চট্টগ্রামে পটিয়া মুজাফরাবাদ গণহত্যা দিবস ১৯৭১ সালের ৩ রা মে এখানের অসংখ্য বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের পর আলবদর জামাতি মদতপুষ্ট পাকিস্তানি খান সেনারা তাদের এদেশীয় দালালদের সহযোগিতায় সাড়ে তিনশ’ বাঙ্গালি হিন্দুকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ৩ মে। দিনটি ছিল সোমবার। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পটিয়ার মুজাফরাবাদ এলাকায় হঠাৎ ভোরে হানা দেয় পাকিস্তানি সেনারা। এদেশীয় দালালদের সহযোগিতায় পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে তারা। এরপর চালায় বর্বর নির্যাতন। অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, কোন কিছুই বাদ রাখেনি তারা। দিনভর নির্যাতনের পর গ্রামের নারী পুরুষদের ধরে নিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, মা-মেয়ে কেউ রেহাই পায়নি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে।
গণহত্যায় নিহতদের অনেকের পরিবার এখনো অবহেলিত। বাংলাদেশ স্বাধীনতার দীর্ঘ এতো গুলো বছর পরেও অরক্ষিত রয়েছে শহীদদের গণকবর। বিভিন্ন সময়ে সরকার গণকবরটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলেও পরে তা বাস্তবায়িত হয়নি। গণকবরটি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণের আহবান জানিয়েছে স্থানীয়রা ।কয়েক বছর আগে ওই এলাকায় শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করা হয়। স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্পমাল্য দিয়ে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিহতদের স্মরণ করে শহীদদের পরিবার এবং স্থানীয় প্রশাসন।গ্রামটিতে কবরের নীরবতা বিরাজ করছিল।
৩ মে ১৯৭১ মুজাফরাবাদ গণহত্যায় ৮ ঘণ্টায় পাকিবাহিনী প্রায় ৩০০ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তিন বছরের শিশু থেকে শুরু করে শতবর্ষী বৃদ্ধা কেউ রেহাই পাননি পাকিবাহিনীর বর্বরতা থেকে। প্রায় ৩০০ শহীদের মধ্যে একশর কাছাকাছি নারী। যাদের অধিকাংশই মৃত্যুর পূর্বে পাকিবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শহীদের মধ্যে ২৫৫ জনের নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অনেক ধর্ষিত, লাঞ্ছিত নারী এই সময় লজ্জায় গ্রাম ছেড়ে চলে যান। অনেকেই বেঁচে নিয়েছে আত্মহননের পথ। বিশেষ করে বেশ কয়েকজন অষ্টাদশী তরুণী পরিবার পরিজনসহ ভারতে চলে যান। প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় সেইরকম তিনজন বীরাঙ্গনা নারীর বর্ণনা উঠে এসেছে। যাদের দুজন লোকলজ্জার ভয়ে পরবর্তীতে ভারতে চলে যান।
মুজাফরাবাদ গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। এই গণহত্যার প্রকৃতি নির্ধারিত করলে দেখা যায়, এটি মূলত পরিকল্পিত গণহত্যা। খরনা ইউনিয়নের স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতাদের নীল নকশায় এটি ঘটেছে। গণহত্যার মূল মোটিভ ছিল হিন্দু নিধন এবং পরিকল্পিতভাবে হিন্দু নারীদের নির্যাতন। তাদের ঘরবাড়ি লুটপাট করা, জায়গা সম্পত্তি দখল করে নেয়া। পাকিবাহিনীর সঙ্গে বর্বর এই হত্যাযজ্ঞে যোগ দিয়েছিল স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা ও খরনা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রমিজ আহমেদ চৌধুরী। ৩ মে বিকালে রমিজ মিয়া মুজাফরাবাদ গ্রামের সামনে আরাকান সড়কে দাঁড়িয়ে বলছিল, ‘এত তুন পচিম পাড়া দেহা ন যার ক্যা’ (এখান থেকে পশ্চিম পাড়া দেখা যাচ্ছে না কেন) অর্থাৎ পাকিবাহিনী কী জ্বালিয়েছে কিছু গাছের কারণে তিনি পশ্চিম পাড়া পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন না। এছাড়াও স্থানীয় রাজাকার নুরু বক্স ও রমিজ মিয়ার সহকারি হিসেবে সুলতানের নাম প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে।
১৯৭১ সালে ৩ মে’র গণহত্যা এবং পরবর্তীতে স্থানীয় রাজাকার আলবদরদের নিয়মিত আক্রমণ মুজাফরাবাদ গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। গ্রামের বেঁচে থাকা অবশিষ্ট লোকজন পালিয়ে যান গ্রাম থেকে। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরা চলে যান। কেউবা যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের পর শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় লাভকারী গ্রামবাসী, রণাঙ্গনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা আবার ফিরে আসে মুজাফরাবাদে। স্বজনহারানো শোকার্ত পরিবারগুলো আবার ঘুরে দাঁড়ায়। নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় পথচলা। আর নতুন এই পথচলায় তাদের প্রেরণা হয়েছিল ৩ মে ১৯৭১।
সৌমেন ভৌমিক