2004 এ হেরে যাবার পর অটল বিহারি বাজপেয়ী প্রশ্ন করেছিলেন, আমরা এতো কাজ করে হেরে গেলাম, অথচ একটা সরকার পশ্চিমবঙ্গে কিছু না করে 27 বছর ক্ষমতায় থাকলো কি ভাবে? উত্তরে অনিল বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘গ্রামোন্নয়ন’ l অটলজি কি করে গেছেন বলে দাবী করেছিলেন সেদিন? এক, অটলজি ক্ষমতায় আসার আগে ব্যাংক কর্মচারী বাদে আর কেউ ব্যাংক থেকে বাড়ি বানানোর জন্য বা গাড়ি কেনার জন্য ধার পেতেন না l জীবনের শেষে প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকায় বাড়ি বানাতো ভারতবাসী l কেউ কেউ অফিস থেকে লোন পেতেন l অটলজি যখন চলে যাচ্ছেন, ভারতবাসী চাকরির শুরুতেই ব্যাংক লোন নিয়ে ফ্ল্যাট, গাড়ি, টিভি কিনছে l দুই, পরিকাঠামোর আমূল পরিবর্তন l কলকাতা ছাড়া অন্য কোন শহরের মেট্রো ছিল না l বাজপেয়ীজি প্রায় প্রত্যেকে শহরের মেট্রোর কাজ শুরু করলেন l সুবর্ণ চতুর্ভূজ দিয়ে চার মহানগরী জুড়লেন, বানালেন বহু বিমানবন্দর ও বন্দর l নদী সংযুক্তির আগেই মানুষ তাঁকে সরিয়ে সোনিয়া গান্ধীকে মসনদে বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন l. অন্য দিকে অনিল বিশ্বাস নিজেই বলেছেন, গ্রামোন্নয়ন তাদের একমাত্র সাফল্য l কি সেই সাফল্য? তিস্তা, কংসাবতী, রূপনারায়ণ, সিদ্বেশ্বরী নুনবিল, দ্বারকেশ্বর-গন্ধেশ্বরীতে এক হেক্টর সেচ বাড়ে নি l কোন বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প রূপায়িত হয় নি l হেক্টর প্রতি ফলন কমেছে l 40% গ্রামবাসী 2011 পর্যন্ত বিদ্যুৎ পায় নি l 60% গ্রামে আধুনিক সবজি মান্ডি ছিল না l স্বাস্থ্য বলতে হয় কলকাতা নয় ভেলোর l শিক্ষা নিয়ে লিখলে মহাভারত কম পরে যাবে l
তাহলে ভোট বৈতরণী বারংবার পার হবার রহস্যটা কোথায়? উত্তর স্ট্রাটেজি ও ভাগ্য l সঠিক লোকের সঙ্গে সঠিক সময়ে হাত মেলানো ( সাম), প্রত্যেক শেয়ার হোল্ডারকে সঠিক ডিভিডেন্ড দেয়া(দান), অকথ্য অত্যাচার (দন্ড) এবং বিরোধী ভোট ভাঙার সুচতুর রাজনীতি (ভেদ) l ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী , নরসিমা রাও ও সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে গোপনে হাত মেলানো, সিপিআই, আর এস পি, ফরওয়ার্ড ব্লকেকে সঠিক ভাগ দেয়া, বিরোধীদের ভোট দেবার অপরাধে জ্যান্ত কই মাছ খাওয়ানো কিংবা হাত কেটে দেয়া এবং সুচতুরভাবে কংগ্রেস ও বিজেপির ভোট ভেঙে দেয়া l
1977 এরা ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস ও জনতা পার্টির ভোট ভেঙে যাওয়ায় l 1977 এ যে জনতা পার্টি ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস ( আর ) কে হারিয়েছিল, তা কয়েকটি দক্ষিণপন্থি দলের সমাহার l এর মধ্যে জনসঙ্ঘও ছিল l কিন্তু জ্যোতি বাবুরা হাত মেলাতে পিছপা হয় নি l প্রধানমন্ত্রী হয়ে মোরারজি বরখাস্ত করলেন সিদ্ধার্থ রায়কে l প্রফুল্ল সেন তখন জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গের মুখ l বিধানসভার আগে জ্যোতি বসু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত মাত্র 100 টা আসন চাইলেন l সিপিএম তখন রাজ্যে তৃতীয় শক্তি l প্রফুল্ল সেন 100 টা আসন দিতে রাজি হলেন না l লোকসভায় দ্বিমুখী ভোটের কয়েক মাসের মধ্যে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হল বিধানসভায় l একদিকে সোভিয়েতপন্থী ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস (আর ) এবং সিপিআই, একদিকে চীনপন্থী সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট এবং তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণপন্হী জনতা পার্টি l ভোট ভাগের ফলে, বিপুল ভোটে জিতে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলো l এর আ, 1975 এ জরুরি অবস্থা জারির সময় থেকে চীনপন্থি সিপিএম কার্যতঃ মুখে কুলুপ এঁটে ছিল l ইন্দিরাও কোন সিপিএম নেতার গায়ে হাত দেননি l জেপির নেতৃত্বে ইন্দিরা সিদ্ধার্থদের ক্ষমতা থেকে সরালেন মোরারজি প্রফুল্ল সেন l কিন্তু ফল পেল বামফ্রন্ট l পরের প্রায় দেড় দশক দারিদ্রে অর্ধাহারে শেষ দিন কাটান দেশের অন্যতম সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রফুল্ল সেন l আর পরের তিন দশক জ্যোতি বসু হয়ে গেলেন অবিসংবাদী বঙ্গেশ্বর l 1980 র বিখ্যাত হীরক রাজার সেই বাউলের গান মনে করিয়ে দেয়, “ভালো যে সে রইল ভাঙা ঘরে, মন্দ দেশের সিংহাসনে বসে l”
সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)
( চলবে )