বিশ্বভারতী কাণ্ডের উদ্যোক্তা ও সমর্থকদের জন্য রইল শুধু ছিঃ !


বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গপ্রদেশের স্বর্ণযুগের এক ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা পৃথিবীতে ভারতবর্ষের উজ্জ্বলতম শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কবিগুরুর বিশ্বভারতী। তৎকালীন প্রচলিত শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবহারিক প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের মনােবিকাশের সুযােগ করে দেওয়ার জন্যই এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা। আর সেই প্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়েই বয়ে গেল শাসকদলের প্রসাদপুষ্ট জমি মাফিয়াদের ন্যাক্কারজনক ধ্বংসলীলা।
অতি সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের পৌষমেলার মাঠে পাঁচিল দেওয়াকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে। এক লজ্জাজনক অধ্যায়। এই কলঙ্কিত অধ্যায়ে নাম জড়িয়েছে শাসকদলের বিধায়ক থেকে। স্থানীয় নেতাদের। জেসিবি-র মতাে আধুনিক যন্ত্র দিয়ে প্রকাশ্য দিবালােকে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্বভারতীর ঐতিহাসিক প্রবেশদ্বার। লােগার দরজার তালা ভেঙে শাসক দলের কর্মীরা লণ্ডভণ্ড করেছে বিশ্বভারতীর দপ্তর যা টিভির দৌলতে প্রত্যক্ষ করেছে গােটা বিশ্ব। অথচ অবাক কাণ্ড সাংস্কৃতিকমনস্কতায় পরিপুষ্ট এই রাজ্যের সুশীল সমাজ বা তথাকথিত বিদ্বজ্জনেরা মুখে কুলুপ এঁটে শীতঘুমে রয়েছেন। দেশের গর্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই লজ্জাজনক আক্রমণ ও ধ্বংসলীলার ঘটনা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমে প্রকাশিত হতেই নিন্দার ঝড় উঠেছে এই দেশ ছাড়াও বিশ্বজুড়ে। সমালােচনার মুখে পড়েছে। শাসকদল।।
বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতন বাঙ্গালির কাছে তীর্থস্বরূপ। সেই তীর্থের যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন তার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ভুবনডাঙার মাঠের কাছে ২০ বিঘা জমি কিনে নেন। ১৮৬৪ সালে তিনি এখানে একটি একতলা দালানবাড়ি তৈরি করে তার নাম দেন। ‘শান্তিনিকেতন’। এর ২৪ বছর পর ১৮৮৮ সালে দেবেন্দ্রনাথ একটি ট্রাস্ট ডিড তৈরি করে শান্তিকেতন আশ্রমটিকে সর্বসাধারণের জন্য উৎসর্গ করে যান।
১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ পাঁচজন ছাত্র নিয়ে শান্তিনিকেতনে স্থাপন করলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়। সেখানে তিনি প্রাকৃতিক পরিবেশে লেখাপড়া শেখাতে চাইলেন ছাত্রদের। তার পরীক্ষা স্বার্থক হলাে। ধীরে ধীরে ওই বিদ্যালয় ডালপালা বিস্তার করে মহীরুহ হয়ে উঠল। ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হলাে ‘বিশ্বভারতী’ সােসাইটি। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য ছিল শিক্ষার মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক মানবতা বােধ গড়ে তােলা। বিশ্বভারতী হয়ে উঠবে বিশ্বমানের শিক্ষক্ষেত্র, এই আশা দৃঢ়ভাবে। পােষণ করতেন কবি। জাতীয়স্তরে পরিচিতি লাভ করায়, ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদা লাভ করে বিশ্বভারতী।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে জড়িয়ে আছে। বহু বিশ্ববিখ্যাত মানুষের স্মৃতি। এখানে এসেছেন, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, নােবেল জয়ী অমর্ত্য সেন, অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং আরও অনেকে। ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জ, পাঠভবন, সংগীত ভবনের মতাে বিশ্বভারতীর ইতিহাসে জড়িয়ে আছে পৌষমেলাও। এই পৌষমেলায় অংশ নেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাে বটেই বিশ্বের অনেক দেশ থেকেও বহু মানুষ আসেন। সে কারণে পৌষমেলা হয়ে ওঠেবিশ্বমেলা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই মেলার মাঠ ঘেরা শুরু হতেই গােলমাল। শান্তিনিকেতনের অজস্র দ্রষ্টব্যের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে– রবীন্দ্রনাথের বাসগৃহ হিসেবে ব্যবহৃত ছটি বাড়ি—উত্তরায়ণ, উদয়ন, কোনার্ক, পুনশ্চ, উদীচী ও শ্যামলী। শ্যামলী তৈরির সময় ছিল পুরােপুরি মাটির। শান্তিনিকেতনের অন্যতম দ্রষ্টব্য হলাে বিচিত্রা ভবন যা রবীন্দ্র অনুরাগী পাঠক ও গবেষকদের কাছে অমূল্য সম্পদ। শান্তিনিকেতনের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে আছে— কলাভবন, সংগীত ভবন, বিদ্যাভবন, শিক্ষা ভবন, বিনয় ভবন, চীনা ভবন, হিন্দি ভবন, পাঠভবন, সিংহ সদন, গ্রন্থাগার ও ছাতিমতলা।
বিশ্বভারতী থেকে বিশ্বকবির প্রাপ্ত নােবেল পদক চুরির ঘটনায় সারা বিশ্বের সামনে যেমন লজ্জায় বাঙ্গলার মাথা হেট হয়েছিল ঠিক তেমনি শাসকদলের সহযােগিতায় এবারে বিশ্বভারতীর নির্মীয়মাণ পাঁচিল ও ঐতিহাসিক প্রবেশদ্বার ধ্বংসের ঘটনায় আরও একবার বিশ্বজুড়ে কলঙ্কিত হলাে এ রাজ্য। এ কলঙ্ক লেপন শুধু পশ্চিমবঙ্গের গায়ে নয়, বাঙ্গালির গায়ে নয়, এ কলঙ্ক লেপন হলাে ভারতমাতার গায়েও। যারা এ কাজ করলেন এবং যাঁরা এ কাজকে সমর্থন করছেন তাদের উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র একটি শব্দই উপহার দেওয়া যায়— “ছিঃ!
মণীন্দ্র নাথ সাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.