কিভাবে 34 বছর ক্ষমতায় থাকলো জ্যোতি বাবুরা? শুধুই রিগিং? শুধুই মস্তিস্ক মস্তিস্ক প্রক্ষালন? শুধুই বিপ্লবের স্বপ্ন? নাকি স্ট্রাটেজি? নাকি অন্য কিছু? – দ্বিতীয় পর্ব 

1977 এ জ্যোতিবাবুরা রাজ্যে ক্ষমতায় আসে একটি দক্ষিণপন্থী দলের কাঁধে চড়ে যা আগেই বলেছি l জনতা পার্টিতে চারটি দলের মিলিত একটি দল l এরমধ্যে জনসংঘ এবং লোকদল একে অপরের বিরুদ্ধে ছিল l লোকদলের নেতা ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী চরণ সিং l মোরারজি দেশাইকে বিপদে ফেলতে চরণ সিং বারবার ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যে মামলা এবং কমিশন বানাতে থাকেন l প্রতিটি মামলা ইন্দিরা গান্ধীর গুরুত্ব বাড়াতে থাকল l 1977 এ ইন্দিরাকে পরাজিত করা লোকদলের নেতা রাজনারায়ণ গোপনে সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা শুরু করলেন  সরকার ফেলার জন্য l এরমধ্যে 1978 এ কংগ্রেস (আর ) থেকে বহিস্কৃত হলেন ইন্দিরা ও সঞ্জয় l কিন্তু চরণ সিং ও ইন্দিরা দুজনেই জানতেন জনসঙ্ঘ সরকার বাঁচিয়ে দেবে l জ্যোতি বসু পরিস্থিতির উপর নজর রাখছিলেন এবং সিপিআই এর সঙ্গে দূরত্ব কম করছিলেন l কারণ সিপিআই ছিল কংগ্রেস ( আর ) এর মতোই সোভিয়েত রাশিয়া পন্থী l 1979 তে মোরারজি পদত্যাগ করলেন l সরকার গড়লেন চরণ সিং এবং 21 দিন পর তার সরকারের থেকে সমর্থন তুলে নিলেন ইন্দিরা l 1980 তে ক্ষমতায় এলেন ইন্দিরা l জ্যোতিবসু বুঝলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টক্কর নিয়ে লাভ নেই l সিপিআইকে বামফ্রন্টএ আনা হল ইন্দিরা গান্ধীর আশীর্বাদ পেতে l 18 বছরের তিক্ততা কাটিয়ে এবং নখদন্তহীন হয়ে বামফ্রন্টে এল সিপিআই l কিন্তু এই ঘটনায়, ইন্দিরা গান্ধী এবং সোভিয়েত রাশিয়ার বিশ্বাস অর্জন করলেন জ্যোতি বসুরা l 1982 তে সেনাপতিহীন কংগ্রেস রাজ্যে লড়াই করলো বটে l কিন্তু আগের চেয়ে তাঁদের আসন কমে গেল l 52 থেকে 40 l

1982 তেই ইন্দিরা তাঁর দুই পুরোনো সেনাপতিকে ক্যাবিনেটে আনলেন, যারা বাংলা কংগ্রেস বানিয়ে 1967 তে প্রফুল্ল সেন ও অতুল্য ঘোষের হার নিশ্চিত করেছিলেন l অর্থদপ্তরে প্রণব এবং রেলে গনিখান l প্রচুর টাকা পেল রাজ্য l মেট্রো রেলসহ রেল প্রকল্পের বন্যা বইয়ে দিলেন গণিখান l রাজ্য কংগ্রেসে জোয়ার এলো l 1984 তে ইন্দিরা হত্যার পর সাধারণ নির্বাচনে  অশোক সেন, অজিত পাঁজা, ফুলরেণু গুহ, ভোলা সেন, তরুণকান্তি ঘোষের মত 16 জন লোকসভায় গেলেন l সবচেয়ে বড় আশ্চর্য বামদুর্গ দমদম ও যাদবপুরে আশুতোষ লাহা এবং মমতা ব্যানার্জীর জয় l রাজ্যের কংগ্রেস নেতা ও কর্মীরা 1987 তে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখা শুরু করল l 

কিন্তু গন্ডগোল পাকালেন নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী l তাঁর মাকে অনুসরণ করে তিনিও সিপিএম এর সঙ্গে গড়াপেটা চালিয়ে গেলেন l রাজ্যে কংগ্রেসকে দুর্বল করতে প্রণব ও গণিখানকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ রাখলেন l সিপিএম সেই সুযোগে দুটি প্রচার শুরু করলো l এক, রাজ্যে কংগ্রেসের কোন নেতা নেই যে জ্যোতিবাবুর মাপের l নাইলে তাঁদের মন্ত্রী করলেন না কেন রাজীব? অশোক সেনকে আইন মন্ত্রী করেছিলেন বটে রাজীব, কিন্তু তিনি জননেতা নন l প্রণব মুখার্জী নিজের দল বানালেন l প্রিয়রঞ্জনকে প্রদেশ সভাপতি করা হল l কিন্তু প্রিয় কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী l কলেজে অধ্যক্ষ হতে যেমন অধ্যাপক হবার অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, তেমনি মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হতে গেলে কেবিনেট মন্ত্রী হাওয়া প্রয়োজন বলে ভোটাররা মনে করল l লিখিত কোন নিয়ম যদিও নেই, কিন্তু মানুষ অনভিজ্ঞকে মানবে কেন? প্রিয়কে মেনে নিল না ভোটাররা l দুই, কংগ্রেস বাঙালী বিরোধী l

1987 বিধানসভায় কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী প্রিয়রঞ্জনের ইস্তেহারের মূলতঃ  তিনটি প্রস্তাব ছিল l

এক,  দুটাকা কিলো চাল দেয়া হবে l

দুই, প্রতিটি বন্ধ কারখানাকে  আবার চালু করা 

তিন, প্রাথমিকে ইংরেজি চালু করা হবে এবং শিক্ষাঙ্গনকে পুনরায় রাজনীতিমুক্ত করা হবে 

জ্যোতি বাবু ও তাঁর দুর্দান্ত পার্টি নেটওয়ার্ক এই তিনটি প্রস্তাবকে যে ভাবে নস্যাৎ করে মূল্যহীন করে ভোটে জিতলেন, তাতে পশ্চিমবঙ্গকে  নির্বাচনী রাজনীতির ইতিহাসের হস্তিনাপুরের মর্যাদা দিতে পারেন ঐতিহাসিকরা l তারা যুক্তি দিলেন :

এক, প্রিয় দুই টাকার চাল বড়লোকদের দিলে গরিব চাষী না খেয়ে মরবে l তারা 50 পয়সাও পাবে না l প্রলিতারিয়েট পশ্চিমবঙ্গে বুর্জোয়াতন্ত্রের পুনরাবির্ভাব l সংগঠনের প্রচারে, এই ন্যারেটিভ কৃষকরা বিশ্বাস করে l 

দুই, কারখানা খোলার ব্যাপারে প্রিয় এতো আত্মবিশ্বাসী কারণ সে পুঁজিপতিদের দালাল l শ্রমিকনেতাদের এই কুযুক্তি সেযুগের শ্রমিকসমাজ বিশ্বাস করে নেয় l

তিন, প্ৰিয় ইংরেজি আবার ফিরিয়ে আনতে চায়, যাতে গরিবের ছেলেমেয়েরা ফেল করে পড়াশুনা ছেড়ে দেয় l দুঃখের বিষয়ে, এই যুক্তিও গরিব মানুষ বিশ্বাস করে নেয় l

এদিকে, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে প্রণব মুখার্জীর নতুন দল রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নিজেরা কিছু না করতে পারুক, কংগ্রেসকে বাঙালী বিরোধী প্রমান করে ছেড়েছে ওই নির্বাচনের আগে l 1978 এ ইন্দিরা গান্ধীকে কংগ্রেস (আর ) থেকে বহিষ্কারের সময় করার সময় তাঁর করা এক মন্তব্য l প্রিয়রঞ্জনকে নিয়ে ‘কাঁচের ঘর’ নাটক লিখে মঞ্চস্থ করলেন উৎপল দত্ত l দেখানো হল রাজ্যের সব বিধানসভা কেন্দ্রে l সেই নাটকে তিনি নিজে প্রিয়ারঞ্জনের ভূমিকায় অভিনয় করলেন l নাটকের উপসংহারে উৎপল দত্ত বাঙালীকে বললেন, ‘দয়া করে নিজের কুকুরের নামও প্রিয় রাখবেন না l সে বেইমানি করবে’ l প্রসঙ্গত, সত্তরের দশকে প্রিয় যুবকংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি হলেও জরুরি অবস্থার সময় সমালোচনা করেছিলেন ইন্দিরা এবং সঞ্জয়ের l ভবিষ্যতে কংগ্রেস ই তে যোগদানের পরেও  কোনদিন অস্বীকারও করেন নি এবং এর জন্য ক্ষমাও চাননি l কিন্তু জরুরি অবস্থা সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গুলিহেলনে হয়েছিল l প্রতিটি বানপন্থী একে সমর্থন করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে l আর সেইজন্যই বামপন্থীরা প্রিয়রঞ্জনের প্রতি বরাবর খড়্গহস্ত ছিল, যা প্রণব, সোমেন, সুব্রতদের উপর ছিল না l নির্বাচনে ভরাডুবি হল প্রিয়রঞ্জনের l কোনরকমে চল্লিশের ঘর পেরোলো ইন্দিরা কংগ্রেস l

এই সময়, কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতি আবার 1977 এর মত সর্বভারতীয় রূপ নিল l বোফর্স দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং l হাত মেলালেন বিজেপি এবং সিপিএম এর সঙ্গে l তাঁর সঙ্গে যোগ হল অনভিজ্ঞ রাজীব গান্ধীর কুশাসন l দেশ দেউলিয়া হবার পথে চলল l.বেকারত্ব প্রায় তুঙ্গে l 

সেই সময় বামবিরোধী হাওয়াও বেশ তুঙ্গে উঠল এই রাজ্যে l যে ইস্যুগুলো বিরোধীরা সবচেয়ে বেশী হাতিয়ার করলো তা হল 

  1. চন্দন বসুর দুর্নীতি
  2. যতীন চক্রবর্তীর বিদ্রোহ 
  3. বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি
  4. ট্রাম কেলেঙ্কারি 

5 ট্রেজারি কেলেঙ্কারি 

  1. মাটি কেলেঙ্কারি 
  2. সন্তোষ ভট্টাচাৰ্যকে অপমান 
  3. ভয়ঙ্কর লোডশেডিং 
  4. রোজ কোন না কোন শিল্প বন্ধ 
  5. নৃপেন চক্রবর্তীর বিদ্রোহ 
  6. বানতলা, বিরাটি, সিঙ্গুরসহ সারা রাজ্যে মহিলাদের উপর বিভিন্ন নারকীয় অত্যাচার l

কিন্তু রাজীববিরোধী হাওয়া এবং সিপিএম এর প্রচার যন্ত্রের কাছে 1989 সাধারণ নির্বাচনে ধুয়ে মুছে গেল কংগ্রেস l 16 থেকে নেমে এল 4 এ l কলকাতার তিনটি এবং মালদা বাদে পুরো রাজ্য থেকে ধুয়ে মুছে সাফ l প্রধানমন্ত্রী হলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ  সিং l পাঞ্জাবের রাজ্যপাল পদ খোয়ালেন সিদ্ধার্থশঙ্কর l মমতা ব্যানার্জী হারলেন যাদবপুর l রাজীব গান্ধী প্রণব মুখার্জীকে ফিরিয়ে এনে প্রদেশ সভাপতি করলেন l এদিকে সিদ্ধার্থশঙ্কর ফিরে এসে দেখলেন অধিকাংশ প্রদেশ কংগ্রেস নেতাকে সাম-দান-দন্ড-ভেদ মন্ত্র দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে তাঁর বন্ধু জ্যোতি l 1990 তে চূড়ান্ত রিগিং,  বোমাবাজি, খুনোখুনির মধ্যে কলকাতা কর্পোরেশন দখল করল সিপিএম l সিদ্ধার্থশঙ্করকে ফিরিয়ে আনলেন রাজীব গান্ধী প্রদেশ সভাপতি হিসেবে l সিদ্ধার্থর পাশে দাঁড়ালেন প্রিয়রঞ্জন ও মমতা l বাকিরা দূরত্ব রাখলেন l নিজেদের শক্তি যাচাই করতে কলকাতা বন্ধ ডাকলেন সিদ্ধার্থ l 16ই আগস্ট 1990 l সেই দিন লালু আলমের লাঠির ঘায়ে মমতা ব্যানার্জী প্রায় মৃত্যু মুখে পতিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন l রাজীব গান্ধী প্রদেশ যুবকংগ্রেসের সভানেত্রী করলেন মমতাকে l সিপিএম এর অবস্থা এবার সত্যিই খারাপ হতে থাকল l দিল্লিতে বন্ধু সরকারের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সবদিকে ব্যর্থ l সারাদেশে জাতপাতের যুদ্ধ শুরু মণ্ডল কমিশন নিয়ে l এই অবস্থায় 1991 বিধানসভা নির্বাচনে জ্যোতি বসুকে বাঁচিয়ে দিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, তপন সিকদাররা l বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে নয় l জটিল  নির্বাচনী পাটিগণিতের ধাঁধায় l 1990 রামমন্দিরের দাবী নিয়ে রথযাত্রা শুরু করলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী l বিহারে তাকে গ্রেফতার করলেন লালু যাদব l বিশ্বনাথ প্রতাপের সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করল বিজেপি l 

সিপিএম এর মধ্যে একটা নতুন পাটিগণিতের সন্ধান পেল l একদিকে তারা লালুকে নায়ক বানিয়ে কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসলো এবং মালদা, মুর্শিদাবাদে নিজেদের প্রভাব বাড়াল l তাঁরসঙ্গে বিজেপিকে ক্রমাগত আক্রমণ করে কংগ্রেসের হিন্দু ভোট ভেঙে দেবার পরিকল্পনা শুরু করলেন l সেইসময়ে বিজেপির তৎকালীন নেতাদের বক্তব্যও রাজ্যের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হল l তপন সিকদার, পরশ দত্ত, কর্নেল সব্যসাচী বাগচী, রাহুল সিনহাদের বক্তব্য রাজ্যবাসীর কাছে একটা বিশুদ্ধ বাতাসের মত অক্সিজেন হয়ে এলো l তাঁর সঙ্গে বিশ্বশ্রী মনোহর আইচের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরা নিজেদের মনের ভাষা খুঁজে পেলেন l 

সিদ্ধার্থ রায় বুঝলেন বিজেপি কংগ্রেসের ভোট কাটবে, কিন্তু সিপিএম এর ভোট একই থাকবে l বিজেপির বিরুদ্ধে তিনিও খুব একটা বললেন না l কিন্তু বারবার ভোটারদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন বিজেপিকে ভোট দিলে সেটা সিপিএমকে জিততে সাহায্য করবেন l কিন্তু ভোটাররা শুনলো না l

সিদ্ধার্থ রায়ের ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেল l চন্দন বোস, বেঙ্গল ল্যাম্প, লোডশেডিং, মমতার মাথায় লাঠি কাজে লাগলো না l সেবার সিদ্ধার্থ রিগিং আটকালেন বটে l কিন্তু 12% ভোট কেটে 137 টি আসনে কংগ্রেসকে হারিয়ে দিল সিপিএম l কংগ্রেস পেল 42 l ভোটার পর সিদ্ধার্থ আক্ষেপ ভোট ভাঙার জন্য করলেন l 

1991 তে ফিরে এলো উন্নততর বামফ্রন্ট l পরের পাঁচ বছর অত্যাচার আরও বাড়লো বিরোধীদের উপর l রাজ্যে চলছে বিরোধীদের জ্যান্ত কৈমাছ খাওয়ানো, হাত কেটে নেয়া, মহাকরণে গুলি এবং একের পর এক রাজনৈতিক হত্যা l পাল্লা দিয়ে বন্ধ হাওয়া শুরু করল একের পর এক জুট মিল, পেপার মিল থেকে চাবাগান l ওদিকে নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে এক নতুন সূর্যোদয়ের আশায় এগিয়ে চলেছে নতুন ভারত l নব্বইয়ের দশকে রাজ্যের রাজনীতিতে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন এল রাজ্যের রাজনীতিতে l আলোচনা হবে পরের পর্বে l 

সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)

( চলবে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.