রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ইতিহাসে নাগপুরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। রত্নপ্রসবিনী নাগপুর। নাগপুরের অন্যতম একটি রত্ন শ্রীকৃষ্ণ মােতলগ গত ২ আগস্ট রবিবার রাত ৮-৪৫ মিনিটে অমৃতলােকে গমন করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
আমার সঙ্গে মােতলগজীর পরিচয় ১৯৬২ সাল থেকে। ৬২ সালে আমার সঙ্ঘের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষা হয়।। মােতলগজী আমার শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘ বছরের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। নাগপুরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের। সন্তান। নাগপুরে বালুজী নামে পরিচিত ছিলেন। বি.ই. সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সঙ্ঘের প্রচারক হন। তখন নাগপুর শহরকে একটি প্রান্তের মর্যাদা দেওয়া হতাে। মােতলগজী নাগপুর প্রান্ত প্রচারক ছিলেন। পরে তিনি অসমে প্রচারক হিসেবে যান। প্রথমে বিভাগ প্রচারক পরে অসমের প্রান্ত প্রচারকের দায়িত্ব পালন করেন। অসমে সঙ্ঘ কাজের বিস্তারে মােতলগজীর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অসম থেকে তিনি পশ্চিমবঙ্গে আসেন। এখানে সহ-প্রান্ত প্রচারক, পরে প্রান্ত প্রচারকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মনে প্রাণে বাঙ্গালি হয়ে গেছিলেন। অনায়াসে বিশুদ্ধ বাংলায় ভাষণ দিতেন। তখন পশ্চিমবঙ্গ ও অসম নিয়ে ছিল পূর্বক্ষেত্র। তিনি ক্ষেত্র প্রচারকের দায়িত্ব পেলেন। গৌহাটি তার কেন্দ্র হলাে। ক্ষেত্র প্রচারক হিসেবে তার অন্যতম বড়াে কাজ অসমের কার্যকর্তা শ্যামল সেনগুপ্তকে কলকাতায় নিয়ে আসা। শ্যামলদা ছিলেন উচ্চ কোটির গৃহী কার্যকর্তা। তিনি কলকাতা মহানগর কার্যবাহ এবং পরে ক্ষেত্র কার্যবাহের দায়িত্ব যােগ্যতার সঙ্গে পালন করছিলেন। মােতলগজী ক্ষেত্র প্রচারক থাকাকালীন তার কেন্দ্র ছিল। গৌহাটি। সেই সময় আগরতলায় একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা ঘরে। ক্ষেত্র কার্যবহ শ্যামল সেনগুপ্তের প্রবাস ছিল আগরতলায়। আগরতলায় তিনি কাঞ্চনছড়ায় বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের ছাত্রাবাস পরিদর্শনে যান। তার সঙ্গে ছিলেন আগরতলার তিনজন প্রবীণ প্রচারক— দীনেন দে, সুধাময় দত্ত ও কাঞ্চন চক্রবর্তী। ছাত্রাবাস থেকে খ্রিস্টান উগ্রবাদীরা (এনএলএফটি) এই চারজন কার্যকর্তাকে তুলে নিয়ে যায় এবং প্রায় দু-বছর ধরে বিভিন্ন জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে নির্মম ভাবে হত্যা করে। তখন আগরতলায় সিপিএমের সরকার। তারা এদের উদ্ধারের কোনাে চেষ্টা করেনি। কেন্দ্রের বাজপেয়ী-আদবাণীর সরকারও এদের উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। মােতলগজী এদের উদ্ধারের জন্য সর্ববিধ প্রয়াস করেছেন। ওই সময় কলকাতায়। মােতলগজীর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে। তার চিন্তাক্লিষ্ট বেদনাক্লিষ্ট চেহারা দেখেছি। এই চারজন কার্যকর্তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের বেদনা মােতলগজী আমৃত্যু বয়ে বেড়িয়েছেন।
মােতলগজী মৃদুভাষী, সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী ছিলেন। আমি কখনও তাঁকে রাগতে দেখিনি। কলকাতার কেশব ভবন নির্মাণে মােতলগজীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অসুস্থ অবস্থায় তিনি নাগপুরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হেডগেওয়ার ভবনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ঈশ্বরের দেওয়া মনুষ্যজীবন তিনি ঈশ্বরীয় কাজেই সমর্পণ করেছিলেন। পঞ্চভূতে বিলীন তার পার্থিব শরীর। তার আত্মার প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই।
রণেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
(লেখক পূবর্তন ক্ষেত্র কার্যবাহ)
2020-08-31