সে প্রায় তিন দশক আগের কথা। তামিলনাড়ু বেড়াতে গিয়েছিলেন চিকিৎসক দম্পতি জর্জ এবং ললিতা রেগি। ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছেছিলেন, পূর্বঘাট পর্বতমালার কলরায়ন এলাকার সিত্তেরি পাহাড়ে। সেই পাহাড়ের কোলেই ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম ধর্মপুরী। সে গ্রামে গিয়ে চমকে যান রেগি-দম্পতি! বহির্দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন, সমস্ত আধুনিক সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত সে গ্রামটি যেন কয়েকশো বছর পিছিয়ে থাকা এক টুকরো অন্য ভারতবর্ষ। সে দিন তাঁরা ভাবেননি, সেই ভারতবর্ষেই অন্য একটি হাসপাতাল গড়বেন তাঁরা!
আলাপ্পুজার টিডি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস শেষ করে তখন এমডি করছিলেন তাঁরা। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পরে তামিলনাড়ুর গান্ধীগ্রামের একটি হাসপাতালে প্র্যাকটিস শুরু করেন তাঁরা। সেখানেই প্রতি দিন দেখতেন, দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে কত মানুষ উজিয়ে আসছেন হাসপাতালে। কত কত কঠিন অসুখের ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না দূরত্বের কারণে। দেখতেন, ডায়েরিয়া আর নিউমোনিয়ার প্রকোপে কী ভাবে উজাড় হয়ে যাচ্ছে গ্রামকে গ্রাম।
সদ্য-চিকিৎসক দম্পতি ঠিক করেন, তাঁদের কেরিয়ারের গোড়ায়, অন্তত একটা বছর প্রত্যন্ত কোনও গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করবেন তাঁরা। এই শহর থেকে, সুবিধা থেকে দূরে গিয়ে, প্রান্তিক মানুষদের পাশে দাঁড়াবেন। চিকিৎসা করবেন তাঁদের, যাঁরা চিকিৎসার আলো পাননি কখনওই।
মনে পড়ে যায়, দু’বছর আগে ঘুরে আসে গ্রাম ধর্মপুরীর কথা। সিত্তেরি পাহাড়ের ওই গ্রামে মানুষের দুরবস্থা নিজের চোখে দেখে এসেছিলেন তাঁরা। তা হলে সেখানেই তো চিকিৎসার আলো দেখানোর কাজ শুরু করা যায়! কিন্তু তখনও তাঁরা জানতেন না, ১৯৯৪ সালে শুরু করা সেই কাজ মোটেই এক বছরে পিছু ছাড়বে না তাঁদের! বরং সে কাজ এতই বড় হবে, যা দিয়ে চিকিৎসক-সমাজে দৃষ্টান্ত গড়বেন তাঁরা!
ধর্মপুরী থেকে সব চেয়ে কাছাকাছি হাসপাতালের দূরত্ব ছিল সালেম। ৫০ কিলোমিটার। তবে যদি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ত, তা হলে মানুষগুলিকে ছুটতে হতো ১০০ কিলোমিটার দূরে।
তাঁরা দেখেন, ধর্মপুরীতে সদ্যোজাতের মৃত্যুর হার ১০০টির মধ্যে ১৫টি। সারা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়াও জন্মের এক বছরের মধ্যে মারা যায় প্রতি পাঁচটির মধ্যে একটি। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারাও যান বহু মা। অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত গ্রাম ধর্মপুরীর পাশ দিয়ে দিনে মাত্র দু’বার যাতায়াত করত বাস। সে বাস মিস করলে, লোকসমাজে পৌঁছনোর জন্য কয়েক ঘণ্টা হাঁটা ছাড়া উপায় নেই।
“সহজ ছিল না প্রথম দিকের দিনগুলো।”– বলছিলেন ললিতা। পালিয়ে আসার মতোই অবস্থা হয়েছিল, শহুরে আবহে আজন্ম বড় হওয়া তরুণ-তরুণীর। কিন্তু হাল ছাড়েননি তাঁরা। দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থেকেছেন এক একটা দিন। চিকিৎসা করেছেন সর্বহারা মানুষগুলোর। প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন অসুখে জর্জরিত মৃতপ্রায় গ্রামবাসীদের। একটু একটু করে গড়ে তুলছিলেন জীবনের আশ্বাস।
এভাবেই কেটে গিয়েছে ২৫টা বছর! সে দিনের সেই মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাওয়া দম্পতি আজ গড়ে তুলেছেন হাসপাতাল! বছরে এক লক্ষেরও বেশি আদিবাসী মানুষ কার্যত বিনা পয়সায় চিকিৎসার সুবিধা পাচ্ছেন সেখানে। তাঁদের এই প্রকল্পের নাম, ‘ট্রাইবাল হেল্থ ইনিশিয়েটিভ’।
ডক্টর জর্জ রেগি বলছিলেন, প্রথমকার দিনগুলোর কথা– “আমরা ঠিক করেছিলাম, এভাবে হবে না। সত্যিকারের কিছু করতে চাইলে, স্থায়ী কিছু করতে হবে। একটা কুঁড়ে ঘর, ১০০ ওয়াটের একটা বাল্ব, রোগীর শোয়ার জন্য একটা কাঠের বেঞ্চ– এই ছিল আমাদের শুরু। ঘরটাও স্থানীয় আদিবাসীরাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমরা তিন বছর এ ভাবেই চালিয়েছিলাম। ছোটখাটো অস্ত্রোপচার বা সন্তান প্রসব করা হতো মেঝেতে চাদর পেতে।”
ধীরে ধীরে কিছু দিন পরে, চেনা-পরিচিতদের থেকে কাছু চাঁদা তুলে, দশটা বেড কেনেন তাঁরা। টুকটাক সাহায্য ও সহায়তায় বাড়তে থাকে পরিষেবা। এবং ২৫ বছরের মাথায়, সেই হাসপাতাল আজ কোনও অংশে কম নয় আর পাঁচটা আধুনিক হাসপাতালের চেয়ে। জর্জ জানালেন, এখন হাসপাতালে মোট ৩৫টা বেড রয়েছে। রয়েছে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের সুবিধা। আছে আলাদা ডেন্টাল ক্লিনিক, লেবার রুম, সদ্যোজাত শিশুদের দেখভালের জন্য নিওনেটাল রুম, এমার্জেন্সি, সব রকম পরীক্ষা করতে সক্ষম ল্যাবরেটরি, এক্স-রে, আল্ট্রা সোনোগ্রাফি, এন্ডোস্কপি, ইকোকার্ডিওগ্রাম– এই সব রকমের সুবিধা।
এবং এর ফলাফলও মিলেছে হাতেনাতে। জর্জের স্ত্রী, চিকিৎসক ললিতা রেগি জানালেন, এখন ওই এলাকায় সদ্যোজাত শিশুমৃত্যুর হার ১০০-র মধ্যে দু’টি। যা সারা দেশের মধ্যে নিম্নতম বলে দাবি তাঁর। এবং শেষ দশ বছরে এক জন মা-ও মারা যাননি সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে।
জর্জ বলেন, “আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে মাতৃত্ব নিয়ে সচেতন করতেও শুরু করেছিলাম। বুঝিয়েছিলাম, চল্লিশ বছরের বেশি বয়সে মা হওয়ায় ঝুঁকি রয়েছে। পরিচ্ছন্নতা নিয়েও আলাদা করে বোঝাতাম হবু মায়েদের। ”
ইতিমধ্যে দুই সন্তান জন্মেছে ললিতা-জর্জের। তারা বড় হচ্ছে, আশপাশে কোনও স্কুল নেই। দূরের স্কুলে সন্তানদের পড়াতে নিয়ে গেলে চিকিৎসা আর হবে না। তবু হাল ছাড়েননি তাঁরা। ক্লাস ফোর পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করিয়েছেন ছেলেদের।
সে পর্বের লড়াই খুব কম ছিল না। এমনকী সামান্য এদিক-ওদিক হলে গ্রামবাসীদের রোষের মুখেও পড়তে হতো তাঁদের। কারণ তখনও তেমন করে বিশ্বাস অর্জন করা হয়নি। “মানুষগুলো আসলে বহু দিন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত ছিল। তাই ওরা ওদের মতো করে বুঝে নিয়েছিল অসুখবিসুখ। কোনও শিশুর কঠিন অসুখ হলে ওরা ভাবত, অপদেবতা পাপ দিয়েছেন। এই সুযোগে তন্ত্রমন্ত্র জাঁকিয়ে বসছিল এলাকায়। সাপে কামড়ালে পুজোয় বসত ওরা। আমরা প্রথম প্রথম আমাদের মতো করে চিকিৎসা করতে গিয়ে বুঝেছিলাম, স্থানীয়দের বিশ্বাসে আঘাত করা যাবে না। তাই কেউ অসুস্থ হয়ে পুজো করতে চাইলে, আমরা হাসপাতালের বিছানার পাশেই তার ব্যবস্থা করে দিতাম। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, মানুষগুলোর ভালর জন্য এটা করতেই হতো।”– বলছিলেন জর্জ।
ললিতা জানালেন, চিকিৎসার জন্য নামমাত্র খরচ করতে পারতেন স্থানীয়রা। তবে টাকা দিতে না পারলেও, বাড়তি উৎপাদিত এটা-ওটা প্রায়ই দিয়ে যেতেন তাঁরা। এর পাশাপাশি ডোনেশন আসতে থাকে নানা জায়গা থেকে। এনআরআই-রাও পাঠাতে শুরু করেন টাকা। যদিও সরকার আগাগোড়াই উদাসীন ছিল ‘ট্রাইবাল হেল্থ ইনিশিয়েটিভ’। এখনও তা-ই আছে।
জর্জ রেগি বলেন, “আমাদের আলাদা কোনও রোজগার নেই এখানে। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের কোনও আক্ষেপও নেই। আমাদের যে চিকিৎসা পরিষেবা, তার পেছনে কোনও লুকোনো খরচেরও সুযোগ নেই, কারণ এখানে খরচই প্রায় নেই। কিন্তু যে পরিষেবাগুলো চলছে, সেগুলো চালিয়ে যাওয়ার জন্যই টাকার দরকার হয় আমাদের। আমরা এই হাসপাতালে জন্মানো শিশুদের জন্য পিঙ্ক কার্ড ইস্যু করি। সেই কার্ড দেখালে তিন বছর বয়স অবধি বিনা পয়সায় চিকিৎসা মেলে তাদের। এমনটা করতেই হয়, কারণ ওই কার্ডটা থাকলে, অসুস্থ হলে তবু আমাদের হাসপাতালে বাচ্চাদের আনবেন বাবা-মায়েরা। নইলে ওই ঝাড়ফুঁকই চলবে, হাসপাতালে যাওয়া আর হবে না।” এ ছাড়াও, সারা বছর মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা পান গ্রামের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা।
শুধু তা-ই নয়। ‘ট্রাইবাল হেল্থ ইনিশিয়েটিভ’-এর সঙ্গে এখন জড়িয়ে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। হাসপাতালের নানা কাজ সামলাচ্ছেন তাঁরা। প্রত্যেকের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোঝানো হয়েছে শ্রমের অধিকার। “আমাদের বেশির ভাগ নার্স, ল্যাবকর্মী, প্যারামেডিক্যাল কর্মীরাই আদিবাসী তরুণ-তরুণী। আমরা নিজেরা বা ওদের বাইরে পাঠিয়ে প্রশিক্ষিত করি। এখন ৫০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে, বছরে প্রায় লাখ খানেক আদিবাসীর চিকিৎসা করা হয় আমাদের এই হাসপাতালে।”
পাশাপাশি তাঁরাাই এলাকার কৃষকদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন অর্গানিক ফার্মিং সংগঠন। সেই সংগঠনের আওতায় প্রায় ৫০০ চাষি কীটনাশক ও রাসায়নিক ছাড়া ফসল ফলাচ্ছেন বছরভর। গ্রামের মহিলারা শিখছেন হাতের কাজ। বানাচ্ছেন নানা রকম মশলা। সেগুলো বিক্রিও করা হচ্ছে গ্রামের বাইরে। আসছে টাকাপয়সা। এ বিষয়ে জর্জ বলছিলেন, “শুধুমাত্র একটা বিল্ডিং বানিয়ে হাসপাতাল চালানোই যথেষ্ট ছিল না। ভাল শস্য উৎপাদন, মেয়েদের স্বনির্ভর করা– এই সবটাই মানুষগুলোর উন্নয়নের জন্য জরুরি ছিল।”
সব শেষে ললিতা মনে করিয়ে দিলেন, “আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন সংশয় ছিল। দ্বন্দ্ব ছিল। ছিল হাজারটা অনিশ্চয়তা। অভাব ছিল মারাত্মক। কিন্তু সেই সঙ্গে ছিল আমাদের আন্তরিকতা। ছিল হাল না-ছাড়া মনোভাব। জেদ। কখনও কখনও দু’চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকেই বলতাম, ভরসা রাখতে। মনে করতাম পল কোয়েলহোর সেই কথাটা– যখন তুমি মন থেকে কিছু চাও, তখন সারা দুনিয়া উঠেপড়ে লাগে তোমায় সেটা পাওয়ানোর জন্য। আমাদের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। মন থেকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, সুযোগ পেয়েছি।”