আমাদের মােতলগজী


শ্রীকৃষ্ণরাও মােতলগ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের একজন প্রচারক। সঙ্ঘের প্রচারক পদ্ধতি এমনই যে যেখানে কাজ, কাজের দায়িত্ব বা কাজের ক্ষেত্র কোনওটাই ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয়। গত প্রায় পঁচানব্বই বছর ধরে এরকম শত শত প্রচারক রয়েছেন যাঁরা সঙ্ঘের পরামর্শ মতাে সম্পূর্ণ জীবনই স্বদেশ ও সমাজের কাজে আত্মােৎসর্গ করে গিয়েছেন, কিন্তু রয়ে গেছেন লােকচক্ষুর । অন্তরালে। পশ্চিমবঙ্গেও ভিন্ন রাজ্য থেকে এমন বহু প্রচারক এসেছেন, এমনকী প্রায় সারা জীবন বাঙ্গলাতেই কাটিয়েছেন, কিন্তু এখন বিস্মৃতপ্রায়। মােতলগজী— তিনি এই নামেই পরিচিত ছিলেন। বাঙ্গলায় বহু বছর কাটিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে নাগপুরে ফিরে গিয়েছেন। সেখানে খুব বেশিদিনের ব্যবধানে নয়, শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এদিক থেকে তিনি এক ‘আত্মলােপী’মানুষ।
মােতলগজীর সঙ্গে পরিচয় প্রায় ৫৫ বছরের বেশি সময়ের, ১৯৬৩ সালে সঙ্ঘের প্রথমবর্ষ শিক্ষা বর্গে যােগ দিতে গিয়ে।। বর্ধমানের মােহন্ত স্থলে অনুষ্ঠিত বাঙ্গলা-অসম প্রদেশের যৌথ ওটিসি-তে (সদ্যশিক্ষা বর্গ) অসম থেকে তিনি শিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন। সঙ্গী শ্রী শশীকান্ত চৌহাইওয়ালে—যিনি তারই মতাে একজন। প্রচারক এবং এখন অসমেই রয়েছেন। এর পর আবার দেখা হয় ১৯৬৯-তে নাগপুরে তৃতীয় বর্ষে গিয়ে। তখন নাগপুর সঙ্ঘের একটা প্রদেশ হিসেবে গণ্য হতাে। তিনি তখন নাগপুরের প্রান্ত প্রচারক। নাগপুরে তার পরিচিতি ‘বালুজী’ নামে। বর্তমান সরসঙ্চালক ছিলেন সেই বর্গে একজন শিক্ষক হিসেবে। সেসময় একবার মােত লগজীর মাতৃ দেবীকেও দেখে এসেছিলাম তার স্কুটারের পেছনে চেপে। আমাদের প্রদেশের প্রবীণ প্রচারক বিজয় কুলকর্ণী তার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে অনেক কথাই বলতে পারবেন। কেননা, তাদের দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল।
এর পর মালদায় সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গে (১৯৮১ সাল), হঠাৎ একদিন দেখি— মােরপন্ত পিংলেজীর সঙ্গে মােতলগজী এসেছেন। এবং বাঙ্গলার সহ-প্রান্ত প্রচারক হিসেবে। ভালােই লাগল পুরানাে পরিচয়ের একজন মানুষকে পেয়ে। সেই থেকে বছরখানেক আগে পর্যন্ত তার সঙ্গে কাজ করার সুযােগ হয়েছে।
মােতলগজী ছিলেন মিতবাক। তবে তিনি রসকষহীন ছিলেন এমন বলা যাবে না। কোনও অসুবিধে বুঝলে তিনি মজা করে বলতেন, এটা আমাদের প্রিন্সিপ্যাল, পলিসি নয়। আর ব্যবহারেও কোনও দেখনদারি ভাব
ছিল না। অথচ মন জুগিয়ে চলার মতাে তিনি মানুষ ছিলেন না। সঙ্ঘের আদর্শের প্রতি কতটা ‘কমিটমেন্ট’বা নিষ্ঠা তিনি খতিয়ে দেখতে পিছপা হতেন না। একজন কার্যকর্তা অমরনাথ তীর্থ দর্শনে যেতে চাইলে প্রত্যুত্তরের জন্য তিনি কয়েকদিন অপেক্ষা করতে বললেন, পরে আবার জিজ্ঞাসা করলে এখন না যাওয়াই ভালাে বলে। জানালেন। কার্যকর্তাটির অবশ্য যাওয়ার খুবই ইচ্ছা ছিল, যাওয়ার ব্যবস্থাও প্রায় পাকা। করে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কথা মেনে নিয়েছিলেন। আবার এরকম। একজন মানুষের সংস্পর্শে এসে আমরা যাকে ‘লােফার’ বলি, তারও কেমন ‘উত্তরণ ঘটে, সেটাও প্রত্যক্ষ করেছি। বহু পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল বাড়ির একজনের। মতােই। একবার এক স্বয়ংসেবকের ফ্ল্যাট কেনার মতাে বিষয়েও তিনি মধ্যস্থতা করেছিলেন।
তার জীবনের একটা বড়াে বেদনাদায়ক ঘটনা— বিশেষত বাঙ্গলা ও অসম নিয়ে যে ক্ষেত্র, তার ক্ষেত্র প্রচারক হিসেবে। ত্রিপুরায় চারজন স্বয়ংসেবকের অপহরণ ও হত্যা। শ্যামলকান্তি সেনগুপ্তের পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল সেই শিলচর থেকেই। সুধাময় দত্তকে স্বস্তিকা দপ্তর থেকে আগরতলা বিভাগ প্রচারক হিসাবে নিযুক্তি, তারই তত্ত্বাবধানে হয়েছিল।তার কার্যকালে বাঙ্গলা ও অসম দুই প্রদেশেইশাসক দল ছিল বিরােধী আদর্শের। শুধু আদর্শের নয়,
শত্রুতারও। এসবের মােকাবিলা করে সঙ্ঘের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কতটা ‘কণ্টকাকীর্ণ’, তা সহজেই অনুমেয়। সাধারণত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বলতে যা। বােঝায়, চেহারা, চাল-চলন, পাণ্ডিত্য, এক কথায় চোখে পড়বার মতাে তেমন কিছু তার
ছিল না। তবুও তিনি যে আমাদের মনে একটা দাগ রেখে গেলেন তা তার আপন। করে নেওয়ার ক্ষমতা গুণে। এখানেই তাঁর মহত্ত্ব, এখানেই তিনি প্রণম্য।
বিজয় আঢ্য
(লেখক প্রবীণ প্রচারক তথা স্বস্তিকার পূর্বতন সম্পাদক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.