দেশে জরুরি অবস্থা উঠে যাবার পর ১৯৭৮ সালে তৃতীয় বর্ষ সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গের জন্য নাগপুর গিয়েছিলাম। বর্গ উদ্বোধন হবার পরের দিন চর্চাগটের কালাংশে শ্রীকৃষ্ণদাকে প্রথম দশর্ন করার সুযােগ পেয়েছিলাম। নাগপুরের প্রান্ত প্রচারক বালুজী চর্চাপ্রবর্তক হিসেবে আমাদের চর্চাগটে চর্চা নিতে এসেছিলেন। প্রচারকদের ওই চর্চাগটে বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীও শিক্ষার্থী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণদা কত কঠিন বিষয় কত সহজভাবে চর্চাগটে বিশ্লেষণ করতেন। সেই বর্গে অসম ও মণিপুর হতে ৭ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিল। হিন্দিতে কথা বলা তাদের পক্ষে কষ্ট হতাে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণদা তাদের মুখ থেকেও চর্চা বিষয়ের উপর বিন্দু বের করে আনতে নানান পদ্ধতি প্রয়ােগ করেছিলেন। কারণ তাদেরকেও তাঁদের প্রান্তে একটি সর্বভারতীয় সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।
এর পর সম্ভবত ১৯৮১ সাল, কোচবিহারের জেলা প্রচারক হিসেবে মালদহ বর্গে অংশগ্রহণ করেছি, দেখলাম সেই মানুষটি আমাদের সহ-প্রান্ত প্রচারক হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। কাছে গিয়ে প্রণাম করতেই বললেন, কী বলরাম কেমন আছাে। বুঝলাম বঙ্গপ্রদেশে কাজ করতে হবে বলে ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে শুরু করে দিয়েছেন।
পরবর্তীকালে আমার সুন্দরবন জেলা প্রচারক হিসেবে দায়িত্ব থাকাতে মাঝে মাঝেই ২৬নং নিবাসে আসতাম।শ্রীকৃষ্ণদার কাজের ও আপনত্বের ভাব কতটা গভীরে সেটা অনুভব হতাে। সর্বদা স্বয়ংসেবকদের উপর সংস্কারের ছাপ ফেলতে তৎপর থাকতেন। ২৬ নং নিবাসে কোনােদিনই প্রথম পঙক্তিতে ভােজন করতেন না, বেশি আগ্রহ করলে বলতেন, তােমরা হলে আজকের বিশেষ অতিথি, সুতরাং তােমরা প্রথম পঙক্তিতে ভােজন করবে। সেই সময় কয়েকদিন ২৬ নং নিবাসে অসুস্থ হয়ে। শ্রীকৃষ্ণদার ঘরেই চিকিৎসার জন্য ছিলাম, খাওয়ার রুচি না থাকার জন্য শ্রীকৃষ্ণদা নিজের হাতে বাটি নিয়ে আমাকে জোর করে খাওয়াতেন। কারণ জেলা প্রচারককে শীঘ্র সুস্থ হয়ে কার্যক্ষেত্রে ফিরতে হবে।
যখনই তঁাকে জেলাতে প্রবাসের জন্য আগ্রহ করতাম, না বলতেন না। বর্ষাকাল, দক্ষিণ শেহরদহ (ডায়মন্ড হারবার) গ্রামের শাখার বনভােজন ছিল। এই গ্রামেরই স্বয়ংসেবক ছিল কাঞ্চন চক্রবর্তী, ত্রিপুরাতে যে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণদা বনভােজনে উপস্থিত ছিলেন। বনভােজনের শেষে হাঁটাপথে শেহরদহ গ্রামে ফিরতে হয়, কারণ ওই গ্রামেই শ্রীকৃষ্ণদার রাত্রিবাস ঠিক করা ছিল।
তিনি যখন ক্ষেত্র প্রচারক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে অসমে এসেছিলেন তখন আমি ধুবড়ী বিভাগ প্রচারক। অসম, ত্রিপুরা, মণিপুর সর্বত্র শ্রীকৃষ্ণ দা বিস্তৃতভাবে প্রবাস করেছিলেন। উত্তর পূর্বাঞ্চলের সকল কার্যকর্তাদের খুব নিকট থেকেই তিনি দেখেছেন এবং সেখানকার কার্য বৃদ্ধিতে সর্বদা পরামর্শ দিয়েছিলেন। অসমের
সঙ্কাজের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্য করে বিভাগ অনুসারে প্রবাস করেছিলেন। যুব কার্যকর্তাদের বৈঠকে সময় সমর্পণের জন্য উৎসাহ দিতেন। এর পরিণাম স্বরূপ ৫০ জন প্রচারক নতুন করে বেরিয়েছিল। সেই ব্যাচেরই প্রচারক মানিক চন্দ্র দাস, পরবর্তীকালে উত্তর অসম প্রান্তের প্রান্ত প্রচারকের দায়িত্ব পালন করেন। কুমুদ বটঠাকুর, একজন সিনিয়র শিক্ষকও তার আহ্বানে প্রচারক বের হন। আজ আমরা উত্তর পূর্বাঞ্চলের যে পরিবর্তন দেখছি তার প্রেরণাকেন্দ্রে যাঁদের নাম আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রীকৃষ্ণ মােতলগ।। অখিল ভারতীয় অধিকারী হিসেবে সুদর্শনজী উত্তর পূর্বাঞ্চলে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণদা সেই কাজকেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সাত রাজ্যকে নিয়ে অসম ক্ষেত্রের প্রতিটি প্রান্তের সঙ্কাজকে সুদৃঢ় করার জন্য অনেকবার তিনি বিস্তৃতভাবে প্রবাস করেন। আমার শিলচর বিভাগের প্রচারক দায়িত্ব পাওয়ার পর শ্রীকৃষ্ণদার একবার প্রবাস ছিল। ব্যবস্থার বিষয়ে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অসম্পূর্ণ ছিল, সেসব কাজ দ্রুত সম্পূর্ণ করার আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
নবীনদের কাজ শিখাতে সব ধরনের প্রয়ােগ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। বাল্যকাল থেকে স্বয়ংসেবক হিসেবে শুনে আসছি, তামিলনাড়ু, অসম, তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলে কাজের বিষয়ে বলা হতাে, Hard nut to crack, সেই সব স্থানেও Ice breaking-এর কাজ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণদা।
সঙ্ঘের প্রথম ৩০-৪০ বছর প্রাতঃস্মরণীয় ডাক্তারজী, শ্রীগুরজী ও বালাসাহেবজী যে ধরনের কার্যকর্তা তৈরি করেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণদা তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁর সান্নিধ্য যারা পেয়েছিলেন তারা সেটা অনুভব করেছেন। শ্রীকৃষ্ণদার অকৃত্রিম ভালােবাসা ও আপনত্ব বােধের জন্য পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বয়ংসেবকদের বাড়ির সদস্যরা আজও শ্রীকৃষ্ণদাকে মনে রেখেছেন। তাঁকে আমার শত শত প্রণাম। পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, শ্রীকৃষ্ণদার অমর আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।। হে মহাজীবন তুমি কোটি কোটি অন্তরে শুভ চেতনার দীপ যাও জ্বালিয়ে।
বলরাম দাসরায়
(লেখক পূর্ব ক্ষেত্ৰ বৌদ্ধিক প্রমুখ)
2020-08-31