শ্রীকৃষ্ণরূপী মােতলগজী


শ্রীকৃষ্ণের মতাে সমস্ত দৈবীগুণের অধিকারী না হলেও মােতলগজীর মধ্যে দৈবীগুণের প্রভাব লক্ষণীয়। তিনি যেভাবে আমার বা আমাদের সামনে এসেছেন তাতেই তাঁর গুণের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। তিনি ছিলেন মিতভাষী, মিষ্টভাষী, বিচক্ষণ, লােককে বুঝানাের ক্ষমতার অধিকারী। দৃষ্টি ছিল মর্মভেদী এবং দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সদর্থক। ফলে সাধারণ অনাড়ম্বর জীবন ছিল তাঁর (অবশ্য এটা প্রচারক মাত্রেরই গুণ)। প্রতি পদক্ষেপে অভিজ্ঞতার ছাপ ছিল। মনে হয় তার ব্যক্তিত্ব ছিল সহজাত। এগুলি যে অতিশয়ােক্তি নয়। তার প্রমাণতার সান্নিধ্যে যখনই এসেছি তখনই পেয়েছি। এমনকী তার রসিকতাও ছিল মাধুর্যপূর্ণ ও শিক্ষণীয়।
একবার কলকাতার বৈঠকে (তখন প্রান্ত ভাগ হয়নি) আমরাও এসেছিলাম। বৈঠকে হঠাৎ গােবিন্দাচার্যজী (তখন বিজেপি-র দায়িত্বে) এলেন। তাঁকে মঞ্চে মােতলগজীর পাশেই বসানাে হলাে। গােবিন্দাচার্যজীর গায়ের রং কুচকুচে কালাে। পরিচয়ের পরে গােবিন্দাচার্য চলে গেলেন। তখন মােতলগজী বললেন—“আমি এতক্ষণ ফর্সা ছিলাম, আবার কালাে হয়ে গেলাম। হয়তাে অনেকেরই মনে আছে, কিন্তু সেই কথা আমি ভুলতে পারিনি।
তখন সরকার্যবাহ ছিলেন শেষাত্ৰীজী। তার পত্র অনুসারে আমরা জনজাগরণ অভিযান চালাব। আমরা কলকাতার বৈঠকে। তৎকালীন বিজেপি সভাপতি বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী আমাকে কেশব ভবনে গণেশদার (দেবশর্মা) ঘরে নিয়ে গেলেন। তার সামনেই শাস্ত্রীজী বললেন, ‘তপন শিকদার মালদায় দাঁড়াবে, তােমরা দেখাে। যা খরচ হবে আমি দেব।আমি রাজি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখি। মােতলগজী দাঁড়িয়ে, তার মর্মভেদী দৃষ্টি আমার দিকে। বললেন কী কথা হলাে? আমি বললাম সব। জিজ্ঞেস করলেন টাকার কথা। আমি আনন্দের সঙ্গে বললাম তিনি সব দিবেন। মােতলগজী বললেন , ‘খুব খুশি তাই না— এক পয়সা নেবে না, যা দেওয়ার আমি পাঠাব। সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পেলাম। কারণ ওই বিজেপি-র টাকা পেয়ে আমার মধ্যে নানারকম অবগুণ আসতে পারে, সেটা হতে দেওয়া যাবে না তাই তাঁর এই কথা, এই ধারণাই আমার হলাে।
মালদার একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে। আমাদের তৎকালীন কার্যকর্তাদের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝি হয়েছিল। তিনি এলেন, দু’মিনিটেই তাঁর কথায় সব ঠিক হয়ে গেল। এই ছিল তাঁর ক্ষমতা। একবার মালদায় সঙ্ঘশিক্ষাবর্গ (২য় বর্ষ) হবে। আমরা জায়গা দেখে বেড়াচ্ছি। সঙ্গে মােতলগজী। কোথায় প্যান্ডেল হবে, কোথায় রান্নাঘর, বসতি সব বিষয়ে কথা হচ্ছে। প্রতি কথাতেই তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন লক্ষ্য করেছিলাম।
তাকে কোনও সময়েই দীর্ঘ বক্তব্য রাখতে দেখিনি। তিনি বলতেন, সঙ্ঘ জেনারেটার। বিদ্যুৎ তৈরি করবে। সেই বিদ্যুতে বাল্ব, পাখা যেমন চলে, সেরকম সঙ্ঘ সমস্ত ক্ষেত্রকে আলােকিত ও চলমান করবে। মনে রাখার মতাে উপমা বলেই বার বার মনে পড়ে। বহুবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। প্রত্যেকবারেই কিছু শিখেছি, তাতে অভিজ্ঞতা বেড়েছে। তিনি শেষ সময়ে নাগপুর সঙ্রে প্রধান কার্যালয়ে থাকতেন। সেখানে কর্মসূত্রে মালদার। স্বয়ংসেবক সঞ্জয় সাহাকে যাতায়াত করতে হয়। একবার সে ফিরে এসে বলল, একজন বয়স্কলােকের সঙ্গে দেখা হলাে, আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। ফোন নম্বর দিয়েছেন, ফোন করতে বলেছেন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম। মােতলগজী বললেন, কী আমার কথা মনে আছে? আমি লজ্জায় বললাম, ছি ছি কী বলছেন! আপনার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্ত মনে আছে। বেশি কথা বলতে পারলেন না। ফোন কেটে দিলাম। এই অল্প সান্নিধ্যেই যদি আমার এই অভিজ্ঞতা হয় তবে তার সঙ্গে যারা থেকেছেন, বেশি সময় কাটিয়েছেন, তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি কত না বড়াে।।
তিনি চলে গেছেন, কিন্তু দাগ কেটে গেছেন আমার মতাে হাজারাে স্বয়ংসেবকের মনে।
বিদ্রোহী কুমার সরকার
(লেখক পূর্বতন প্রান্ত সঙ্ঘচালক, উত্তরবঙ্গ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.