বঙ্গ , বাঙ্গালা , বাঙ্গালী

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;

তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি

।অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ

মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;

-কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!

বঙ্গ….  বঙ্গ শব্দের অর্থ কি ? কেন বাঙ্গালী ? বঙ্গ শব্দের অর্থ হলো #কার্পাসতুলো । #আল সংস্কৃত শব্দের মানে হল #সমৃদ্ধ….. অর্থাৎ বাঙ্গাল শব্দের অর্থ হলো #কার্পাসতুলোসমৃদ্ধঅঞ্চল ।অনেকে এরকম মনে করেন যে অস্ট্রিক ভাষা শব্দ #বোঙ্গা থেকে বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি । আবার তামিল ভাষায় বঙ্গ মানে #সুতিবস্ত্র । বস্ত্র ব্যবসায়ীরা বঙ্গ বলতে বোঝেন #তাঁত। তামিল শব্দটির সংস্কৃত রূপ দ্রাবিড়। আর এস মুগালি “কন্নড় সাহিত্যের ইতিহাস” গ্রন্থে লিখেছেন ” দ্রাবিড় কথাটি তামিল কথারই সংস্কৃত রূপ”….

  হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ” বঙ্গীয় শব্দকোষ” গ্রন্থে বঙ্গ শব্দের অর্থ নির্ণয় প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন :
১. রঙ্গ, রাং, টিন ২. কার্পাস ৩. বেগুন গাছ ৪.বঙ্গদেশ 
মহাভারতে রাজা বলি …. তাঁর পাঁচ পুত্র ছিলেন। তার মধ্যে এক পুত্র হলেন বঙ্গ। বঙ্গের অধিকার স্থিত দেশ বঙ্গদেশ। তিব্বতীয় #bans শব্দের অর্থ হলো জলময়, স্যাঁতস্যাঁতে। যার সঙ্গে বঙ্গের সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। বঙ্গদেশ ছিল নদী বহুল ও জল বিধৌত। আমরা সে তথ্যঃ রঘুবংশেও পাই।
 রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তার “বাঙ্গালার ইতিহাস” গ্রন্থে লিখেছিলেন “বঙ্গ রাজ্য সমুদ্র তীরস্থ”।
 সুতরাং উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয়-  বঙ্গ শব্দের সঙ্গে কৃষি, বীরত্ব এবং জল এই তিনটি বিষয় নানাভাবে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে । 


নীহাররঞ্জন রায় “বাঙ্গালীর ইতিহাস” গ্রন্থে বলেছেন –  বঙ্গ শব্দের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় #ঐতেরয়_আরণ্যকে। 
বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদাঃ।
এছাড়াও রামায়ণ-মহাভারতে #বঙ্গ এর উল্লেখ রয়েছে ।
১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপালের স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরে “বঙ্গাল অধিপতি” বলে একটি শব্দ পাওয়া গিয়েছে। উক্ত সকল কারনে তাই বঙ্গবাসী বাঙ্গালী।  ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময়কাল হতে বঙ্গাল,বাঙ্গালী  অপভ্রংশ হয়ে হয় বাংলা বা বঙ্গালাহ।
 এই সেই বাংলা বা বঙ্গাল যেখানে প্রথম ধান পাওয়া যায় । খ্রীস্টপূর্ব ৩৫০০ সময়কাল… বর্তমান বিহারের সারন জেলার চিরন্দতের। পরেশ চন্দ্র দাশগুপ্তের “এক্সক্যাভেশন ইন পাণ্ডুরাজাস ঢিবি” গ্রন্থে তার সাক্ষ্য মেলে। 
বাঙ্গালী বা বাঙালী বীর এবং বণিক জাতি। শুধু কৃষি নয় কুটির ও গ্রামীণ শিল্পসহ স্বর্ণ , বস্ত্র শিল্পে দক্ষ এক জাতি ।পৃথিবীতে তুলোর পোশাকের অগ্রদূত প্রাচীন বঙ্গবাসী। সমুদ্রযাত্রার অসামান্য পারদর্শী ।আমরা নীহাররঞ্জন রায় থেকে শুরু করে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকটি ঐতিহাসিকের বাঙ্গালীর ইতিহাসে সে কথা জানতে পারি । রামায়ণ, মহাভারত, রঘুবংশ, চাণক্য,  ওভিদের রচনা,  গ্রীক ঐতিহাসিক প্লিনির বিবরন, মেগাস্থিনিসের বিবরণ তার সাক্ষ্য বহন করে চলে। মহাপদ্মবংশ উল্লিখিত বাংলার #সিংহগড়ের (সিঙ্গুর ) সন্তান বীর বিজয় সিংহের লঙ্কা বিজয় ও লঙ্কার নাম সিংহল হওয়ার  ঘটনা রয়েছে ।শুশুনিয়া লিপিতে মেলে সে ইতিহাস। 

 মহাভারতের রাজা বলি পাঁচ পুত্র : অঙ্গ, বঙ্গ, সুব্হ্ম, সমতট, পৌন্ড্র। বলি রাজার মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভেপাঁচ পুত্রের জন্ম হয় । তাদের নামে পাঁচটি রাজ্য । মহাভারতে বলা হয়েছে:
অঙ্গবঙ্গঃ কলিঙ্গশ্চ পুণ্ড্রঃ  সুব্হ্ম তে সুতাঃ।তেষাঃ দেশাঃ সমাখ্যাতাঃ স্বনামনা কথিতা ভুবি।।
 রামায়ণে দশরথের প্রিয় বন্ধু ছিলেন অঙ্গরাজ্যের  রাজা।মহাভারতে  কর্ণ  ছিলেন অঙ্গরাজ। মহাভারতের পৌন্ড্ররাজ বাসুদেবের কথা রয়েছে, ইনি কৌরব পক্ষে ছিলেন। চেদি রাজ ছিলেন শিশুপাল। মহাভারতে অনুযায়ী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় পৌন্ড্রবর্ধনের রাজা ছিলেন পৌন্ড্র বাসুদেব,  কৌশিকগুচ্ছে মহৌজা, বঙ্গে সমুদ্রসেন রাজত্ব করেছিলেন।
খনা বলে শোনভাই
তুলায় তুলা অধিক পাই।

ঘন সরিষা পাতলা রাই
নেংগে নেংগে কার্পাস পাই।
ষোল চাষে মূলা, তার অর্ধেক তুলা
তার অর্ধেক ধান, তার অর্ধেক পান,
খনার বচন, মিথ্যা হয় না কদাচন।


মানুষের প্রাথমিক চাহিদা হল খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান। এই চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে সেই প্রাচীনকাল থেকে… তাই আমাদের প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এখন অবধি ভারতীয় সাহিত্য গুলি লক্ষ্য করলে ভারতবর্ষে সাধারণভাবে প্রচলিত সামগ্রী পাশাপাশি খাদ্য , পরিধেয় বস্ত্র অলংকার এর বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে পরিধেয় অর্থাৎ পোশাক-পরিচ্ছদ অনেকটাই নির্ভর করত সেই অঞ্চলের জলবায়ু ও প্রকৃতির উপর । প্রকৃতির তারতম্যের জন্য নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষ এক রকম পোশাক পরতে আবার শীত প্রধান অঞ্চলের মানুষ অন্য রকম পোশাক পরিধান করতেন ।
একটা সময় পর্যন্ত চরকাই প্রাচীন হিন্দু জাতির বস্ত্র যোগান দিত। তখন কল-কারখানা বা অন্য কোনো বিপুলায়তন যন্ত্রের প্রচলন ছিল, এরূপ মনে করা যায় না। কিন্তু কত পূর্ব কাল হতে যে চরকা এদেশে বস্ত্রদান করিয়া আসিতেছিল তাঁহা নিশ্চিতরূপে নির্ণয় করা কঠিন । যতদিন থেকে হিন্দুগণ বস্ত্র ব্যবহার করে আসছেন, ততদিন হতেই চরকার সৃষ্টি হয়েছিল বলে অনুমান করা যেতে পারে। 
আর অতি সুদুরকাল হতে অখন্ড ভারতবাসী তাঁদের সভ্যতায় সমুন্নত ছিলেন এবং সভ্যজনোচিত বসনাদি ব্যবহার করতেন, তা সুনিশ্চিতরূপে বলা যায়। সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা যে কতকাল আগের , তা বারংবার উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। পুরাণাদির সাক্ষ্য গ্রহণ করলে সেকালের সীমা নির্ণয় হয় না ; বর্তমান কালের ঐতিহাসিকদিগের বিবেচনাতেও উহা বিংশ, ত্রিংশ বা পঞ্চাশং শতাব্দী খ্ৰীষ্ট-পূৰ্ব্ব যুগে  গিয়ে পড়ে। সেই অতিপ্রাচীন কাল হতেই যে বয়নশিল্প ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, এবং  ভারতীয় সভ্যতার পরিচ্ছদ জোগাত, তাতে সন্দেহ নেই। 
ঋগ্বেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ তা মহাপন্ডিতগন স্বীকার করেছেন । বেদে ধর্মনীতি হতে সমাজনীতি, রাজনীতি আদি বস্তুবিষয়ের মৌলিক তত্ত্ব নিহিত আছে। তৎকালে  হিন্দুদের সামাজিক গঠন, শিল্প-নৈপুণ্য প্রভৃতি কিরূপ ছিল, বৈদিক গ্রন্থে তার আভাস পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের সূক্তসমূহ যে সময়ে প্রচলিত হয়, মানবইতিহাসের সেই প্রাচীনতম যুগে, হিন্দু পূর্বপুরুষগণ বয়ন-শিল্প সবিশেষ অবগত ছিলেন ; এবং সভ্যজনোচিত .বেশভূষাদি পরিধান করতেন। বিবিধ মন্ত্র হতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

উষ্ণনীয় শব্দটির অর্থ হল মস্তকের ভূষণ বা বসন । বৈদিক গ্রন্থে এর বহুল উল্লেখ আছে— বিজ্ঞানং বাসোহরূনষণীয়ং ; ( অথর্ব ১৫,১৫ )… এছাড়াও মৈত্রেয় সংহিতা (৪।৪৩ ), কঠক সংহিতা (১৩১- ) ঐতরেয়  (৬১), শতপথব্রাহ্মণ ( ৩৩২৩ ) প্রভৃতি আরও অনেক স্থলে এর দৃষ্টান্ত আছে। 
‘পরিধান’ শব্দের অর্থ সাধারণ কাপড় বা ধুতি ; “নোবি’র অর্থ ভিতরে পরিবার বস্ত্র, ন্যাগট-বিশেষ ; “অধিবাস” অর্থে উপরে গায়ে দেবার কাপড়-ওড়না বুঝায়। বৈদিক মন্ত্রে এদের উল্লেখ আছে— 
 বত্তে বাসঃ পরিধানং যাং নোবিং কৃণুষে জন্ম। শিবং তনবে তৎকৃন্মঃ সংস্পর্শে দ্রম্ভমন্তুতে ॥ (खर्षर्वि-४२॥१७ ) —যেই বস্ত্র তোমার ধুতিরূপে পরিধান করিয়াছ, যাহা তার নীচে পরিয়াছ, তাহা তোমার শরীরের পক্ষে উত্তম শোভাদায়ক হইয়াছে, আর উহাতে তোমার শরীরে স্বল্পর্শ করিবে মাত্র। 
আবার, অধিবাসং পরিমাতুরিহন্নহং (ঋগ্বেদ) -ইহা মাতার উপরে-পরিবার (উড়নী ) বস্ত্র।
 যজ্ঞোপবীত বা পৈতা ধারণের যে সংস্কার এবং পৈতার গঠনতন্ত্র সম্পর্কে যে শাস্ত্রনির্দেশ সেই দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।।”কার্পাসমুপবীতং স্যাদ্বিপ্রস্যোর্দ্ধবৃতং ত্রিবৃৎ।শণসূত্রময়ং রাজ্ঞো বৈশ্যস্যাবিকসৌত ্রিকম্।।”অর্থাৎঃ কার্পাসের তিনটি সূত্র দুই করতলমধ্যে ধারণ করত দক্ষিণকর উর্দ্ধে ও বামকর নিম্নে চালনা দ্বারা যে সুত্র প্রস্থুত হয়, তাহাকে ঐরূপ হস্তমধ্যে ধারণপূর্বক বামকর উর্দ্ধে ও দক্ষিণকর নিম্নে চালনা করিলে যে সুত্র প্রস্তুত হয় তাহাকে তিনবার গ্রন্থী বন্ধন করিলে যজ্ঞপবিত হয়।।
রাঢ়বঙ্গ নাতিশীতোষ্ণ এখানকার মানুষ তাই হালকা পোশাক পরিধান করতেন। যেমন পুরুষেরা পড়তেন ধুতি ,চাদর ,জামা উত্তরীয় এবং পাটের তৈরি মোটা কাপড়। আর নারীদের মধ্যে শাড়ি ছিল পরিধেয় ।


পূর্বাঞ্চলে কার্পাস দ্বারা তৈরি হতো মসলিন নামক এক ধরনের পরিধেয় । অভিজাত শ্রেণীর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ছিল। শ্রেণী ভেদে স্বতন্ত্র পরিধেয়র কথা জানা যায় । তবে সে নির্ভর করত অর্থনীতির উপর । দরিদ্র , সন্ন্যাসী মানুষেরা এক ধরনের পোশাক পরত অপরদিকে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা ব্যবহার করতেন আর এক রকমের পোশাক। জীবনযাপনের জন্য একটিমাত্র বস্ত্র ছিল সাধারণ মানুষের পরিধেয় ।লজ্জা নিবারণের জন্য সামান্যটুকু ব্যবহার করতেন। সাধারণ দরিদ্র মানুষের মধ্যে এক টুকরো কাপড় দিয়ে বানানো কৌপিন ,খুত্র প্রভৃতি পরিধানের চলছিল। এছাড়া শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে জীবনধারণের মান কত নিম্নস্তরের ছিল তা বোঝা যায় পাট ও শনের মোটা কাপড়, ধুকড়ি, খুত্র ইত্যাদি বস্ত্র পরিধানের দিকে তাকালে। এগুলোর মূল্য কম ছিল। 
বঙ্গের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় এখানে কার্পাস উৎপাদনের সঙ্গে প্রচুর পরিমানে পাট ও #শন উৎপাদন হত। শন থেকে মোটা জাতীয় স্বল্প মূল্য বস্ত্র ,দড়ি প্রস্তুত হত। শন হল বিছুটি জাতীয় গাছের মত একটি গাছ। যার তন্তু দিয়ে উক্ত দ্রব্য প্রস্তুত হত। পৌন্ড্রদেশের সাধারণ মানুষ এই সব শনের পোশাক ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। পুরীর মন্দিরে রথের দড়ি কেবলমাত্র পাট ও শন দিয়ে নির্মিত হত। এখনো দড়িতে পাট ও শন ছুঁইয়ে সেই নিয়ম রক্ষা করা হয়। 
কেতক দাসের মনসা মঙ্গল কাহিনীতে জীবন যুদ্ধে লড়াই করা চাঁদের মাধ্যমে আমরা দরিদ্র মানুষের পোশাক সম্পর্কে ধারণা করতে পারি।
তথা নানা দুঃখ পায়্যা চাঁদ সদাগর।অশেষ যন্ত্রনা পায়্যা আল্য নিজ ঘর।।মনসার মায়া সাধু এড়াইতে নারে।সাত ডিঙ্গা ডুবাইয়া সাধু আল্য ঘরে।।ছেঁড়া কানি পরিধান মলিনতা বেশে।সাত ডিঙ্গা ডুবাইয়া সাধু আল্য নিজ দেশে।।
কেতক দাসের চাঁদ ছেঁড়া কানি পড়ে ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছেন। অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর দিন কেটেছে।
কবি মানিকরাম লিখেছেন –
কৌপিন জুটিত নাই কপালের দোষনা জুটিত অন্নজল লঙ্ঘন দিবসে।।
যা হোক, এক সময় #শন ব্যাপারটি ছিল বেশ প্রয়োজনীয়। এখন শনের চাষ প্রায় লুপ্ত বাংলার কৃষি হতে। চাষীরা ভালো দাম পাননা। প্লাস্টিক জাত ব্যাগ, দড়ি ইত্যাদি বহুল ব্যবহারে বাঙ্গালী শনের দড়ি , শনের দড়ি টাঙানো শিকে ইত্যাদিকে ভুলেই গেছে। 
বাংলা শিল্পজাত দ্রব্যাদির কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় বস্ত্রশিল্পের কথা । বাংলার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি খ্রীষ্টের জন্মের বহু পূর্বে থেকে দেশে হতে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এইটি ছিল বাংলাযর প্রধান শিল্প। তার প্রমাণ পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে , Periplus of Erythrean sea নামক গ্রন্থে , আরব, চীন , ইতালিয় পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ।কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে :
বঙ্গদেশের অর্থাৎ বাঙ্গক দুকূল খুব নরম ও সাদা।পুন্ড্রদেশের অর্থাৎ পৌন্ড্রক দুকূল শ্যামবর্ণ এবং দেখতে অনেকটা মনির মত পেলব । সুবর্ণকুড্যদেশের অর্থাৎ কামরূপ দুকূল নবোদিত সূর্যের মতো ।ঐতিহাসিকদের মতে দুকূল বস্ত্র সূক্ষ্ম এবং ক্ষৌম বস্ত্র একটু মোটা ।

পত্রোর্ণ জাত বস্ত্র মগধ বা মাগধিকা ,সুবর্ণকুড্যদেশ বা কামরূপ, পুন্ড্রদেশ বা পৌন্ড্রকে  উৎপন্ন হত।পত্রোর্ণ জাত বস্ত্র হল এন্ডি বা মুগা বস্ত্র। পত্র হতে যার উর্না তাই পত্রোর্ণ জাত ।অমরকোষের মতে পত্রোর্ণ সাদা বা ধোয়া কৌষেয় বস্ত্র। টিকাকার পরিষ্কার বলছেন কীট বিশেষের জিহ্বার রস থেকে কোন বৃক্ষপত্রকে এই ধরনের উর্ণায়র রূপান্তরিত করে। উল্লেখ্য কৌটিল্যউক্ত অঞ্চল গুলিতে এখন খুব ভালো এন্ডি বা মুগা বস্ত্র উৎপন্ন হয় ,বিশেষ করে কামরূপ।
পুণ্ড্রদেশে কেবল দুকূল ও পত্রোর্ণ বস্ত্র উৎপাদন হতো তা নয় । মোটা ক্ষৌম বস্ত্রও উৎপাদিত হতো, কৌটিল্য সে কথাও উল্লেখ করেছেন । শ্রেষ্ঠ কার্পাস বস্ত্র উৎপন্ন হতো  মধুরা অর্থাৎ মাদুরা, অপরান্ত , কলিঙ্গ, কাশী, বঙ্গ, বৎস ও মহিষ জনপদে। 
বঙ্গীয় শ্বেতস্নিগ্ধ দুকূল যেরকম উৎপন্ন হতো তেমনি শ্রেষ্ঠ কার্পাসবস্ত্রেরও অন্যতম উৎপত্তিস্থল ছিল বঙ্গ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বঙ্গ ও পুণ্ড্র দেশে প্রাচীনকালে চার প্রকার বস্ত্রশিল্প ছিল – দুকূল, পত্রোর্ণ, ক্ষৌম ও কার্পাসিক।
প্রাচীন বাংলার সম্পদের কথা গ্রীক ঐতিহাসিকরা বারংবার উল্লেখ করে গিয়েছেন এ সমস্ত সম্পদ রপ্তানির উল্লেখ পাওয়া যায় Periplus গ্রন্থে। SCHOFF এর ইংরেজি অনুবাদ উল্লেখ করে আমাদের দেশের রপ্তানী দ্রব্যের খবর এবং বস্ত্রশিল্পের কথা । হিমালয় পার্বত্য কিরাত জাতিদের উল্লেখের পরেই সেই কথা বলা হয়েছে :
After these the course turns towards the east again and sailing with the ocean to the right and the shore remaining beyond to the left , the Ganges comes into view , and near it the very last land towards the east , Chryse . There is a river near it called the Ganges . Through this place are brought malabathrum and Gangetic spikend and pearls and muslins of the finest sorts which are called Gangetic . It is said that there are gold mines near these places and there is gold coin which is called caltis…
হেরি সে মেরি তইলা বাড়ী খসমে সমতুলা।সুকড় এসে রে কপাসু ফুটিলা।।তইলা বাড়ীর পাসেঁর জোহ্না বাড়ী উএলা।ফিটেলি অন্ধ্যারি রে আকাশ ফুলিআ।।
কার্পাসের সন্ধান আমরা চর্যাগীতি গ্রন্থ থেকেই পেয়ে যাই। এই গ্রন্থ সাধনার আনন্দ সংগীত । এর অনেক পদের অর্থ অবশ্য সুস্পষ্ট নয় ।তথাপি নানা রাগরাগিণীর এই গানগুলো সাধনার আনন্দ প্রকাশ করে থাকে এ কথা সহজেই বোঝা যায় ।
উপরক্ত পদটি কবি শবরপাদের রচিত। এর প্রথম দুই লাইনের তিব্বতি অনুবাদ হতে  সংস্কৃত অনুবাদ করেছিলেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয়-
মম উদ্যানবাটিকাং দৃষ্টা খসম সমতুল্যাম্।কার্পাসপুষ্পম্ প্রস্ফুটিতম্ অত্যর্থং ভবতি।।

বাড়ির বাগানে কার্পাসফুল ফুটেছে, দেখেই আনন্দ, যেন ঘরের চারপাশে উজ্জ্বল হল ,আকাশের অন্ধকার দূরীভূত হল। এই হতে উপলব্ধি করা যায় যে কার্পাসকে  ঠিক কতখানি মূল্য প্রদান করা হতো তদানীন্তন বঙ্গ।
শান্তিপাদের একটি পদে আছে –   তুলা ধুঁনি আঁসুরে আঁসু ।   আঁসু ধুনি ধুনি নিরবর সেসু ॥   তুলা ধুঁনি ধুঁনি সুনে আহারিউ ।   পুন লৈয়া অপনা চটারিউ ॥
      তুলা ধুন তা হতে তৈরি হচ্ছে আঁশ ।      আঁশ ধুনে ধুনে শেষ ॥      তুলা ধুনে ধুনে শুন্যে উড়াচ্ছি ।      পুনঃ লৈয়া আপনি ছড়াচ্ছি ॥ হয়তো এর কোনো গূঢ় অর্থ আছে। কিন্তু তুলা ধুনার জন্য যে এই বাস্তব চিত্র তাতে সন্দেহ নেই ।
কাহ্নপাদের একটি পদে আছে:
   তান্তি বিকণঅ ডোম্বী অবর ন চাংগেড়া
      ডম্বিনী বাঁশের তৈরি তাঁত বিক্রয় করছে।
সাধারণত ডম্বিনী রাই বোধয় বাঁশ দিয়ে তাঁত তৈরি করে বিক্রি করত। 
আর একটি পদের রচয়িতার নাম পাইতেছি। তন্ত্রীপাদ। তন্ত্রীপাদের বুৎপত্তিগত অর্থ হল, তাঁত-শিক্ষক অথবা তাঁতী-গুরু। এটাই বোধয় সেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পদ-রচয়িতার পূর্বতন বৃত্তি ছিল। পরে তিনি ‘সিদ্ধ” হন। 
চর্যাপদ গীতিকায় একমাত্র তন্ত্রীপার পদটিই খুঁজে পাওয়া যায় নি। এজন্য তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না। তন্ত্রীপাদের পদটি বৌদ্ধগানের খণ্ডিত অংশে থাকায় আমরা তা পাই না।  বৌদ্ধাগানের সংকলন ‘Buddist Mystic Songs’ গ্রন্থে বলা হয়েছে- “Tantripa is the author of the song no. 25. He was a disciple of Jalandharipa and afterwards of Kanhapa. In the ms. He is missing.” 
 তবে তন্ত্রীপাদের ২৫ নম্বর পদটির তিব্বতী অনুবাদ হতে প্ৰবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয় যে সংস্কৃত অনুবাদ করেছিলেন তার কিয়দংশ হতে অনুভব করা যায়, গীত ও সাধন-সংবদ্ধ সমস্ত রূপকটি গড়ে উঠেছিল বস্ত্রবয়নকে অবলম্বন করে।
কালপঞ্চকতন্ত্রং নির্মলং বস্ক্রিং বয়নং করোতি।অহং তন্ত্রী আত্মনঃ সূত্রম।আত্মনঃ সূত্রস্য লক্ষণং ন জ্ঞাতম ৷।সাৰ্দ্ধত্ৰিহস্তং বয়নগতিঃ প্ৰসরতি ত্ৰিধা।গগনং পূরণং ভবতি অনেন বস্ত্ৰবয়নেন ৷।
নির্ধন ব্ৰাহ্মণের গৃহে নারীরা যে তুলা ধুনে সূত কাটতেন তা কবি শুভাঙ্কের একটি প্রশস্তি শ্লোকে জানা যায়। শ্লোকটি সদুক্তিকর্ণামৃতের অন্তর্গত।
কার্পাসান্থি প্রচয়নিচিতা নির্ধনশ্রোত্রিয়াণাংযেষাং বাত্যা প্রবিততকুটীপ্রাঙ্গণান্তা বভূবুঃ।তৎসৌধানাংপরিসরভূবি ত্বৎপ্রাসাদাদিদানীংক্রীড়াযুদ্ধচ্ছিদুরযুবতীহারমুক্তাঃ পতন্তি।।
সে-সব দরিদ্র শ্রোত্রিয়দিকের ঝটিকাহত কুটিরের প্রাঙ্গণ কার্পাস বীজের দ্বারা আকীর্ণ ছিল, (হে মহারাজ), এখন তোমার কৃপায় সেখানকার সৌধাবলীর বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে যুবতীদের ক্রীড়াযুদ্ধে ছিন্নহারের মুক্তাসমূহ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে।
সমসাময়িক কালেই একজন অজ্ঞাতনামা কবি -বারাঙ্গনাদের সূক্ষ্ম বসনে উল্লেখ করেছেন সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থে ।
বাসঃ সূক্ষ্মং বপুষি ভুজযোঃ কাঞ্চনী চঙ্গদশ্রীর্‌মালাগর্ভঃ সুরভি মসৃনৈগর্ন্ধতৈলৈঃ শিখণ্ডঃ।কর্ণোত্তংসে নবশশিকলানির্মলং তালপত্রং।বেশং কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গবারাঙ্গনাম।।
 দেহে সূক্ষ্মবসন, ভুজবন্ধে সুবর্ণ অঙ্গদ (তাদা); গন্ধতৈলসিক্ত মসৃণ কেশদাম মাথার উপর শিখণ্ড বা চূড়ার মতো করে বাঁধা, তাতে আবার ফুলের মালা জড়ানো; কানে নবশশিকলার মতন নির্মল তালপত্রের কর্ণাভরণ —  এই বেশ কার না মন হরণ করে!
বিজয়সেনের দেওপাড়া-প্রশস্তিতে নানা প্রকার ক্ষৌমবস্ত্রের একটু ইঙ্গিত আছে। তৃতীয় বিগ্রহপালের আমগাছি-লিপিতে রত্নদ্যুতিখচিত অংশুক বস্ত্রের কথা উল্লিখিত হয়েছে। সূক্ষ্ম কার্পাস ও রেশম বস্ত্রের কথা তো নানাসূত্রেই পাওয়াই যাচ্ছে।  বঙ্গাল যে নানাপ্রকার সূক্ষ্ম বস্ত্রের জন্য ভারতবর্ষ ও ভারতবর্ষের বাহিরে সুবিখ্যাত ছিল, এ-কথা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও গ্রীক পেরিগ্লাস-গ্রন্থ হতে আরম্ভ করে আরব বণিক সুলেমান (নবম শতক), ভিনিসিয় মার্কো পোলো (ত্রয়োদশ শতক), চীন পরিব্রাজক মা-হুয়ান (পঞ্চদশ শতক) পর্যন্ত সকলেই বলেছেন। বস্তুত, অষ্টাদশশতক পর্যন্ত এই খ্যাতি অক্ষুণ্ণ ছিল। চতুর্দশ শতকে তীরভুক্তি বা তিরুহুতবাসী কবি শেখরাচার্য জ্যোতিরীশ্বর নানাপ্রকারের পট্টাম্বরের মধ্যে বাঙ্গলার মেঘ-উদুম্বর, গঙ্গাসাগর, গাঙ্গোর, লক্ষ্মীবিলাস, দ্বারবাসিনী এবং শীল্‌হটী পট্টাম্বরের উল্লেখ করেছেন। এগুলি বোধ হয় সমস্ত অলংকৃত পট্টবস্ত্র; কারণ এর পরই জ্যোতিরীশ্বর বলেছেন নির্ভূষণ বঙ্গাল বস্ত্রের কথা। 
কিন্তু ‘ক্ষৌম’ বা ‘কৌষেয়’, ‘দুকুল’ বা ‘পত্রোর্ণ’ বস্ত্র, অলংকৃত পট্টবস্ত্র বা কার্পাস বস্ত্র যাই হোক, সাধারণ দরিদ্র লোকদের এ-সব বস্ত্র পরবার সুযোগ ও সংগতি কিছুই ছিল না তা আমি পূর্বেই বলেছি; তারাই  মোটা নির্ভূষণ কার্পাস বস্ত্র বা পাট বা শনের বস্ত্র মাত্র, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাহা ছিন্ন ও জীর্ণ। 
কোনো একজন অজ্ঞাতনামা কবি সদুক্তিকর্ণামৃত গন্থে তাই তো বলেছেন ‘স্ফূটিত’ জীর্ণ বস্ত্র।  সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র শুধু মেয়েরাই বোধ হয় পরতেন; অনেকে নিজেরাই সে কাপড়ের সূতা কেটে পাকিয়ে নিতেন।
সমুদ্রতীরবর্তী গঙ্গা বিধৌত দেশ বঙ্গদেশ যেরকম তেজপাতা পিপল ইত্যাদি দ্বারা অর্থ আগমন ঘটেছে। তেমনি অর্থ আগমন ঘটেছে মুক্তার ব্যবসার মাধ্যমে। কিন্তু সর্বাপেক্ষা মূল্যবান রপ্তানি বস্তু গাঙ্গেয় সূক্ষ  কার্পাস বস্ত্র সম্ভার। যাকে বিদেশে বলা হত Gangetic Muslin ।

দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব
বাংলার সংস্কৃতি : লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.