কল্যাণ গৌতম
( প্রয়াত ড. কাঙ্গাল চন্দ্র দাশ স্মৃতি-তর্পণ )
১৯৮৪ সাল। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ে এগারো ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। উনাকে পেলাম বোটানির শিক্ষক হিসেবে, ট্যাক্সোনমি পড়াতেন। ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে ক্লাস নিতে আসতেন। মিশন কর্তৃপক্ষের বিরোধী ছিলেন না, তাই এসএফআই-ছাত্র আর সিপিএম সমর্থিত শিক্ষকদের দ্বারা অকারণে সমালোচিত হতেন। তখন ওই কলেজে সিপিএম বনাম রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের প্রবল দ্বন্দ্ব ছিল। সিপিএম কলেজের নিয়ন্ত্রণ পেতে মরিয়া। রামকৃষ্ণ মিশনও তিলতিল করে গড়া তোলা কলেজকে রাজনীতির আখড়া করতে নারাজ। কলেজ-শিক্ষকদের অধিকাংশ পার্টি মেম্বার, কিংবা প্রবল সমর্থক। তারা এইকাজে জুটিয়ে নিলেন বহু অশিক্ষক কর্মচারী আর কিছু পথভ্রষ্ট ছাত্রদের।
আশির দশকের শুরু থেকেই ভি. সি. কলেজে তুমুল আন্দোলন, ক্লাস অনিয়মিত। তখন আমি আশ্রমিক; আশ্রমের বাইরে এসএফআই-এর নিয়মিত হুঙ্কার মিছিল, পিছনে প্রবল প্রতাপান্বিত সিপিএম। আন্দোলনের ঢেউ এমন যে, ক্লাস নাইনের কিছু ছেলেকে ওদের হয়ে লড়তে দেখা যাচ্ছে, মিছিলে পা মেলাতে দেখা যাচ্ছে। মাধ্যমিকের পর কলেজে ভর্তি হবো কিনা ঠিক করতে পারছি না। কলেজের অধ্যক্ষ তখন স্বামী শিবময়ানন্দজী মহারাজ। ভর্তির জন্য তালিকা বেরিয়েছে, ইন্টারভিউ হবে। আমি মহারাজকে বললাম, আমার তো বহুদিনের ইচ্ছে এই কলেজে পড়ি, কিন্তু যদি ক্লাস না হয়! মহারাজ বললেন, তোমরা ক্লাস করতে চাইলে কে বারণ করবে? মহারাজের পাশে বসে আছেন আর একজন অধ্যাপক। তিনি বললেন, কী কী সাবজেক্ট নেবে? বললাম ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ আর স্ট্যাটিসটিক্স। অধ্যাপক বলছেন, কেন বায়োলজি নেবে না? বললাম, আমার এডিশনাল ম্যাথ ছিল, তাই স্ট্যাট নেবো। প্রিন্সিপাল মহারাজ কলেজে স্ট্যাটিসটিক্স পড়াতেন; বললেন, বেশ তাই হবে। সেই অধ্যাপক কিন্তু নাছোড়, তখনও লড়ে যাচ্ছেন আমাকে বায়োলজি নিতে হবে। বাবাকে অকালে হারিয়ে আমি রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের অনাথ ছাত্রাবাসে পড়েছি। তাই কী বিষয় নিয়ে পড়লে এইসব ছাত্রদের ভবিষ্যতে ভালো হবে, এমন চুলচেরা বিচার করার মানুষ তখন ছিল। মিশনপন্থী সেই অধ্যাপকের নাম ড. কাঙ্গাল চন্দ্র দাশ। উনি বললেন, তুমি আশ্রমে বাগানের কাজ করেছো কিনা? বললাম, হ্যাঁ, ওসব তো করতে হয় কখনও কখনও; গোলাপ ফোটাতে হয়, সব্জি ফলাতে হয়, বাগান পরিস্কার করতে হয়। মিশনের বাগানে থাকা কয়েকটি বিরল গাছের কথা জানতে চাইলেন। ব্যাস, প্রিন্সিপাল মহারাজের কাছ প্রায় হাইজ্যাক করে, বায়োলজি নেওয়াতে বাধ্য করলেন। মহারাজ হেসে বললেন, আপনি আমার একটি ছাত্র কমিয়ে দিলেন। সেদিন বায়োলজি ছিল বলে আমার কৃষিবিজ্ঞান পড়া সম্ভব হয়েছে, নইলে কোন দিকে আজ জীবনের তরী ভিড়তো কে জানে!
আমার বৈশিষ্ট্য ছিল, অকারণে কাউকে অপমানিত হতে দেখলে, তার পক্ষে ধর্মরক্ষার মতো থাকা। কিছু দুষ্টু ছেলে, ড. কাঙ্গাল চন্দ্র দাশের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবীর পিছনে ফাউন্টেন পেনের কালি ছিটিয়ে দিত; নাম নিয়ে টিটকারি করতো, মিশনপন্থী ছিলেন বলে নানান মুখোরোচক কথাও বলতো। উনি বড্ড পান খেতেন, জিভটা ভারি হয়ে গিয়েছিল, তবে ধূমপান করতেন না। বলতেন আমি মেডিসিনাল বিটিল খাই, তামাক নেই তাতে, পানের দেশের মানুষ তো!
সতীর্থদের অনেককে আমি বলতাম, ‘কাঙ্গাল চন্দ্র’ মানে সর্বহারা, শিব, যাঁর মাথায় চন্দ্র বিরাজ করেন। তিনি বৈরাগ্যের ভিখারি। বালকাশ্রমে অনাথ আশ্রমের ছাত্র ছিলাম আমি, আর উনি কাঙ্গাল চন্দ্র; নামটিতে তখন কেমন একাত্মতা অনুভব করতাম। বাম ঘরানারা কোনো ছেলে ওনার নাম নিয়ে টিটকারি করলে, আমি অসম্ভব রেগে যেতাম, একদমই মিশতাম না আর তার সঙ্গে।
উনার বৈশিষ্ট্য ছিল, কখনোই রাগতেন না, কারও কথায়। সহকর্মীদের কাউকে কাউকে টেরিয়ে কথা বলতে শুনেছি, তাদের ক্ষমা করতে পারি নি। উনি কারও ক্ষতি চান নি কোনোদিন। ১৯৮৬ সালে আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষায় ৪০-এ ২২ পেয়ে ২০০-তে ১৫৩ পেয়েছিলাম; অন্য ভালো ছেলেদের মতো প্র্যাক্টিক্যালে নম্বর পেলেও লেটার ছিল বাঁধা। ফিজিক্সে যথেষ্ট সিরিয়াস ছিলাম, এগারো বারোতে কলেজের পরীক্ষাগুলিতে ফিজিক্স-থিয়োরিতে সম্ভবত হায়েস্ট মার্কস থাকতো। ড. দাশের বিষয়ে এই রকম বঞ্চনার আর্বতে তিনি কখনো থাকতেন বলে শুনিনি।
কলেজ রাজনীতি মুক্ত হয়ে অধ্যয়নের পীঠস্থান হোক, এটা চাইতেন তিনি। আর আপন আনন্দে পড়িয়ে যেতেন, সদাহাস্যজ্বল মুখ। কোনো ক্লাস ফাঁকি পড়তো না, প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের কমতিও হত না কোনোদিন। কলেজে দুই বছর পড়েছি। ১৯৮৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এগ্রিকালচার পড়তে গেলাম। উনি শুনে খুশি হলেন। বললেন, যাক অনেক বোটানি থাকবে, প্রয়োজন হলে এসো, বুঝিয়ে দেবো। যদিও পরে আর উনার কাছে পড়তে যাওয়া হয় নি।
রহড়ায় থাকতেন, প্রায়ই দেখা হত, কুশলাদি বাক্য বিনিময় হত। সব সময় পড়ার খবর নিতেন। সতেরো-আঠেরো বছর আগে জানতে পারলাম তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের একটি কলেজে প্রিন্সিপাল হয়ে চলে গেছেন। নিজের জেলায় একটি কলেজ, শুনেছি সেখানে ভালোবেসে এডমিনিস্ট্রেশনে গেলেন। তারপর দীর্ঘদিন আর দেখা হয় নি।
বছর দুয়েক আগে আবার দেখা। তার আগে ওনার ফোন পেলাম হঠাৎ । প্রজ্ঞাপ্রবাহের কার্যকর্তা শ্রী অরবিন্দ দাশের কাছে শুনেছিলাম উনি যুক্ত আছেন তাঁর সংগঠনে। অরবিন্দ দাদাকে বললাম, আমি চিনি ওনাকে, আমার কলেজের শিক্ষক। জানতে পেরে তিনি নিজেই ফোন করলেন একদিন। একঘন্টা কথা হল সন্ধ্যায়। কত পুরনো কথা, কত পরিকল্পনার কথা বললেন। অতুল্য ভারতের সুবাসকে কীভাবে ছাত্রদের মধ্যে প্রোথিত করতে হবে, সেটাই ছিল তাঁর ইদানীং কালের ধ্যানজ্ঞান। জীবনে তিনি দুঃখও অনেক সয়েছেন; বলতেন বেদনা তাঁরই দান। আমার মনে পড়লো কবিগুরু কথা, “বেদনা যদি দাও হে প্রভু/ক্ষমতা দাও সহিবারে/ হৃদয় আমার যোগ্য করো/তোমার বাণী বহিবারে।” নিজের পুত্র সন্তানের মৃত্যু সইতে হয়েছিল ওনাকে, নিজের পত্নী বিয়োগ হয়েছিল। একাই থাকতেন বাড়িতে। কন্যা বিবাহিতা, অন্যত্র থাকেন। দরজা খুলেই তাই শুতেন। বলতেন, কী আর আছে আমার! চোর আমার কাছে কিছু নেবে না, সুযোগ পেলে বলবো, কী চাও বলো? বহু মানুষকে ধানধ্যান করতেন। অনেক ছেলের পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছেন, জেনেছি। যে রাত্রে তাঁর স্ট্রোক হল, সেদিন বিছানা থেকে পড়ে ছিলেন একাকী সারারাত। পরদিন মর্নিং ওয়াকের সাথীরা না পেয়ে ফোন করেছিলেন, উত্তর পান নি, এসে দেখলেন নীরবে পড়ে রয়েছেন তিনি, বাকশক্তি রহিত। সঙ্গে সঙ্গে মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। তারা পারলেন না, চলে গেলেন কোমায়। কলকাতায় পাঠানো হল, একবার যেন মনে হল দেহযন্ত্র সচল হচ্ছে, সাড়া দিচ্ছেন তিনি, চোখ মেলছেন। কোভিড টেস্ট নেগেটিভ এলো, মস্তিষ্কের জমা রক্ত খানিকটা অস্ত্রোপচার করে বের করা হল। কিন্তু সাড়া মিললো না পুরোপুরি। একইভাবে বেশ কিছুদিন এইভাবে গেলো, নীরব, নিঃস্পন্দ। অবশেষে ১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২০, তিনি চলে গেলেন অমৃতলোকে। ১ লা সেপ্টেম্বর দিনটির প্রতি তাঁর আলাদা টান ছিল, কারণ এটি রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা দিবস। ওই দিন আশ্রমে যেতেন তিনি আশ্রমিক সান্নিধ্যে, ছাত্র, কর্মচারী, সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে কাটাতেন। অনাথ ছাত্রদের প্রতি বিশেষ স্নেহ ছিল। আর এই দিন চলে গেলেন রামকৃষ্ণলোকে। উনি মোবাইলের ডিপি চিত্র দিয়েছিলেন ‘The Hindu monk of India’ লেখা স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, যেটা বাড়িতে ঝুলতো চোখের সামনে। হিন্দু হিসাবে সবসময় গর্ব বোধ করতেন, হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি ছিল অসামান্য শ্রদ্ধা; পড়তেন, সংগ্রহ করতেন নানান ধর্ম সংস্কৃতির বই। প্রজ্ঞাপ্রবাহের কাঁথি চর্চাকেন্দ্রটি নিজের সৌকর্যে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত চর্চা হচ্ছে। দেশের মাটি গোষ্ঠীর পূর্ব মেদিনীপুর জেলা গ্রুপের সদস্য ও এডমিন ছিলেন। তাঁর শেষ বৌদ্ধিক শুনেছি গত গুরুপূর্ণিমা উপলক্ষে উপস্থাপিত গুরুবন্দনা বিষয়ক বক্তব্য। উনি ৫ ই সেপ্টেম্বর নয়, গুরুপূর্ণিমা দিবসটিকে ভারতীয় শিক্ষক দিবস হিসাবে পালনে বিশ্বাসী ছিলেন। এবছর অজস্র যুক্তিসহ জোরালো সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। এই দিনটি দেখবার আশা ছিল তাঁর। বিশ্বাস করতেন এই দিনটি খুব তাড়াতাড়িই আসবে; ভারতের বৌদ্ধিক জগতেও দ্রুত পরিবর্তন হবে। বছর খানিক আগে একদিন আলাপচারিতায় বললেন, আমি নিজের সঙ্গে অহরহ কথা বলি। আমি বললাম, তা তো আমি জানি, ১৯৮৪ সাল থেকে খেয়াল করেছি। মাঝে মাঝে পড়াতে পড়াতে আপনি নিমেষের জন্য হারিয়ে যেতেন, আবার ফিরতেন। যুগপৎ দু’টি জগতে হয়তো হাজিরা দিতেন, এটা করতে পারতেন বলে মুখের মধ্যে একটা দিব্য আনন্দের ঝলক থাকতো সবসময়। জীবনের প্রতি সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিরাটের প্রতি প্রবল আস্থা তাঁকে এক অনবদ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী করেছিল। সকলকে মন থেকে ভালোবাসতেন, সকলের উন্নতিতে খুশি হতেন, আনন্দ পেতেন।
ভিখারি শিবের মধ্যে বৈরাগ্য ছিল, তাঁর ভিক্ষাবৃত্তি যে দীনতা নয়, ওটা যে বৈরাগ্য চেয়ে নেওয়ার কাঙ্গালত্ত — এই নাম মাহাত্ম্য সেদিনের বামপন্থী ছাত্র যুবদের চিন্তনের বাইরে ছিল বলেই তারা এত ফাঁপা নির্যাতন করতে প্রয়াস পেয়েছিল। নাম নিয়ে ঠাট্টা — এই প্রয়াস তাদের অহরহ দীন করেছে, আর উনি স্নেহের হাত বুলিয়ে সেই দীনতা বারে বারে ক্ষমা করেছেন।