে পেট চলবে না। পরিযায়ী শ্রমিকের বেশীরভাগই কৃষকের ছেলে, কৃষিকাজে পয়সা নেই বলেই দূর পাহাড়ে শ্রমিকের কাজ করতে চলে গেছেন দিনে তিন-চারশো টাকা আয় করতে, তারাই সব ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিক। এরাজ্যের কৃষকের ছোটো জমি, কৃষিতে বিকল্পের কথা ভাবতে হবে। বিশ্বাস করাতে হবে কৃষি থেকে জীবন জীবিকা সম্ভব। নতুন প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ দিয়ে, আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের মনে কৃষির প্রতি বিশ্বাস জাগাতে হবে। এদিন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী অধ্যাপক ও গবেষক সঙ্ঘের ওয়েবিনার মঞ্চে বক্তব্য রাখেন বিজেপি সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির সভাপতি শ্রী দিলীপ ঘোষ (Dilip Ghosh)। ঋতম বাংলা ছিল এই অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার।
দিলীপ বাবু বলেন, বাংলার গ্রামেগঞ্জে ঘুরেছি, কৃষকের বাড়িতে থেকেছি; তারা চাল ছাইতে পারে না, মেয়ের বিয়ে দিতে পারে না, কৃষিতে অসংখ্য বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। কখনও পঙ্গপাল, কখনও বৃষ্টিহীনতা, কখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিষান বীমা, মাটি পরীক্ষার সুফলও ঠিক মতো পৌঁছায় নি। মালদার আমচাষীদের আগের থেকে কোনো উন্নতি হয় নি। প্রশাসনিক আধিকারিকরাও সিরিয়াস নন, যাকে তাকে ডেকে বীজ বিলি করে দেন, চাষীরা বাদামের বীজ ভেজে খেয়ে নেন। মমতা ব্যানার্জী একসময় ট্রাক ধর্মঘট করিয়ে আলু বাইরে পাঠাতে দেন নি, ট্রাকেই পচতে দিয়েছিলেন শত শত টন আলু। ট্রাকগুলো যে রাজ্যে আলু নিয়ে যাচ্ছিল, তারা দেখেছিল প্রয়োজনে যদি এ রাজ্য থেকে আলু না পাওয়া যায়, তবে অর্ডার কেন দেবে এ রাজ্যকে? এভাবে প্রায় পাঁচ-ছয় লক্ষ টন আলুর বাজার হারিয়েছে এ রাজ্য।
বাংলার চাষী চাষ নিয়ে ব্যস্ত, মার্কেট বোঝেন না। একদম শিশুর মতো তারা। এবার আলুর দাম বেশি। নির্বাচনের খরচ তুলতে ওরা হিমঘরে পর্যাপ্ত আলু রেখে দাম বাড়াতে দিয়েছে। চাষীর আলু যখন মাঠে উঠেছিল দাম পান নি। আলুর বাজার চড়া দেখে, সবাই অনেক জমিতে এ বছর ব্যাপক আলু চাষ করবেন, আবারও ক্ষতির স্বীকার হবেন তারা, দাম পাবেন না। অনেক সময় হাটে গিয়ে দেখা যায় দশ টাকা এক বস্তা আলুর দাম, কেবল বস্তার দাম টুকু। ক্ষতিগ্রস্ত চাষী নিজের পণ্য বিক্রি করতে বাজারের আবর্জনার মতো ঢেলে চলে আসেন।
দিলীপ বাবু বলেন, বাংলার বহু উর্বরা জমি বাঁজা হয়ে পড়ে আছে শিল্প হবে বলে, শিল্পও হয় নি। হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় এরকম বহু জমি দেখতে পাওয়া যায়। চাষে লাভ নেই বলেই চাষী বিক্রি করেছেন। সরকার ধানের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করে, তার সুযোগ সবসময় চাষী পান না। বিডিও অফিসে লম্বা লাইন, সারাদিন দাঁড়ানোর পর গরীব কৃষকদের বলা হয়, আজ হবে না। ধান বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয়, হয়রানির শিকার হন তারা, ফড়েদের কাছে কমদামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। অনেক চাষীর নিজের নামে অ্যাকাউন্ট নেই, ফলস্ অ্যাকাউন্ট, এভাবেই চলছে। চালকলগুলি চাষীদের কাছ থেকে সরাসরি চাল কিনতে পারে না, কিন্তু দালালদের কাছ থেকে কেনে। এই দালাল আর কিছু সরকারি কর্মীরা চায় না কৃষকের উন্নতি হোক। গ্রাম থেকে তাই কৃষক শহরে চলে আসছেন। শহরে বস্তির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, সেখানে নানান সামাজিক সমস্যা। গ্রামের মানুষ শহরে রিকশা টানবেন, তবুও চাষ করতে চাইছেন না। গ্রামের কৃষক নতুন প্রযুক্তির সুযোগ নিতে পারে না, বুঝেও উঠতে পারে না সবকিছু। তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে।
দরকার হল ছোটো জমির মালিক কীভাবে স্বাবলম্বী হবে, তা নির্ধারণ করা। উপকূলবর্তী এলাকায় নারকেল, সুপারির বাগান করা যেতে পারে। যেকোনো জাত নয়, উচ্চফলনশীল এবং তাতে উপযুক্ত পরিচর্যা। ড্রাগন ফ্রুট বাণিজ্যিক সাফল্য পায় নি। এ রাজ্যে ফলের উৎপাদন ও যোগানে টানাটানি আছে, দুধের অভাব আছে। শহরে যে দুধ আমরা খাই, তা দুধ না অন্য কিছু, প্রশ্ন তোলেন তিনি৷ এই দুধ গুণমানে দুধ বলে পাশ করতে পারে নি। যে গরু এখানকার আবহাওয়ায় টিকবে, তা পালন করতে হবে। ছাগল, হাঁস-মুরগী পালবের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে, তা লাভজনক।
এদিনের আলোচনা সভার মূল বিষয় ছিল আত্মনির্ভর ভারত গঠনে কৃষিকাজের ভূমিকা’। আলোচনায় সূচক বক্তব্য রাখেন উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব উপাচার্য অধ্যাপক সুনীল কুমার ব্রহ্মচারী। তিনি আলোচনার পরিসরে বলেন, কৃষকদের সুস্বাস্থ্য, সুশান্ত মন নিয়ে কাজের সুযোগ দিতে হবে, যাতে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থা সঠিক পথে থাকে। তিনি সুসংহত কৃষি-পশু-মৎস্য চাষের সমন্বিত প্রক্রিয়ার উপর জোর দেন। কৃষিকে উপার্জনমুখী বহুমাত্রিক ও বহুমুখী করার কথা বলেন। জৈবকৃষির কথা বলেন, বলেন রপ্তানিমুখী কৃষির কথা, কৃষি নির্ভর শিল্পের কথা। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক গৌতম সাহা।