পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর থেকে গুজরাটের সানন্দে টাটা ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটটি স্থানান্তরিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। টাটা দের বহিষ্কার করে ভুল হয়েছে এই ভেবে আন্দোলনে জড়িত প্রতিবাদকারী কৃষকরা এখন অনুশোচনা করছেন। যদিও তারা তাদের জমি ফিরে পেয়েছে কিন্তু তা আর চাষযোগ্য নয় এলাকায় তাদের জন্য যথেষ্ট চাকরির সুযোগ তৈরি হয়নি। একথায় কৃষকরা প্রতারিত হয়েছেন বলে মনে করছেন।
ঐ অঞ্চলে শিল্প স্থাপনের দাবিতে কৃষকদের একটি পদযাত্রা কলকাতা পর্যন্ত গত বছর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী চাষীদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ব্যবহার করেছিল, যাতে টাটা তাদের সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানার উত্পাদন বন্ধ করে চলে যেতে বাধ্য হয়। তারা যদি তাদের “ভুল” শুধরোবার সুযোগ পায় তবে তারা সিঙ্গুরের শিল্প স্থাপনের জন্য তাদের জমি দিতে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছে।
২০০৬-০৭ সাল নাগাদ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সরকারের ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন রাজ্য রাজনীতির গুরুতর আলোচ্য বিষয় ছিল এবং পরবর্তিতে মমতা ব্যানার্জি নেতৃত্বাধীন টিএমসি নির্বাচনে জয়লাভ করে রাজ্যে পালাবদলের সূচনা করেছিল। সিঙ্গুরের কৃষকদের আন্দোলন প্রতিবাদ রাজ্য তথা দেশের সংবাদ মাধ্যমের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল।
আজকে হতাশ কৃষকেরা বুঝতে পেরেছেন যে, টাটা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা চাষিদেরকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য ব্যবহার করেছিল। স্থানীয় কৃষক অশোক মাইতি বলেন, ” আন্দোলন করে আমরা কিছুই পাইনি। নেতারা আমাদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করেছে আর আমাদের ছুঁড়ে ফেলেদিয়েছে। এই অঞ্চলে কোনও শিল্প তৈরি হয়নি আর ২০১৬ সালে আমাদেরকে যে জমি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তা চাষযোগ্য নয়। আমরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছি। “
জমি ফেরত পেতে এ অঞ্চলের কৃষকদের দীর্ঘদিন ধরে আইনী লড়াই করতে হয়েছিল। অনেক কৃষক যে জমি পেয়েছেন তা হয় কংক্রিটে রূপান্তরিত নতুবা ধ্বংসস্তুপের সাথে আবৃত অবস্থায়। কৃষি বিশেষজ্ঞ দের মতে কংক্রিট আবৃত জমির অন্তত ৭-৮ ইঞ্চি উপরিভাগের মাটি তুলে ফেলে তারপর পুনরায় কৃষি যোগ্য করা সম্ভব। যা কৃষকদের কাছে একটি ব্যয়বহুল বিষয়। তানাহলে ১০ বছরের বেশী সময় লাগতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ দের মত।
অনেক কৃষক মনে করেন যে তারা ভূমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের আশেপাশে রাজনৈতিক হিংসার উত্তেজনা দ্বারা প্রভাবিত এবং প্রতারিত হয়েছেন। যদি তারা শিল্পের জন্য তাদের জমি দিতেন, তাহলে সিঙ্গুর একটি অন্যতম শিল্পাঞ্চলে পরিণত হত ,চাকরির সন্ধানে ভিন রাজ্যে যেতে হত না।
“ইচ্ছুক” এবং “অনিচ্ছুক” এই দুই শ্রেণীর কৃষক ছিলেন সিঙ্গুরে। এক মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও কিষাণসভার নেতার দাবি অনুযায়ী তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) কৃষকদের একটি অংশকে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য ব্যবহার করেছে, ফলে রাজ্যকে একটি ঐতিহাসিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি বলেন, “কেবলমাত্র সামান্য কয়েকজন কৃষক জমি দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন আর বাকি যারা জমি দিতে পারছিলেন না, তা মূলত সঠিক কাগজপত্রের অভাব এবং পারিবারিক বিরোধের কারণে ছিল। টিএমসির দল তার রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এই অংশের কৃষকদের অসৎ পরামর্শ দিয়ে রাজ্যকে শিল্পায়নের একটি সুবর্ণ সুযোগ হা্রাতে বাধ্য করে। “
সুপ্রীম কোর্টের আদেশের পরে, ২০১৬ সালে কৃষকরা জমি ফেরত পেলেও তারা খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছিলেন যে জমি চাষযোগ্য নেই। চাকরির সুযোগ অভাবের কারণে অনেক কৃষক চাকরির সন্ধানে নিকটবর্তী শহরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কৃষকদের মধ্যের প্রচণ্ড ক্ষোভ কে কাজে লাগিয়ে এখন চলতি লোকসভা নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলি জেলায় শিল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট বৈতরনি পার হতে চাইছে।
২০০৬ সালের বিক্ষোভের উল্লেখযোগ্য মুখ, স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক বেচারাম মান্না তার দলের পক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, তার দল অনেক কিছু করেছে এবং কৃষকদের সুবিধার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে। হুগলি থেকে বিজেপি প্রার্থী, লকেট চ্যাটার্জী, অভিযোগে করে বলেছেন তাদের রাজনৈতিক লাভের জন্য কৃষকদের শোষণ করেছে টিএমসি। তিনি নির্বাচিত হলে এই অঞ্চলে শিল্প নিয়ে আসবেন বলে নিশ্চিত করেছেন । টিএমসির এমপি রত্না দে নাগ বলেছেন, সিঙ্গুরের জমি চাষযোগ্য হওয়ার জন্য খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।