শ্রীকৃষ্ণজীর এভাবে হঠাৎ চলে যাওয়া আমাদের সকলকে এক গভীর আঘাত করে গেছে। সঙ্ঘকার্য করার সময় প্রথমবার শ্রীকৃষ্ণজীর নামের সঙ্গে পরিচয়। সামনাসামনি পরিচয় অনেক পরে। নাগপুরে সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ চলার সময় প্রথমবার দেখা হয়। সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গের ব্যবস্থার দায়িত্বে নিমগ্ন হয়ে থাকতে দেখা যেত তাকে।।
এর পরে কল্যাণীতে সঙ্ঘের মহাশিবিরের কথা মনে আসে। তখন শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। প্রচণ্ড প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও সঙ্ঘের কাজ দাঁড় করানাে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা আজ বুঝতে পারি। সুদর্শনজীর সহায়ক হিসেবে অসম ক্ষেত্রে পৌঁছে, সেখানকার তদানীন্তন পরিস্থিতির নিরিখেও শ্রীকৃষ্ণজী ঠিক কেমন ভাবে কাজ করছেন তা স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারতাম। মণিপুরের সেই ভয়াবহ আতঙ্কের পরিবেশেও সঙ্ঘের পবিত্র জ্যোতিকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্বও তিনি খুব সহজেই পালন করতে পেরেছেন।
স্থানীয় ভাবে সঙ্ঘের কাজ দাঁড়ক এবিষয়ে শ্রীকৃষ্ণজীর সর্বদা আগ্রহ থাকত। মণিপুরে মতাে প্রান্তে তাঁর একক প্রচেষ্টায় ৭-৮ জন করে স্থানীয় বিস্তারক বের হতে শুরু করে। সঙ্ঘকার্য খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পেতে পারে এই বিশ্বাস আমি তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি।
সমগ্র অসম ক্ষেত্রের সঙ্কর্যকে সঠিক দিকে পরিচালন করতে তিনি বিশেষ যত্নশীল ছিলেন। সময়ের নিরিখে তা সঠিক পদক্ষেপ ছিল। প্রতিক্রিয়ার বদলে সঙ্ঘের ভূমিকা ঠিক কতটা গঠনমূলক ও রচনাত্মক হওয়া। প্রয়ােজন, এটিই তার বৌদ্ধিকসমূহের মূল বিষয় হয়ে থাকত। সেই সময়কালের যেসব । যুবক কার্যকর্তা ‘ক্রিয়ার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়া এই মতবাদের বদলে সঠিক পদ্ধতিতে সঙ্কে জানার ও বােঝার চেষ্টা করেন, তারাই বর্তমানে অসম ক্ষেত্রের সম্পূর্ণ পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছেন। এর পিছনে শ্রীকৃষ্ণজীর অবদান অনস্বীকার্য। | আমি যখন অরণাচল প্রদেশে সঘকাজে যাই, তখন এই পথনির্দেশই আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি। প্রথম দিক থেকেই স্থানীয় কার্যকর্তাদের দ্বারা সঙ্কর্যকে বৃদ্ধি। করে এগিয়ে চলার প্রচেষ্টা সেই দিশারই অঙ্গ। পাহাড়ি অঞ্চলে অনেক বিবিধতা থাকে, আবার কিছু অহংবােধও থাকে। সুতরাং স্থানীয়ভাবে কাজ হােক, আলাদা প্রশিক্ষণ বর্গ হােক বিষয়ে আমরা সবাই
বিশেষভাবে যত্নশীল থাকতাম। মােতলগজী স্বয়ং নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রবাস করে কার্যকর্তাদের এবিষয়ে উৎসাহ প্রদান করতেন।
শ্রীকৃষ্ণজী যখন পশ্চিমবঙ্গে আসেন তখন এখানে কমিউনিস্ট শাসন চলছে। গণতন্ত্র বিরােধী, হিন্দু বিরােধী এবং দেশবিরােধী বিচারধারা সমগ্র সমাজে প্রবলভাবে বিস্তার করেছে। জরুরি অবস্থার পরে সমগ্র দেশব্যাপী স্বাভিমানের ঢেউ উঠতে শুরু করে, যা কালক্রমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে দিন বদলের সূচনা করে। এই সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষে এমন অনেক আন্দোলন শুরু হয়, যার ফলে পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। সবার মনে তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে শুরু হয় যে ,পশ্চিমবঙ্গে কী ঘটতে চলেছে? মােতলগজী জানতেন যে, পশ্চিমবঙ্গে এই পরিবর্তন বাকি দেশের মতাে স্বাভাবিক হবে না। কিন্তু দেশব্যাপী যে আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল, সেই ঢেউকে সমগ্র বাঙ্গালি সমাজের কাছে এক অনন্ত শক্তিধারা রূপে পৌঁছে দেওয়ার পবিত্র কাজে তিনি নিজেকে যুক্ত করেন। এর ফলস্বরূপ জরুরি অবস্থাকালীন আন্দোলন, একাত্মতা রথযাত্রা, রামমন্দির আন্দোলন প্রভৃতি নানাবিধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের স্বাভিমান জাগরণ ক্রমাগত বেড়ে চলতে থাকে। আজকের দিনে আমরা সেদিনের সেই জাগরণকে দৃপ্তপদে এগিয়ে যেতে দেখার অনুভব করছি। আজকের বঙ্গসমাজের স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে রামনবমী উৎসব পালন এবং তাতে অংশগ্রহণ- এই দীর্ঘ যাত্রার একটি ছােটো উদাহরণ মাত্র। এখন দিনের আলাের মতাে স্পষ্ট যে, হিন্দুত্বের নবজাগরণে পশ্চিমবঙ্গ আর পিছিয়ে থাকবে না।
কার্যক্ষেত্রে সমাজের ক্লেশ দূরীকরণ, তার সঙ্গে সঙ্গে সমাজকে এমন শক্তিশালী করে তােলা, যাতে কোনােরূপ ক্লেশের চিহ্নমাত্র না আসে। আর তাই হবে সমাজের জন্য নিবেদিত শ্রেষ্ঠ কর্ম। সঙ্ঘের এই চিন্তাধারাকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শ্রীকৃষ্ণজী সারাজীবন করে গেছেন। পরম পূজনীয় ডাক্তারজীর পথে চলতে শুরু করা প্রতিটি মানুষ এক অখণ্ড সংকল্পমন্ত্রে দীক্ষালাভ করেন, যে মন্ত্র সারাজীবনের মতাে তার চলার পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়–
লক্ষ্য প্রাপ্তির বলিবেদী পরে
তন মন সবই ঢালাে
শক্তি থাকুক ভরপুর প্রাণে,
হৃদয়ে আগুন জ্বালাে।।
প্রদীপ যােশী
(লেখক পূর্ব ক্ষেত্র প্রচারক)
2020-08-31