ড. কাঙ্গাল চন্দ্র দাশ : সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

১৯৪৯ সালের ২১ শে নভেম্বর শ্রী কাঙ্গাল চন্দ্র দাশের জন্ম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কুসুমদা গ্রাম, বৈতা, মোহনপুরে। এটি বর্তমানে দাঁতন বিধানসভা ক্ষেত্রের অন্তর্গত। পিতা মাধব চন্দ্র দাশ। মাতুলালয় পটাশপুরের খড়গ্রাম। তিন ভ্রাতার মধ্যে তিনিই ছিলেন কনিষ্ঠ। জন্মের দুই মাসের মধ্যে তাঁর মাতৃ বিয়োগ হয়, ছোটোবেলাতে তিনি পিতাকেও হারান। হয়তো সেজন্যই পিতৃ-মাতৃহীন এই বালকের নাম রাখা হয় ‘কাঙ্গাল চন্দ্র’।

এরপর তাঁর পিতার স্থান নেন বড়দা রাখাল চন্দ্র দাশ। বড় বৌদি চপলা দাশের স্নেহও লাভ করেন। তারাই তখন তাঁর পিতৃমাতৃতুল্য। এদের অভিভাবকত্বে বৈতা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে, পরে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেন এবং কটক মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হলেন। ওই সময় নকশাল আন্দোলন চলছিল। গ্রাম থেকে আসা সরল সাধাসিধা ছাত্র, হালচাল বুঝতে না বুঝতেই ভুল বুঝে নকশাল সন্দেহে তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরে দিল পুলিশ। ফলে কলেজ থেকে অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে তিনিও বহিষ্কৃত হলেন। ডাক্তারী পড়া হল না। চলে এলেন নিজের জেলায়। মেদিনীপুর কলেজে বোটানি নিয়ে অনার্স কোর্সে ভর্তি হলেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিতে এমএসসি করলেন। এরপর দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারুইপুরের একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেন। স্নাতকোত্তর রেজাল্ট বেরোলো, তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আসানসোল বনোয়ারিলাল ভালোটিয়া কলেজে বটানির লেকচারার হিসাবে যোগদান করলেন ১৯৭১ সালে। সেখানে বছর দুয়েকের কিছু কম সম অধ্যাপনা করেছেন। এরপর রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ সেন্টেনারী কলেজে অস্থায়ী লেকচারার পদে যোগদানের সুযোগ ঘটলো। নামকরা এই কলেজ, যোগদান করাটা তাঁর কাছে এক অনন্য সুযোগ বলে মনে হল, কারণ ইতোমধ্যে তাঁর সঙ্গে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের পরিচিতি ঘটেছে, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর অন্তরে বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছেন। তাই স্থায়ী চাকরি ছেড়ে চলে এলেন রহড়া ভি. সি. কলেজে। তখন ১৯৭৩ সাল। পরে চাকরি স্থায়ী ও পাকা হল। লেকচারার পদে যোগদান, লেকচারার থেকে সিনিয়র লেকচারার হলেন। একাদিক্রমে ২৭ বছর চাকরি করেছেন রহড়ার ভি সি কলেজে। শেষের দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানিতে পিএইচডি করার জন্য রেজিস্ট্রেশন করালেন, কাজ চলছিল, পিএইচডি থিসিস জমাও দিলেন।

এরমধ্যে ২০০০ সালের ৬ ই জানুয়ারি কলেজ সার্ভিস কমিশনের সুপারিশে পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করলেন। সিএসসি-র সুপারিশে দাঁতন কলেজে অধ্যক্ষ পদেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু কাঁথিতে যোগদান করলেন তিনি। নতুন কলেজে যোগদানের পরে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ হল, গবেষণার কাজ রহড়ার ভিসি কলেজে থাকাকালীন করেছিলেন। ২০০৯ সালের ৩০ শে নভেম্বর তিনি অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর নেন। কলেজে প্রশাসনিক পদে যখন তিনি যোগদান করেন তখন রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা, প্রশাসন চালাতে নানান প্রতিবন্ধকতা। তা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সবার ভালো, অজাতশত্রু তিনি। রাগ দ্বেষ ছিলো না মোটেই। অনেক সহকর্মীর ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত লাগলে, অনেকে অসাংবিধানিক কথা শুনিয়ে দিলেও তিনি তা মনে রাখতেন না কখনও। শুধুমাত্র এই গুণের জন্যই তিনি অনায়াসে এত বড় একটি কলেজে অধ্যক্ষের পদ চালিয়ে গেলেন। অধ্যক্ষ পদে থেকে বোটানির ক্লাসও নিয়মিত নিয়েছেন। কলেজে ছাত্রদের জন্য তাঁর অসম্ভব স্নেহ-মমতা ছিল। কোনো ছাত্রের প্রবল আর্থিক সমস্যা দেখা গেলে নিজেই আগে এগিয়ে আসতেন, কখনও সহকর্মীদের কাছে আবেদন রাখতেন আর্থিক সহযোগিতার জন্য। আলট্রা মর্ডান ড্রেস পরে কলেজে আসা একদমই পছন্দ করতেন না। কলেজের গার্লস হোস্টেলে খবর নিতে কলেজের পর নিয়মিত যেতেন এবং আবাসিক শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তাদের বাড়িও যেতেন। অধ্যক্ষ থাকাকালীন তিনি প্রতি বছর ১২ ই জানুয়ারি স্বামীজির জন্মদিনটি কলেজে ছুটি দিতেন। টেবিলে সবসময় স্বামীজির ছবি থাকতো৷

তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন শ্রীমতী নমিতা দাশ। এক পুত্র (রাজেশ) ও দুই কন্যা (যূথিকা এবং সাথী)। কিন্তু তাঁর শেষ জীবন সুখকর হয় নি। ২০১৬ সালে তাঁর একমাত্র পুত্রের অকাল প্রয়াণ ঘটে। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন স্ত্রী, ২০১৭ সালে তারও প্রয়াণ ঘটে। শিক্ষিকা জ্যেষ্ঠা কন্যা এবং সেবিকা কনিষ্ঠা কন্যা তখন বিবাহিতা। তাই শেষের কয়েকটি বছর তাঁর কেটেছে একান্ত নিঃসঙ্গতায়, একাকী।

তিনি এলাকার নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে যোগ করে নিয়েছিলেন, ওটাই তাঁর বাঁচবার চাবিকাঠি। অসম্ভব ঐশী বিশ্বাস ছিল। যুক্ত থাকতেন নানান সভা সমিতিতে। প্রচুর বই পড়তেন। কাঁথি বইমেলার কার্যকরী সভাপতি ছিলেন। ছিলেন মেদিনীপুর জেলা লোকপ্রজ্ঞার সংযোজক, তার কাঁথি চর্চাকেন্দ্রটিকে তিনি আপন হাতে সৌকর্যে গড়ে তুলেছিলেন।

১৯ শে আগষ্ট তিনি আকস্মিক স্ট্রোকে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন, মস্তিষ্কে প্রবল রক্তক্ষরণ হয়। পরদিন সকালে প্রথমে কাঁথি মহকুমা হাসপাতাল এবং পরে কলকাতার চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ক্ষরিত রক্ত তরল করে বার করার চেষ্টা হয়, কিন্তু তিনি চিকিৎসায় সাড়া দেন নি। ১ লা সেপ্টেম্বর তাঁর প্রয়াণ ঘটে কলকাতার চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। ২ রা সেপ্টেম্বর কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তাঁর মৃত্যুতে শিক্ষা ও প্রবুদ্ধমহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।

তথ্য সহায়তা
১. মেদিনীকথা, সেপ্টেম্বর ১, ২০২০: রাত্রি ১১.০৬।
২. সাক্ষাৎকার : ড. অমিত কুমার দে, অধ্যক্ষ, প্রভাতকুমার কলেজ, কাঁথি; ড. ভুটান চন্দ্র ঘোষ, বাংলা বিভাগ এবং ড. প্রদীপ্ত পঞ্চাধ্যায়ী, পদার্থবিদ্যা বিভাগ, প্রভাতকুমার কলেজ, কাঁথি; শ্রী প্রীতিরঞ্জন মাইতি, সংযোজক, লোকপ্রজ্ঞা কাঁথি চর্চা কেন্দ্র।
৩. কৃতজ্ঞতা স্বীকার শ্রী গৌতম বর্মন, প্রাক্তন ছাত্র প্রভাতকুমার কলেজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.