২১ তােপের স্যালুট। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিরবিদায় পূর্ব রাষ্ট্রপতি ভারতরত্ন প্রণব মুখার্জির। দিল্লির লােধিরােডস্থিত শ্মশানে অগ্নিস্পর্শে তার নশ্বর শরীর বিলান হয়ে গেল পঞ্চভূতে। সবকিছুই হলাে কোভিড প্রেটোকল মেনেই। রাতেই অস্তিভস্ম বিসর্জন করা হলাে হরিদ্বারের গঙ্গায়। অবসান হলাে একটি যুগের। গত ৯ আগস্ট বাড়ির বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান প্রণববাবু। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ নিয়ে পরদিন তাকে ভর্তি করা হলাে দিল্লির সেনা হাসপাতালে। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের পরে দীর্ঘ সময় কোমায় আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। ৩১ আগস্ট বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ শেষ হলাে সেই লড়াই। শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন ভারতের প্রথম বাঙ্গালি রাষ্ট্রপতি। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করার প্রয়ােজনীয় পরীক্ষায় তার করােনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। সেই কারণেই তার পার্থিব শরীর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধার জন্য প্রকাশ্যে রাখা হয়নি।
প্রণববাবু ছিলেন সংবিধানের রক্ষক। অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিদেশনীতির বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা আর তীক্ষ্ম স্মৃতিশক্তিতে উজ্জ্বল। রাজনীতির অঙ্গনে বিরােধী ও শাসকদলের মধ্যে তিনি ভারসাম্য বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােকে অটুট রেখে সংবিদানকে রক্ষা করার মতাে ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর। ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম উজ্জ্বল এই ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৩৫ সালে বীরভূম জেলার কীর্ণাহরের মিরাটি গ্রামে। বাবা রামদাকিঙ্কর ও মা রাজলক্ষ্মীদেবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯-এ ইতিহাস ও ১৯৬২-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে। তিনি। ১৯৬৩-তে আইন পাশ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে হাওড়া জেলার বাঁকড়ায় ইসলামিয়া হাইস্কুলে দু’বছর শিক্ষকতা করেন। সাংবাদিক, সরকারি কর্মচারী ও আইনজীবী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। ছােটোবেলা থেকেই কীভাবে তার মজ্জায় কংগ্রেস ঢুকে গিয়েছিল তা লিখেছেন তিনি ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড ও দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স’ পুস্তকে। কংগ্রেসের প্রতি তাঁর টান। সম্পর্কে স্মৃতিমেদুর প্রণববাবু লিখেছেন কীভাবে প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি বাড়ির ছাদে পরিবারের সবাই মিলে কংগ্রেসের পতাকা
উত্তোলন করতেন। শৈশবের সেই সব দিন প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন , “বাবা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গিয়ে খবর দিতেন। স্থানীয়দের। প্রচার করতেন কংগ্রেসের আদর্শ। এই বিদগ্ধ বাঙ্গালি প্রণববাবুকে তাঁর দল কংগ্রেস কোনােদিন প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। যেমন জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে জেয়নি তাঁর দল সিপিএম। তবে জ্যোতিবাবু ও প্রণববাবুর মঝে আমরা একটি পার্থক্য খুঁজে পাই। তা হলাে। জ্যোতিবাবুর দলের একটি বড়াে অংশ ওই সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে স্বীকার করে। কিন্তু প্রণববাবুর ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভুল বলার সাহস হয়নি কারও। মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে দু’বার হাতছাড়া হয়। প্রণববাবুর প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার স্বপ্ন। প্রথমবার ১৯৮৪-তে, আর দ্বিতীয়বার ২০০৪ সালে। প্রথমবার রাজীব গান্ধী তাকে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসতে দেননি, দ্বিতীয়বার সনিয়ার একক সিদ্ধান্তে এবং অবিশ্বস্ততার কারণে। নাটকীয় ভাবে ২০০৪ সালের সেই রাজনৈতিক ওঠাপড়ার সন্ধিক্ষণে রাজীবপত্নী কুর্সির দিকে এগিয়ে আনেন প্রায় মৌনী’ড. মনমােহন সিংহকে। মনমােহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী হলে আড়ালে। থেকে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজেই সম্ভব হবে বলেই তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন সনিয়া। গােটা দেশ ওই সিদ্ধান্তে শুধু বিস্মিতই নয়, যথেষ্ট বিচলিতও হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মনমােহন সিংহ নিজেই বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তাঁর থেকে অনেক বেশি যােগ্য ছিলেন প্রণব মুখার্জি। প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরসিদ তার অটোবায়ােগ্রাফিতে লিখেছেন, সেই সময় প্রণব মুখার্জির পরিবর্তে মনমােহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বেছে নেওয়া শুধু কংগ্রেস দলের সদস্যদেরই নয়, অন্যদেরও অবাক করেছিল। সেসময় কংগ্রেসের সবচেয়ে সিনিয়র নেতা প্রণব মুখার্জিই ছিলেন।
রাজনৈতিক ঘােরপ্যাচে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর পদে কোনােদিন আসীন হতে পারেননি প্রণববাবু। ১৯৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে বাসভবনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর প্রণববাবুকে প্রধানমন্ত্রী না করে রাজীব গান্ধীকে করা হয়। যদিও ইন্দিরা। সরকারে প্রণববাবু ছিলেন অর্থমন্ত্রী অর্থাৎ ‘নম্বর টু’ মন্ত্রী। প্রচলিত প্রথা অনুসারে আচমকা প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হলে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগের সময় ‘নম্বর টু’-কেই করা হয়। কিন্তু সেসময় বংশবাদ অব্যাহত রাখতে নম্বর টু প্রণববাবুকে আটকাতে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। রাজীব গান্ধীকে। গভীর দুঃখ ও অভিমানে প্রণববাবু কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল গড়েন। যদিও তিনি সফল হননি। এরপর বােফর্স কেলেঙ্কারির জেরে রাজীব গান্ধীর সরকার যখন গভীর সংকটে, তখন কংগ্রেসের সেই দুর্দিনে ১৯৮৯ সালে ফের কংগ্রেসে ফিরে আসেন তিনি। ধীরে ধীরে নিজেকে আবার কংগ্রেসের ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। ২০০৮-এ তিনি
সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ পান। ২০০৪ সালে যখন আবার ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী গঠনের সুযােগ আসে, তখনও কংগ্রেস তাঁকে বিমুখ করে। অতপর ২০১২ সালে এই বাঙ্গালি ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ২০১৭-তে মেয়াদ শেষ করেন। একমাত্র বাঙ্গালি রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত হন ২০১৯-এ। আর সেটাও অকংগ্রেসি সরকারেরক আমলে। তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট যদি আমরা বিচার করি তাহলে দেখা যাবে, সুকৌশলে প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রতিযােগিতা থেকে সরিয়ে দেবার জন্য ‘রাষ্ট্রপতি’ নামক সােনার শিকলে বেঁধে ফেলেছিল তাঁর কংগ্রেস দল। আসলে রাজীব ও সনিয়া-পুত্র রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী বানানাের চেষ্টাই এখানে প্রধান বিষয়। প্রণববাবু নিজের আত্মজীবনীমূলক ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স ১০৯৬-২০১২’পুস্তকে লিখেছেন যে, জওহরলাল নেহর সমসাময়িক নীতিনির্ধারক নেতা কুমারস্বামী কামরাজ বলেছিলেন, ‘নাে হিন্দি নাে পিএম। অর্থাৎ হিন্দি জানেন না এমন কাউতে প্রধানমন্ত্রী করা যাবে না। এটা সত্যি যে, প্রণববাবু হিন্দি ভালাে বলতে পারতেন না। তাই তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। সেজন্যই অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার কংগ্রেস দলকে দল না বলে কংগ্রেস প্রাইভেট লিমিটেড’ বলেছেন।
প্রণববাবু প্রধানমন্ত্রী না হলেও কংগ্রেস দলে ও কেন্দ্রীয় সরকারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁর গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস নেতা পৃথ্বীরাজ চৌহান একটি গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি কাগজে লিখেছিলেন- ড. মনমােহন সিংহের সরকারে প্রণবদা ছিলেন কার্যত দ্বিতীয় ব্যক্তি। ৯৫টির বেশি মন্ত্রীগােষ্ঠী ও বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রীগােষ্ঠীর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ৬০ বছরের বেশি সময় শৃঙ্খলা ও নিয়মের নিগড়ে বাঁধা প্রণববাবু তাঁর রাজনৈতিক সময়ের কথা তুলে ধরেছেন – ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স ১৯৯৬-২০১২’, ‘দ্য
টারবিউলেন্ট ইয়ার্স ১৯৮০-১৯৯৬, ‘মিডটার্ম পােল’, ‘ বিয়ন্ড সারভাইভ্যাল, ‘এমার্জিং ডাইমেনশনস অব ইন্ডিয়ান ইকনােমি’, ‘অব দ্য ট্র্যাক’, ‘সাগা অব স্টাগ অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস’, ‘চ্যালেঞ্জ বিফোর নেশন’ প্রভৃতি পুস্তকে। নিজের যােগ্যতার। জোরে ধীরে ধীরে শীর্ষে উঠেছেন কোনােরূপ অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে। আজকের দিনে কংগ্রেসের মধ্যে এটি বিরল ঘটনা। প্রণববাবুর জীবন নিয়ে বই লিখেছেন সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী। বইটিতে তিনি এক জাগায় লিখেছেন, “ প্রণববাবু যা কিছু অর্জন করেছেন সব নিজের মেধায়। একেবারে ঘােড়ার রাজনীতি করে তিনি জাতীয় পর্যায়ে এসেছিলেন। তাঁর জীবনে কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল।তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন এবং তার কাছে সেই সুযােগও ছিল, কিন্তু বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়নি।” প্রণব মুখার্জি ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। নিয়মিত পূজার্চনা তাঁর জীবনের অঙ্গ ছিল। প্রতিদিন সকালে ঘণ্টাধিক সময় নিয়ে চণ্ডীপাঠ করতেন। নিয়মিত উপবাস করতেন।
ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বাসের পাত্র হলেও। রাজীব-সনিয়া-রাহুল-প্রিয়ংকা কেউ প্রণববাবুকে বিশ্বাস করতেন না। কারণ তাদের ভয় ছিল স্বাধীনচেতা সাহসী পণ্ডিত মানুষটি কখন বিরূপ হন, জো হুজুর বলতে যদি রাজি না হন, যদি কংগ্রেসের ক্ষমতার রাশ গান্ধী পরিবারের বাইরে চলে যায়! তাই বিচক্ষণ এই বাঙ্গালি নেতাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি। তাকে বিশ্বাসই করতে পারেনি গান্ধী পরিবার। ইন্দিরা গান্ধীকে যদি ভারতীয়। রাজনৈতি ক-চলচ্চিত্রের মােহময়ী অভিনেত্রীর আসনে বসানাে হয়, যদি মনমােহন সিংহকে ধরা হয় কংগ্রেস থেকে উঠে আসা নেপথ্যচরিত্র, পিভি নরসিমা রাও অন্যতম চরিত্র, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যাবে এই চিত্রনাট্যের অন্যতম প্রযােজক প্রণব মুখার্জি। আর এই প্রযােজককেই বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে নিজের দলের কাছেই।
প্রধানমন্ত্রী না হওয়া খেদ নিয়েই ৮৪ বছর ৮ মাস বয়সে দারুণভাবে লড়তে লড়তে হেরে গেলেন মৃত্যুর কাছে।
আনন্দ দেবশর্মা
2020-09-07