আজ সন্ধ্যাবেলা শ্রীকৃষ্ণদার স্মরণ সভায় থাকতে হবে ভেবে সকাল থেকেই মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। ১৯৮১ সাল, আমাদের সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ ছিল মালদাতে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের কথা। আমরা জানলাম, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের সহ-প্রান্ত প্রচারক হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ মােতলগ আসছেন। একটা বৈঠক ছিল, সেই বৈঠকে মােরপন্তজীও উপস্থিত ছিলেন। মােরপন্তজীর উপস্থিতিতেই সেই বৈঠকে ঘােষণা হলাে শ্রীকৃষ্ণদার সহ প্রান্ত। প্রচারক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে আসার কথা। তিনি রঙে ও চেহারায় একেবারে দক্ষিণ ভারতীয়দের মতােমতাে ছিলেন। অনেক সময় বলতেন, “দেখাে পশ্চিমবঙ্গে আমার কালাে রং-টা একটু উজ্জ্বল হয়ে গেছে। আমি যখন জেলা প্রচারক ছিলাম, আমাদের যখন প্রচারক বর্গ হতাে, সেই বর্গে আমি একটা গান গাইতাম। সেই গান। ছিল— সকলই তােমারই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি। যখনই এই ধরনের বৈঠক হতাে, তখনই তিনি পেছন থেকে বলতেন, ‘সুনীল ওই সকলই তােমারই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ীতারাতুমি— গানটা গাও’। এরকম ‘ওই গানটা গাও’ বলার লােক তিনি চলে গেলেন। তিনি লম্বা সময় আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণদা যখন কলকাতায়, আমরা সবাই একসঙ্গে ২৬ নম্বর সঙ্ঘ কার্যালয়ে থাকতাম। সেখানে ওপেন বাথরুম, ওই ২৬ নম্বরে চৌবাচ্চা থেকে জল নিয়ে স্নান। করা। ঠাণ্ডা জল। শ্রীকৃষ্ণদা বলতেন, “দেখাে সবাই ঠাণ্ডা জলে স্নান করছে, আমি তাে ভেবেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি যে কী করে ঠাণ্ডা জলে স্নান করে। সেই শ্রীকৃষ্ণদাই কিন্তু এখানকার ভাষা শিখলেন, খাওয়া শিখলেন। ওই ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেও শুর করলেন। বলতেন, যদি অমলদা(অমল কুমার বসু) স্নান করতে পারেন তাে আমিও স্নান করতে পারি।
১৯৮৫ সাল, কেশব ভবন তৈরি হবে। সেই ভবনের নকশা শ্রীকৃষ্ণদা তৈরি করেছিলেন। সেই আর্কিটেক্ট চলে গেলেন। ১৯৮৫ সালে আমি নদীয়াবিভাগ প্রচারক ছিলাম। আমার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। পায়ে ব্যথাও ছিল। ওই অবস্থাতেই আমি কেশব ভবনের ভূমিপূজাতে এসেছিলাম। এই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেব দেওরস। এসেছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। আমরা সমস্ত প্রচারকরা ছিলাম ওখানে। সেই কার্যক্রমের পর । আমাদের প্রচারক বর্গ ছিল। গােড়কবংশীতে, দমদমের কাছে। সমস্ত। প্রচারকদের নিযুক্তির ঘােষণা হচ্ছে সেই ঘােষণার সময় আমাদের প্রান্ত প্রচারক ছিলেন কেশবজী। সবার নাম ঘােষণা করা । হছে, তখন মােতলগজী পেছন থেকে বলছেন, কলকাতা মহানগরের ঘােষণাটা করলেন না? তখন আমার ঘােষণা হলাে। তখন আমি জানতে পারলাম, আমি নদীয়া থেকে কলকাতায় এলাম । আমার ও শ্রীকৃষ্ণদা দুজনেরই কেন্দ্র ২৬ নং বিধান সরণীর কার্যালয়। একসঙ্গে ২৫ বছর ২৬ নম্বরকে কেন্দ্র করে কলকাতায় থাকা এটা অনেকের জীবনে হয়েছে কিনা জানি , আমার জীবনে হয়েছে। সেই জন্য খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি।
আমি যখন মহানগর প্রচারক ছিলাম তখন তিনি আমাকে স্কুটারে বসিয়ে শাখাভিত্তিক প্রবাস করতেন। প্রথম পরিচয়ের জন্য প্রবাস করাতেন। একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম, তার যে আন্তরিকতা, প্রত্যেক বাড়িতে যাওয়ার পর সেখানে পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যে কথাবার্তা বলা— সেটার একটা বিশেষ স্টাইল ছিল। মনে আছে রামশিলা পূজনর সময় সারা কলকাতা জুড়ে খুব গণ্ডোগােল হচ্ছিল। তখন পথনির্দেশের কাজটা কলকাতায় বিশেষ করে শ্রীকৃষ্ণদা করেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, তুমি এখন ৩৩ নম্বরে চলে যাও। আমি মনে মনে ভাবলাম, ৩৩ নম্বরে যেতে বলছেন মানে হয়তাে আমাকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দায়িত্ব দেওয়া হবে। আমি গেলাম, সম্পূর্ণ রামশিলা পূজন। কার্যক্রম শেষ করে অযােধ্যায় শ্রীরামশিলা পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত পুরােটাতে আমি ৩৩ নম্বরে ছিলাম। অর্থাৎ পরােক্ষভাবে শ্রীকৃষ্ণদা আমাদের পথনির্দেশ করতেন।
১৯৯২ সালের কল্যাণী মহাশিবিরের প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণদার কথা না বললে অপূর্ণ থেকে যাবে। সারা ভারতবর্ষের লােকেরা প্রথম দেখল যে কলকাতার কাছে কল্যাণীতে এত বড়াে মহাশিবির এবং এই মহাশিবিরের প্রস্তুতিতে ৩ মাস ধরে নিরন্তর সেখানে যাওয়া। এসবের পথনির্দেশ তিনি করেছিলেন। কল্যাণী মহাশিবিরের যে প্রস্তুতি, আমরা যে এত বড়াে মহাশিবির করতে পারলাম, তার ব্যবস্থাপনায় তিনি খুব সুন্দর দক্ষতার পরিচয় রেখেছিলেন। এরকমই কেশব ভবনের দ্বার উদঘাটনের সময় আমরা অনুভব করেছি। সেখানে সারা ভারতের অনেক কার্যকর্তা এসেছিলেন যেমন, বালাসাহেব দেওরস, রঞ্জু ভাইয়া, সুদর্শনজী, যাদবরাওজী যােশী যাঁদের নাম নতুন স্বয়ংসেবকদের হয়তাে জানা নেই, তাঁদের সমস্ত ব্যবস্থাপনা পর্দার আড়ালে থেকে শ্রীকৃষ্ণদা করেছিলেন। তিনি পরবর্তীকালে ২০০৩ সালে যখন ক্ষেত্র প্রচারক হলেন এবং পরে অখিল ভারতীয় সহ-প্রচারক প্রমুখ হলেন, তখন আমাদের প্রদেশ রচনার কিছুপরিবর্তন হয়ে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ দুটি প্রান্ত হয়। এই ঘােষণার আগে তিন জায়গায় বড়াে কার্যক্রম হয়েছিল। একটা রায়গঞ্জে, একটা দুর্গাপুরে, একটা কলকাতায়। ২০০০ সাল থেকে এমন পরিকল্পনা চলছিল যেভাবে প্রদেশে কাজ বাড়ছে তাতে দুটো ভাগ করা হবে না তিনটে ভাগ, তার জন্য তিন। জায়গায় তিনটি বড়াে কার্যক্রম হয়েছিল। সুদর্শনজী তখন সরসঙ্চালক। তিনি । তিনটি কার্যক্রমেই উপস্থিত ছিলেন।
২০১২-তে আবার কল্যাণীতে শিবির হয়েছিল। এই শিবিরেও তিনি ১৯৯২ সালের কল্যাণী শিবিরেবমতাে আর্কিটেক্ট ছিলেন। তিনি ২০১২-তে সেই শিবিরে তিনি ছিলেন। আমাদের দুজনেরই খুব। আনন্দ হচ্ছিল। প্রায় ২০-২২ বছর পর আবার এত বড়াে এক যুবশিবির স্বামীজীর জন্ম সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে হয়েছিল।
শ্রীকৃষ্ণদার শরীর তখন ঠিক ছিল। পরবর্তীকালে কেন্দ্রের নির্দেশে তিনি চলে গেলেন নাগপুরে। কিন্তু তাঁর মনটা এই পশ্চিমবঙ্গ ও অসমেই পড়ে থাকত। শেষের চার বছর তিনি অনেক সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গে এসেছেন, বিভিন্ন কার্যক্রমে এসেছেন। তিনি যেসব জায়গায় কাজ করেছেন সেখানে বাড়িতে বাড়িতে যাওয়া, থাকা, খোঁজ-খবর নেওয়া সবই করতেন। আন্তরিক ভাবে তিনি সবার সঙ্গে মেলামেশা করতেন।
তার শারীরিক অবস্থা খারাপ প্রথম দেখলাম ২০১৮ সালে গােয়ালিয়র প্রতিনিধি সভার বৈঠকে। আমি দেখা। করতে গিয়ে দেখলাম, যে শ্রীকৃষ্ণদাকে ৪০ বছর আগে দেখেছি সেই শ্রীকৃষ্ণদা এখন। নিজে কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন এগুলাে খুব চিন্তা করছেন। তার একা নাগপুরে যাবার টিকিট হয়েছিল। কিন্তু তার শরীর খুবই খারাপ থাকায় একজন কার্যকর্তার সঙ্গে তাঁকে নাগপুরে পাঠানাে। হয়েছিল। ২০১৯ সালে নাগপুরে জুন। মাসে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা। আমি যখন দেখা করতে গেলাম তিনি বললেন, ‘আগের থেকে শরীরটা নরম হয়ে গেছে, আর বেশি হাঁটাচলা করতে পারি না।তখন তার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়নি। শ্রীকৃষ্ণদা এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন।। শ্রীকৃষ্ণদার শেষ সময়ের কথাটা মনে পড়ছে। এই লকডাউনে কে কোথায় আছি, অনেক কার্যকর্তাই খোঁজ নিতে ভুলে গেছেন। হঠাৎ মার্চের শেষের দিকে আমি
তখন চেন্নাই কার্যালয়ে ছিলাম, শ্রীকৃষ্ণদা ফোন করে বলছেন, ‘সুনীল, তুমি কোথায় আছাে? আমি বললাম আমি এখন চেন্নাই কার্যালয়ে আছি, এখানে লকডাউনে আটকে আছি। আপনি কেমন আছেন? তিনি বললেন, “আমি এখন ভালাে আছি, আগের থেকে শরীরটা ভালাে আছে। তারপর আর ফোন করার সুযােগ হয়নি। ইচ্ছে করেই করিনি। কার্যকর্তারা বলছিলেন। তার ফোন ধরতে একটু অসুবিধে হয়। কে বলছে, কোথা থেকে বলছে এটা তিনি বুঝতে পারতেন না। তাই তিনি কেমন। আছেন— এটা এধার-ওধার কাছ থেকে খোঁজ নিতাম। রামদার (রামচন্দ্র সহস্রভােজনী) কাছে শুনলাম— একদিন। শ্রীকৃষ্ণদা রাত্রি দুটোর সময় দরজার সামনে। হামাগুড়ি দিয়ে এসে ধাক্কা মারছেন, দরজা খুলে দেখলাম, শ্রীকৃষ্ণদা মাটিতে বসে আছেন। বলছেন আমি উঠতে পারছি না, আমাকে উঠিয়ে দাও। রামদা তাঁকে ধরে তুললেন এবং ঘরে পৌঁছে দিলেন। পরবর্তীকালে তিনি হাঁটতেন কিন্তু শরীরের দুর্বলতা ছিল।
চার-পাঁচদিন আগেই নাগপুরে ফোন করেছিলাম।রামদা বললেন, এখন ভালাে আছেন।তুমি কি কথা বলতে চাও? বলতে পারাে, কিন্তু তিনি সবসময় ফোন ধরেন না। আমি হয়তাে সেদিন ফোন করলেই তার সঙ্গে শেষবারের মতাে কথা হতাে। হঠাৎ চারদিন পর সবাই যেমন খবর পেল, আমিও খবর পেলাম—আমাদের সবার প্রিয় শ্রীকৃষ্ণদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। শ্রীকৃষ্ণদা চলে যাওয়ায় আমার একটা কথা মনে পড়ছে—এনেছিলে সঙ্গে করেমৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’। শ্রীকৃষ্ণদাকে প্রণাম, কোটি কোটি প্রণাম।
সুনীলপদ গােস্বামী
(লেখক সঙ্ঘের অখিল ভারতীয় কেন্দ্রীয় কার্যকারিণীর আমন্ত্রিত সদস্য)
2020-08-31