তৃতীয় পর্ব

ছৌ নৃত্য আমাদের বঙ্গের হৃদয় জুড়ে অবস্থান করছে। সেই নৃত্য শিল্পের হৃদয় জুড়ে অবস্থান করছেন মা দুর্গা। তাই তো ছৌ নাচের প্রায় সকল পালায় মা দুর্গা থাকেন সর্বব্যাপী হিসাবে। পূর্ব পর্বগুলিতে আমি ছৌ নৃত্যের দুর্গা পালার – গনেশ বন্দনা পালা , শুম্ভ – নিশুম্ভ বধ পালা , মহিষাসুর বধ পালার কথা উল্লেখ করেছি। উল্লেখ করেছি যে পুরাণ ভিত্তিক পালা কাহিনী গুলি কিভাবে নিজ নিজ স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। এছাড়াও দুর্গা কথা নয় এমন পৌরানিক কথার পালা গুলিতেও মা দুর্গার উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখ্য হল কিরাত অর্জুন পালা। 

অজ্ঞাতবাসে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দেবাদিদেব মহাদেবের ধ্যান করে পাশুপতাস্ত্র লাভের নির্দেশ দেন। বনবাসকালে পাশুপত অস্ত্র লাভের নিমিত্ত অর্জুন কর্তৃক শিবের তপস্যা, অস্ত্র প্রদানের প্রাক্কালে অর্জুনের শক্তি পরীক্ষার জন্য কিরাতবেশী শিব ও অর্জুনের যুদ্ধ হয় একটি মৃত বন্য বরাহকে কেন্দ্র করে। সেই মহাভারত কাহিনীকেই গ্রহণ করা হয়েছে ছৌ নৃত্যের কিরাত অর্জুন পালায়। তবে সেই পালায় কাহিনী ও নৃত্য পরিবেশনে লোকায়ত সমাজের চিন্তা ভাবনা ও বিশ্বাস প্রভাব বিস্তার করেছে । তাই পালার নৃত্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে কাহিনীর বিন্যাসে, নৃত্যের আঙ্গিকে, চরিত্রের উপস্থাপনায় বিভিন্ন দল পৃথক পৃথক নীতি গ্রহণ করে এবং পরিবেশিত নাচের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ।

কোনো দল অর্জুনকে শিকারী হিসেবে প্রস্তুত করেন। তাঁর অঙ্গে থাকে শিকারীর সাজসজ্জা। আবার কোনো দল অর্জুনকে তপস্বী হিসেবে উপস্থিত করেন, যা প্রকৃত মহাভারতে লেখা আছে। পাশুপাত অস্ত্র লাভের আশায় অর্জুন পশুপতি ধ্যানমগ্ন। সেখানে অর্জুন তপস্বীর বেশ ধারণ করেছেন । অবশ্য তীর-ধনুক অর্জুনের সর্বক্ষণের সঙ্গী । অর্জুন শিকারি বা তপস্বী যাই হোক না কেন সর্বক্ষেত্রে তাঁর নৃত্যশৈলী উদ্দীপনাপূর্ণ এবং বীরত্বব্যঞ্জক হয়ে থাকে। 

 বরাহের নিমিত্ত কিরাতবেশী মহাদেব-এর সঙ্গে অর্জুনের প্রচন্ড যুদ্ধ প্রত্যেকটি দলের ছৌ নাচে প্রতিপাদ্য বিষয় । বরাহ শিকার করে এবং অর্জুনকে পরাস্ত করে কোন কোন দলের কিরাত কিরাতিনী মনের আনন্দ ও উল্লাস করেন তাঁদের নাচের মধ্যে । এই নাচের ধরন বা ভঙ্গীকে  অনেকেই #কিরাত নাচ বলে অভিহিত করে থাকেন । প্রায় সাঁওতালি নাচের ঢঙে শিল্পীদের এসময় নাচতে দেখতে পাওয়া যায়।  যদিও শিল্পীদের অঙ্গভঙ্গিতে এবং পদচারণায় সাঁওতালি নাচের প্রকৃত আঙ্গিক সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয় না । তবুও সানাইয়ের সুর মূর্ছনায় অনুরণিত হয় সাঁওতালি ঝুমুরের সুর…. মাদল ধামসা বাজে – 

উরর দাঘিন গেদা , দাঘিন গেদা , দাঘিন গেদা,

উরর গেদা গেড়েন, গেদা গেড়েন , উরর গেদা গেড়েন।

কিরাত কিরাতিনীর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই, পাশুপাত অস্ত্র হাতে শিবের আগমন ঘটে । সঙ্গে আসেন মা দুর্গা। পালার এই অংশে দুর্গা সিংহবাহিনী রূপে প্রবেশ করেন ।যদিও মূল মহাভারতে এই অংশে মা দুর্গার উল্লেখ নেই তবে এখানে দুর্গার আগমন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ।কারণ মহাভারতে এই অংশে দুর্গার উল্লেখ না থাকলেও সমগ্র মহাভারত জুড়ে তিনি ব্যাপৃতা হয়ে আছেন।

প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা।
বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদ্যৌ গোলকে রাগমণ্ডলে।
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ।
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।।
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা চ।
তুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈর্দেবৈশ্চ মুনিমানবৈঃ।
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভূব সর্ব্বতঃ সদা।।

দুর্গাপূজা আদি সন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, জগতে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আছে, পরমাত্মা কৃষ্ণ সৃষ্টির প্রথম কালে মহারাসমণ্ডলে এই আরাধনা করেন। তার পর ব্রহ্মা। মধু ও কৈটভ নামক দুই অসুরের হাত থেকে ত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে। তৃতীয় পূজা করেন শিব, ত্রিপুর নামে এক অসুরকে দমন করার নিমিত্ত। ত্রিপুর আসলে তিন রকমের – তারকাক্ষ, কমলাক্ষ ও বিদ্যুন্মালী। চতুর্থবার আরাধনা করেন দেবরাজ ইন্দ্র। লক্ষ্মীকে ফিরে পাওয়ার জন্য।

মহাভারতে দুর্গাপূজার কথা বিস্তৃতভাবে রয়েছে। কপট পাশা খেলায় শকুনির কাছে দ্বিতীয়বার পরাজিত হয়ে পাণ্ডবদের বারো বছর বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস হয়। অজ্ঞাতবাসের সময়টি ছিল বেশ কঠিন। কারণ, এই সময় পাণ্ডবরা দুর্যোধনাদি কৌরবদের কাছে ধরা পড়ে গেলে তাঁদের আবারও লুকিয়ে লুকিয়ে কাটাতে হবে। এমন করে তো অনন্তকাল চলতে পারে না। এই চক্র থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যুধিষ্ঠির দেবী দুর্গার শরণ নিলেন। অজ্ঞাতবাস বড় কঠিন সময়। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি আছে নানারকমের দুঃখ। সবচেয়ে বড় যেটা, তা হল – এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম, এই আশঙ্কা। দ্রৌপদীসহ পাণ্ডবরা যখন মৎস্যনগরে ঢুকছেন, তখন মনে মনে যুধিষ্ঠির ত্রিভুবনেশ্বরী দুর্গার স্তুতি করেছিলেন। 

যোগমায়াই দেবী দুর্গা – দিব্যমাল্যবিভূষিতা, দিব্যাম্বরধরা ও খড়্গখেটকধারিণী। তাঁর বর্ণ বালার্কসদৃশ, তাঁর আনন পূর্ণচন্দ্রনিভ এবং তিনি চতুর্ভূজা ও চতুর্ব্বক্ত্রা। আবার তিনি কৃষ্ণবর্ণা ও অষ্টভূজারূপেও পূজিতা হন। তাঁর আট হাতে রয়েছে – বর, অভয়, পানপাত্র, পঙ্কজ, ঘন্টা, পাশ, ধনু ও মহাচক্র। তাঁর কুণ্ডল দিব্য, মাথায় উৎকৃষ্ট কেশবন্ধ ও দিব্য মুকুট। বেণী কটিসূত্র পর্যন্ত লম্বিত। দেবী মহিষাসুরমর্দ্দিনী এবং বিন্ধ্যবাসিনী।

অজ্ঞাতবাসে যুধিষ্ঠির সেই দেবীকে স্মরণ করলেন এবং তাঁর শরণাপন্ন হলেন। যুধিষ্ঠিরের স্তবে তুষ্ট দেবী দুর্গা তাঁকে নির্বিঘ্নে অজ্ঞাতবাসের বর দান করে অন্তর্হিতা হলেন।

মহাভারতের বনপর্বে আছে, সকল প্রকার দুর্গতি থেকে তিনি উদ্ধার করেন বলে তাঁর নাম দুর্গা। তিনি আসলে ভগবতী। বিরাটপর্বে তিনি নন্দগোপকূলজাতা ও যশোদাগর্ভসম্ভূতা। কিন্তু শল্যপর্বে দেবী দুর্গা শৈলপুত্রী, হিমালয়ের কন্যা। মহাভারতের অন্যত্র তিনি মহাদেবের পত্নী। অনুশাসনপর্বের উমামহেশ্বর-সংবাদে সে কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে।

দেবী দুর্গার এই যে আরাধনা, তা শুধু সঙ্কটকালের জন্য। অজ্ঞাতবাসের কঠিন সময়ে যুধিষ্ঠির যেমন দুর্গার শরণ নিয়ে মুক্তি পেলেন, তেমনি আর এক কঠিন সময়ে অর্জুনকে আশ্রয় নিতে হল দেবীর। মহাভারত যাঁরা পড়েছেন বা দেখেছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই জানেন যে ভীষ্মপর্বের শুরুতে অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে এসে চারপাশে স্বজন-বান্ধবদের দেখে যুদ্ধ করতে চাননি। তার পর শ্রীকৃষ্ণ দীর্ঘ উপদেশ দেন অর্জুনকে। যুদ্ধক্ষেত্রে জন্ম হয় শ্রীমদ্ভগবৎগীতা নামক স্মৃতিপ্রস্থানের।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “তুমি দুর্গার স্তুতি করো”। রথ থেকে নেমে পড়লেন অর্জুন। কৃতাঞ্জলি হয়ে দেবীর স্তুতিগান করলেন। সেই স্তুতিতে দেবী দুর্গা সম্পর্কে জানা যায় – তিনি যোগীদের পরম সিদ্ধিদাত্রী, ব্রহ্মস্বরূপিণী, সৃষ্টি ও প্রলয়ের কারণ, জরামৃত্যুবিহীনা, ভদ্রকালী, বিজয়া, কল্যাণপ্রসূ, মুক্তিস্বরূপা, সাবিত্রী, কালরূপিণী, মোহিনী, কান্তিমতী, পরম সম্পৎ, শ্রী, হ্রী ও জননী। তিনি মহাশক্তি। অর্জুনের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী তাঁকে শত্রুজয়ের বর প্রদান করেন।

তাই কিরাত অর্জুন পালায় দশভূজা দুর্গার ন্যায় লৌকিক জীবনে মা দুর্গা সর্বত্র বিরাজমান। তিনি ব্রহ্মময়ী । তিনি মহাকালের মহাকালী ,তিনি কাল চক্রের পরিচালনা করছেন ।তিনি ভবের সংসারের সর্বশক্তি  ভবানী , তিনি শিবানী।

অর্জুন উপলব্ধি করতে পারেন কিরাত এবং কিরাতিনী অন্য কেউ নন , ছদ্মবেশী মহাকাল ও  মহাকালী। তাই অর্জুন সকাতরে প্রার্থনা জানায় – 

অর্জুন বলেন গুরু হল‍্য্যে দয়াবান।

পাশুপত অস্ত্র মোরে করো আজ দান।

মহাদেব তৃতীয় পাণ্ডবের বিরুদ্ধে সন্তুষ্ট হয়ে “পাশুপাত অস্ত্র ” দান করলেন । শিবের সঙ্গে ভবানীও তাঁকে আশীর্বাদ করলেন ।  সানাই, ঢোল , ধামসায় পরিণতির সুরতাল – 

উরর ডেন দা ঘেন তা , উরর গেদা গেড়েম তা।

শিবপুরাণের কাহিনী অবলম্বনে ” ধুঁ ধুঁরাসুর বধ” পালার নৃত্য পরিচালনা করা হয়েছে। পালার একেবারে সূচনায় শিবের সঙ্গে মা দুর্গাকে দেখা যায়। ত্রিপুরাসুর এবং ধুঁ ধুঁরাসুর দেবাদিদেবের কৃপা লাভের জন্য তপস্যা করেছিল। তাদের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবাদিদেব বরদান করেছিলেন । ছৌ নৃত্য পালায় দেখানো হয় শিবের সঙ্গে এলেন শিবানী।  পালায় কিছু সময় শিব এবং পার্বতী নৃত্য করতে দেখা যায় । পরে শিব ও ভক্তদের আশীর্বাদ করলেন। এক্ষেত্রে বলে রাখি যে , শিব ত্রিপুরাসুরকে বধের নিমিত্ত আদ্যাশক্তির উপাসনা করেন। সে কথা এই পর্বের প্রথামের দিকেই উল্লেখ করেছি।  তাছাড়া যেখানে ব্রহ্ম সেখানেই ব্রহ্মময়ী থাকবেন ,  এই ধারণাই লৌকিক চিন্তাভাবনাকে আরো সুন্দর ও প্রসারিত করে তুলেছে। শিব ও দুর্গার আসরে প্রবেশকালে – 

গুড় গুড় গেড়েন ধা , গেদা গেদা গেদা ধা

তাক তাক তাক তা’ – বোলে উল্লাস ভরে সানাই ,ঢোল ,ধামসা বাজতে থাকে। উক্ত পালায় শিবানী নিজে না থাকলেও মায়াবাদ কিন্তু বিস্তার হয়েই থাকে। 

“রাবণরাজা বধ ” পালার কাহিনীতেও অন্তিম লগ্নে মা দুর্গার আগমন ঘটে। রামায়ণে অবশ্যই নানা রূপে মহামায়া অবস্থান করে রয়েছেন। সর্বপোরি তিনি আদ্যা শক্তি মহামায়া মহালক্ষ্মী সীতা রূপে অবস্থান করছেন ।

রাজস্থানে জয়ী নিত্যং প্রসন্নাঃ সর্বদেবতা ।

 ওঁ হ্রীং ব্রহ্মাণী ব্রহ্মলোকে চ বৈকুণ্ঠে সর্বমঙ্গলা ॥ ইন্দ্রাণী অমরাবত্যামবিকা বরুণালয়ে।

 য়মালয়ে কালরূপা কুবেরভবনে শুভা ॥ মহানন্দাগ্নিকোনে চ বায়ব্যাং মৃগবাহিনী । 

নৈঋত্যাং রক্তদন্তা চ ঐশাণ্যাং শূলধারিণী ॥ 

 পাতালে বৈষ্ণবীরূপা সিংহলে দেবমোহিনী । 

সুরসা চ মণীদ্বিপে লঙ্কায়াং ভদ্রকালিকা ॥

 রামেশ্বরী সেতুবন্ধে বিমলা পুরুষোত্তমে । 

বিরজা ঔড্রদেশে চ কামাক্ষ্যা নীলপর্বতে॥

 কালিকা বঙ্গদেশে চ অয়োধ্যায়াং মহেশ্বরী । বারাণস্যামন্নপূর্ণা গয়াক্ষেত্রে গয়েশ্বরী ॥ 

কুরুক্ষেত্রে ভদ্রকালী ব্রজে কাত্যায়নী পরা ।

 দ্বারকায়াং মহামায়া মথুরায়াং মাহেশ্বরী ॥ 

ক্ষুধা ত্বং সর্বভূতানাং বেলা ত্বং সাগরস্য চ । 

নবমী শুক্লপক্ষস্য কৃষ্ণসৈকাদশী পরা ॥

 দক্ষসা দুহিতা দেবী দক্ষয়জ্ঞ বিনাশিনী ।

রামস্য জানকী ত্বং হি রাবণধ্বংসকারিণী ॥

তিনিই স্বয়ং বিজয়া । তিনি শুভা। তাই তিনি যাঁর পক্ষে থাকেন জয় তাঁর হয়। ছৌ নৃত্যে রামায়ণের রাবণ বধ পালা ঠিকঠাক রামায়ণকে অনুসরণ করে হয় না। সেখানে অনেক লৌকিকতার ছাপ থাকে। মা দুর্গা রামেরও, রাবণেরও। কিন্তু অন্যায়কারী রাবণকে তিনি ত্যাগ করেছেন। কৃত্তিবাসের রাম শরৎকালে দেবীর বোধন করেছেন। তাই রাবণ বধের পরে একটি বড় দেবী বিজয়লক্ষ্মী যদি শ্রীরামকে দর্শন না দেন তবে কি সাধারণ মানুষের মন মানে? 

পরিশেষে বলি, বাণরাজার পালা। ছৌ নাচের এই পালা হরিহর যুদ্ধের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়। উত্তর পূর্ব ভারতে এই হরহির যুদ্ধ নিয়ে বহু কিংবদন্তি আছে। ছৌ নাচের পালার কথা বলার পূর্বে একটু সেই পুরাকথা বলে নিচ্ছি। 

একসময় তেজপুরে বাণ নামক এক শিবভক্ত অসুর রাজা রাজত্ব করিতেন। বাণ রাজার কন্যা ঊষার সৌন্দর্য ছিল বিশ্ববিখ্যাত। সেইজন্য বাণ রাজা অগ্নিগড় নামক একটি অগ্নির দ্বারা আবৃত দুর্ভেদ্য দুর্গের ভিতরে ঊষাকে নিরাপদে রেখেছিলেন।

একদিন ঊষা স্বপ্নে এক সুদর্শন যুবককে দেখা পেয়ে প্রেমে পতিত হয়। প্রিয় সখী, চিত্রশিল্পী চিত্রলেখা ঊষার বর্ণনামতে রাজকুমার যুবকের চিত্র অঙ্কন করেন। অনুসন্ধান করে জানা যায় য়ে অঙ্কিত চিত্রটি বাণ রাজার শত্রু দ্বারকার রাজা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধ। চিত্রলেখার মাধ্যমে ঊষা ও অনিরুদ্ধ প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয় ও গন্ধর্ব প্রথামতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

বাণ রাজা ক্রোধে অনিরুদ্ধকে বন্দী করে। নাতিকে উদ্ধার করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। বাণ রাজাকে সাহায্য করার জন্য তাঁর ইষ্টদেব শিব বাণের পক্ষ হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কৃষ্ণসেনা ও শিবসেনার সহিত সংঘটিত এই অভুতপুর্ব ভয়ংকর যুদ্ধের ফলে ত্রিভুবন ত্রস্তমান হয়ে উঠে।কৃষ্ণ অর্থাৎ হরি ও শিব অর্থাৎ হর দুইজনের সহিত সংঘটিত এই যুদ্ধের নাম হরি-হর যুদ্ধ। অবশেষে যুদ্ধের প্রাবল্যে সৃষ্টি নাশ হওয়ার উপক্রম দেখে জগতের সকল মুনি,ঋষি ও দেবতার কাতর উপাসনায় দুই দেবতা শান্ত হয় ও যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। বাণ নিজের ভুল উপলদ্ধি করতে পেরে অনিরুদ্ধকে উদ্ধার করে।

লোকপ্রবাদ মতে হরি-হর যুদ্ধে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। কালক্রমে এই স্থান তেজপুর ও শোণিতপুর (অহমীয়া ভাষায় তেজপুর অর্থ রক্তের নগর) নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

মানভূম, পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্যে বাণরাজার পালায় উক্ত সকল তথ্য নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং সেখানে যুদ্ধ থামানোর নিমিত্ত দেবীর আবির্ভাব দেখানো হয়। দেবী আদ্যাশক্তি শিব ঘরণী পার্বতী। পার্বতী এসে সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করার প্রয়াস করেন।

          ত্রিধা চকার চাত্মানং স্বেচ্ছয়া প্রকৃতি স্বয়ং।

          মায়া বিদ্যা চ পরমেত্যেবং সা      ত্রিবিধাঽভবৎ॥

          মায়া বিমোহিনী পুংসাং যা সংসার-প্রবর্তিকা।

          পরিস্পন্দানিশক্তি র্যা পুংসাং যা পরমা মতা।

          তত্ত্বজ্ঞানাত্মিকা চৈব সা সংসার-নিবর্তিকা॥

অর্থাৎ, মূলপ্রকৃতি পরব্রহ্ম ভগবতী স্বয়ং স্বেচ্ছায় নিজ শক্তিকে মায়া, বিদ্যা এবং পরমা এই ত্রিবিধরূপে বিভক্ত করেন। ভগবতীর অবিদ্যারুপী মায়াশক্তি বিমোহিনী সংসার-প্রবর্তিকা শক্তি, ভগবতীর এই মায়া শক্তি সংসার বন্ধনের মূল । যে শক্তি পরিস্পন্দাদি ব্যাপার-বিধায়িনী চৈতন্যময়ী সঞ্জীবনী শক্তি সে ভগবতীর পরমা শক্তি । 

আর তত্ত্বজ্ঞানাত্মিকা সংসার-নিবর্তিকা শক্তি হলো ভগবতীর বিদ্যা শক্তি । ভগবতীর এই বিদ্যা শক্তি হলো সংসার হতে মুক্তির হেতু, শুদ্ধবিদ্যা …

যদ্যপি ভগবতীর অনির্বচনীয়া মায়া মুখ্যত ভববন্ধনকারিণী, তথাপি মায়া আত্যন্তিক ভাবে জড়  নয়। যোগবাশিষ্ঠের “চিদ্বিলাসঃ প্রপঞ্চোঽয়ং”, শ্রীশ্রীচণ্ডীর “চিতিরূপেণ যা কৃৎস্নমেতৎ ব্যাপ্য স্থিতা জগৎ” আদি বচনই তাঁর প্রমাণ। আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের অনেক শাখাও এই মত সমর্থন করেন। স্বতন্ত্রা পরাচিতিশক্তির চিদ্বিলাসই এই জগৎ প্রপঞ্চ মায়া । মায়ার মধ্যে মায়ার অধীশ্বরী পরব্রহ্মময়ী ভগবতী মহামায়ার প্রকাশকে প্রত্যক্ষ করলে, দুঃখময় জগৎকে আনন্দময়ীর লীলাক্ষেত্র রূপে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়।

ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্‌কারঃ স্বরাত্মিকা।

সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।।

অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ।

ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা।।

ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।

ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।।

বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে।

তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোঽস্য জগন্ময়ে।।

 তুমি হোম, শ্রাদ্ধ ও যজ্ঞে প্রযুজ্য স্বাহা, স্বধা ও বষট্‌কাররূপে মন্ত্রস্বরূপা এবং দেবভক্ষ্য সুধাও তুমি। হে নিত্যে! তুমি অক্ষর সমুদায়ে হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুত এই তিন প্রকার মাত্রাস্বরূপ হইয়া অবস্থান করিতেছ এবং যাহা বিশেষরূপে অনুচার্য ও অর্দ্ধমাত্রারূপে অবস্থিত, তাহাও তুমি। তুমিই সেই (বেদ সারভূতা) সাবিত্রী; হে দেবি! তুমিই আদি জননী। তোমা কর্তৃকই সমস্ত জগৎ ধৃত এবং তোমা কর্তৃকই জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে। তোমা কর্তৃকই এই জগৎ পালিত হইতেছে এবং তুমিই অন্তে ইহা ভক্ষণ (ধ্বংস) করিয়া থাক। হে জগদ্রূপে! তুমিই এই জগতের নানাপ্রকার নির্মাণকার্যে সৃষ্টিরূপা ও পালনকার্যে স্থিতিরূপা এবং অন্তে ইহার সংহার কার্যে তদ্রূপ সংহাররূপা।

তাই সুপ্রাচীন রাঢ়ের প্রাচীন মুখোশ নৃত্য ছৌ দুর্গাময় হয়ে উঠেছে।

#সমাপ্ত

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ পুরুলিয়ার ছৌ – ছো নৃত্যে দুর্গা : নিমাই ওঝা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.