ভারতবর্ষের গর্ব বঙ্গভূমির গর্ব, দেশের অনন্য ব্যক্তিত্ব প্রণব মুখার্জি আমাদের ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। তার হৃদয় ছিল বিশাল। ২০১৭ সালে দিল্লিতে একটি বৈঠকে গিয়েছিলাম, তখন একদিন সঙ্ঘের কার্যকর্তার পরিচয়ে পশ্চিমবঙ্গের একজন বিদ্বান, পণ্ডিত, উচ্চকোটি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় করতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম।
তখন তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। সঙ্ঘের কেন্দ্রীয় কার্যকর্তাদের পরামর্শ মতাে রাষ্ট্রপতি ভবনে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।ইতিপূর্বে সরসঙ্ঘচালক মােহন ভাগবতজী তার সঙ্গে দু’বার সাক্ষাৎ করেছেন। আমি সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাতেই তিনি সাগ্রহে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। তিনি জানতে চাইলেন, কত বছর ধরে আমি সঙ্ঘের প্রচারক। আমি আমার প্রচারক জীবন প্রসঙ্গে বললাম, ৪০ বছর ধরে কাজ করছি। তিনি আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলেন আমার বাড়ি কোথায়? যেন এক পরম আত্মীয় তাঁর স্নেহভাজন
কারাে সঙ্গে কথা বলছেন। আমি মেদিনীপুর বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেদিনীপুর সম্পর্কে অনেক কথা বলতে শুরু করলেন।
তিনি জানতে চাইলেন পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘের কাজ কেমন চলছে। আমি আগ্রহের সঙ্গে বললাম—সঙ্ঘের কাজের জন্য এই সময় উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ দুটিতেই ২০০ জন আমার মতাে প্রচারক কাজ করছেন। তাছাড়া বহু গৃহী কার্যকর্তাও এই প্রচারকদের মতাে সমর্পিত জীবন নিয়ে সঙ্ঘের কাজ করছেন। তিনি জানতে চাইছিলেন পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির কথা। আমি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে একদিকে নারীদের অপমান, একদিকে দেবী দুর্গা ও মা সরস্বতীর অপমান চলছে বললাম। একথা শােনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন – ৩৫ বছর ধরে বামপন্থীরা যা করতে পারেনি, এরা তার অনেক বেশি। এই ধরনের কাজ করে চলেছে। একথা বলার সময় তার চোখে-মুখে একটা চাপা ক্ষোভ অনুভব করছিলাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল ভারতীয় সংস্কৃতির উপর তাঁর গভীর প্রেমে তিনি ওতপ্রােত । তিনি রাষ্ট্রপতি, তাঁর বিচার, তাঁর চিন্তা রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য।
কথার মাঝেই আমি স্বস্তিকা পত্রিকা তার হাতে দিলাম। কিছুক্ষণ দেখে তিনি জানতে চাইলেন এটা কত বছর ধরে চলছে। স্বস্তিকার ৭০ বছরের কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে বললেন, খুব ভালাে। সারা দেশে বিভিন্ন ভাষায় এরকম ৪০টি পত্রিকার কথা আমি উল্লেখ করলাম। তিনি বললেন, “আমাদের দেশে এই ধরনের আধুনিক ও প্রাচীন চিন্তা সংবলিত সাপ্তাহিক পত্রিকা আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে খুবই উপযােগী। দেখে মনে হলাে তিনি খুশি হয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি ভবনে চা-পান ও জলযােগের পর তিনি বললেন, এবার দুর্গাপূজার সময় আপনারা আমার বাড়িতে আসুন। আপনার কুটুমদেরও নিয়ে আসবেন। আমি বললাম আমার কুটুম তাে সদ্যের প্রচারক, কার্যকর্তা ও স্বয়ংসেবকরা। যথারীতি দুর্গাপূজার সময় অষ্টমীর দিন বর্তমান ক্ষেত্র প্রচারক, সহ-প্রান্ত প্রচারক, বিভাগ প্রচারক, বিভাগ কার্যবাহ-সহ আমরা তাঁর বাড়িতে পৌঁছলাম। তার ছেলে অভিজিৎবাবু আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। অভিজিৎবাবুর সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টার কথা হলাে। তারপর পূজামণ্ডপে প্রণববাবুর চণ্ডীপাঠ শুনলাম। পূজা শেষে প্রণববাবুর সঙ্গে সবার পরিচয় হলাে। সেই সময় আমি তার হাতে স্বস্তিকার পূজা সংখ্যাটা দিলাম। তিনি আগ্রহের সঙ্গে সেটা নিলেন এবং তাঁর সেক্রেটারিকে রাখতে বললেন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথাবার্তায় এবার তাকে আমরা
একজন স্বস্তিকাপ্রেমী হিসেবে নয়, একজন সঙ্প্রেমী হিসেবে তাকে দেখলাম। তাঁর অন্তরে সঙ্ঘের প্রতি এক অফুরন্ত শ্রদ্ধা প্রত্যক্ষ করলাম। দুপুরে প্রসাদ গ্রহণ করে আমরা তার থেকে বিদায় নিলাম।
তাঁর প্রয়াণ হলেও তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন। কারণ তাঁর রেখে যাওয়া কাজ, তার ভাবনা এবং দীর্ঘ সময় এক বিশেষ রাজনীতি জীবনে থাকার পরেও ছুঁত-অচ্ছুত বিচার না করে রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য নিজের বিদ্যা-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েছেন।
মিতভাষী লােকপ্রিয় প্রণব মুখার্জি জীবনলীলা সম্পূর্ণ করে পরম তত্ত্বে বিলীন হয়ে গেলেন। তার পরিবারের সবার সঙ্গে আমিও সমব্যথী।পরিবারের সবাইকে সমবেদনা জানাচ্ছি। তার বাড়িতে যাওয়ার স্মৃতি, রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার স্মৃতি, তার প্রেরণা আজও আমাকে অনেক আনন্দ দেয়। তার বাড়িতে গিয়ে দেখেছি কত জনপ্রিয় তিনি। তাঁর সঙ্গে বসে অষ্টমীর প্রসাদ গ্রহণ করার সময় আমার মনে হচ্ছিল যেন আমারা আমাদের কোনাে আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছি। সেই প্রণববাবু আজ আমাদের সামনে নেই। কিন্তু তাঁর প্রেরণা আমাদের মধ্যে আছে। তাঁর প্রয়াণে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের শূন্যতা সৃষ্টি হলাে তা সহজে পূরণ হবে না। সঙ্ঘের তথা সমাজের এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমাদের পরিবারের একজন কুটুম চলে গেলেন।
অদ্বৈতচরণ দত্ত
(লেখক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অখিল ভারতীয় সহ প্রচারক প্রমুখ)
2020-09-07