ভাগ্যিস সত্যজিৎ রায় বেঁচে নেই। না হলে ওই বিশ্ববরেণ্য চিত্র পরিচালককে আজ নির্ঘাত ভাবতে হতাে নতুন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা, যেটির নামকরণ করতে হতাে- ‘যত অশান্তি শান্তিনিকেতনে”।। রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে তৈরি রাঢ় বাঙ্গলার লালমাটিতে জঙ্গলঘেরা ‘তপােবন’-এ অশান্তির বীজ বপন হয়েছিল বহু বছর আগেই যখন থেকে বিশ্বভারতী আধুনিক হতে শিখেছে। না, শিক্ষাদীক্ষার আধুনিকতার কথা বলছি না হাবেভাবে, আচার-আচরণে চালচলনে। তারই ফলশ্রুতি ছিল শান্তির নিকেতনে বামধারার রাজনীতির পথে টেনে নিয়ে যাওয়ার এক দৃঢ় প্রচেষ্টা। শুধু তাই নয়, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের একটা বড়াে অংশের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরিরত গরিমায় গৌরবান্বিত হয়ে রাবিন্দ্রীক ছত্রছায়ায় সব কিছু অন্যায় ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবার যে ছাড়পত্র মিলে যেত অতি সহজেই তারই ফলশ্রুতির ষােলাে আনা পূরণ হয়েছিল। যখন নােবেল বিজেতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নােবেল পুরস্কারের মেডেল চুরি হয়ে গেল খােদ অন্দরমহল থেকে। তারই মাঝে বারে বারে কখনও গাছ কাটা আবার কখনও কোনাে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়েছে বিশ্বভারতী চত্বর যেখানে সেই সম্মান ফেরাতে শিক্ষিতদের একাংশ ঘরে বসে থাকাই শ্রেয় মনে করে নিশ্চিন্ত হয়েছেন।
সর্বশেষ সমস্যাটা তৈরি হয়েছিল প্রখ্যাত বিজেপি সাংসদ ও সম্পাদক স্বপন দাশগুপ্তের বিশ্বভারতীতে নিমন্ত্রিত হয়ে আসা এবং একটি আলােচনাচক্রে বক্তব্য রাখার অনুষ্ঠানকে ঘিরে। সেদিন কিন্তু বামপন্থী ছাত্র-ছাত্রীরাই সারারাত আটকে রেখেছিলেন বক্তাদের। এবং সাম্প্রতিকতম
গণ্ডগােলটি হলাে গায়ের জোরে পাঁচিল ভাঙার কেলেঙ্কারি। অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের ‘গ্যাংটকে গণ্ডগােল’-এর মতােই।
বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২১ সালে। ১৯৫১ সালে কবি ছিলেন না। কিন্তু ওই সময়েই বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা প্রাপ্তি ঘটে। কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য। তার অনেক আগেই ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে বাংলা ক্যালেন্ডারের ৭ পৌষ ১৩০৮ সালে বােলপুরে। শান্তিনিকেতন আশ্রমে রবিঠাকুর একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। নামকরণ করেছিলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম। ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের মনােবিকাশই ছিল এই বিদ্যালয়ের লক্ষ্য। বিদ্যালয়ের প্রথম পাঁচজন ছাত্রের মধ্যে একজন ছিলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবি নিজেই বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯১৮-র ২৩ ডিসেম্বর। উদ্বোধন করেন। ১৯২১-এর ২৩ ডিসেম্বর। বাংলার ৮ পৌষ ১৩২৮।
শান্তিনিকেতনে ‘পৌষ’ শব্দটি ব্যবহার হয় নতুন কিছুর সূচনা হিসেবে। সেই আনন্দেই সূচিত হয়েছিল শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা। ৭ পৌষের মাহাত্ম হলাে— ওইদিন বাংলা ১২৫০ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের পিতা) ঠাকুর রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। এই উপলক্ষ্যে উৎসব ও মেলার ভাবনাই ছিল তারই। তখন অবশ্য বলা হতাে ভুবনডাঙার মেলা। বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশের মাঠই ওই পৌষমেলা প্রাঙ্গণ বলে পরিচিত বহু বছর ধরেই। পরে ১৯৬১ সালে মেলা উঠে আসে পূর্বপল্লীর মাঠে। মেলা মানে একটি আস্ত মেলা— বাদাম ভাজা জিলিপির পাশাপাশি মানুষের মেলা, শিল্পকর্মের মেলা, বইমেলা, গানমেলা, বাউলমেলা, ফকিরদের মেলা— সামগ্রিকভাবে মানুষের মিলনমেলা।
এবার যত অশান্তি ওই মেলার মাঠকে পাঁচিলের ঘেরাটোপে ঘিরে ফেলা নিয়েই। কারণ ওই ঘেরাটোপ নাকি ‘তপােবন’শান্তিনিকেতনের ব্রান্ড ইমেজেই আঘাত হানছে। সেই আঘতটা নাকি হানছেন যিনি তিনি হলেন বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ :
১।তিনি সব বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
২। তার সিদ্ধান্ত গুলি সংশ্লিষ্ট মানুষজনের মতামতবিহীন।
৩। তার সিদ্ধান্তগুলি অগণতান্ত্রিক। তার চেয়ে বড়াে অভিযােগ :
১। মেলার মাঠ ঘিরে তিনি জনগণকে শান্তিনিকেতন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছেন।
২। মানুষজনের হেঁটে যাওয়ার পথ বন্ধ করতে চাইছেন।
৩। তিনি পাঁচিল দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঠে বসে আড্ডা দেওয়ার সুযােগ থেকে বঞ্চিত করছেন।
৪। তিনি ঝুপড়ি রেস্তরাঁ, রতনপল্লীর ভূঁইফোড় দোকান এবং একটি বেসরকারি লজের সামনের গেট বন্ধ করে দিয়েছেন।
৫। ছাত্র-ছাত্রীরা প্রশ্ন তুলেছেন—আমরা কি আড্ডা দেব না? আমরা কি পড়াশােনার বাইরে একসঙ্গে গানবাজনা করব না?
এ যেন অনেকটা সেই করােনা যুগের প্রথম লকডাউনে চা খেতে বেরনাে বৃদ্ধের আকুল প্রশ্ন- ‘আমরা কি চা খাবাে না? খাবাে না চা আমরা?’ একদম এক সুর। এক ভাষা।।
একটা সহজ প্রশ্ন করি, শান্তিনিকেতনের জমি জায়গা কার ? উত্তর : শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট তথা বিশ্বভারতীর। তা বিশ্বভারতীর জায়গা যদি বিশ্বভারতী ঘিরে পাঁচিল দিয়ে তাতে অন্যের এত গাত্রদাহ কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন : পাঁচিল দেওয়া যাবে না। কারণ ওখান দিয়ে বিশ্বভারতীর নানা প্রতিষ্ঠানে এবং অফিসে সহজে যাওয়া যায়। আরে বাবা, মাঠ তাে মাঠই। রাস্তা মনে করলেই সেটাকে রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে কেন?
তৃতীয় প্রশ্ন : ‘তপােবন’-এর ব্র্যান্ড ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। ভালাে কথা। ভদ্রমহােদয়গণ, একবার সন্ধ্যার শান্তিনিকেতনের নিভৃত ছায়ামাখা চাদের আলােমাখা রাস্তায় হেঁটে দেখেছেন? সবুজ ঘাসের। গালিচায় রাতের কপােত-কপােতীদের রসলীলা চোখে পড়েছে? সেগুলাে এতদিন ধরে কোন ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করেছে?
চতুর্থ প্রশ্ন : পড়াশােনার ফাকে গানবাজনা করবেন। ভালাে তাে। করুন না। শান্তিনিকেতনে ওই পৌষমাঠের মেলা ছাড়া আর কোনও জায়গা মিলল না?
পঞ্চম প্রশ্ন : উপাচার্য খারাপ লােক। মেনে নিলাম। তার জন্য বিশ্বভারতীর সম্পত্তি নষ্ট করতে হবে? একটু বাড়াবাড়ি রকমের আবদার হয়ে গেল না?
ষষ্ঠ প্রশ্ন : মেলার মাঠের ঝুপড়ি রেস্তরা তুলে দেওয়া হয়েছে। দেবে না কেন? জবর দখলি স্বত্বকে প্রামাণিক দলিলে পরিণত করতে হবে কোন আইনে?
আসল কথা হলাে— শান্তিনিকেতন মানেই মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসার এক দুর্বিনীত অঞ্চল। হয়তাে এটাই সত্যি, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী সেই মৌরসিপাট্টা বন্ধ করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। প্রাচীন কিছু ‘আশ্রমিক’ থেকে শুরু করে ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’ ছাত্র-ছাত্রী এবং অবশ্যই ‘গাইয়ে-বাজিয়ে’বামপন্থী ছাত্ররা হাতে হাত মিলিয়ে কাধে কাধ মিলিয়ে গাইতে চেয়েছিলেন– ‘উই শ্যাল ওভারকাম। আপত্তিটা সেখানেই। সেই ‘জন আন্দোলনে হাত মিলিয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বও।নাহলে তাে ‘জনগণ’ ওদের ওপর দোষ চাপাতে যে বিজেপির এক্সটেন্ডেজ ভার্সান। ভােট কাটা যেত সব। সামনেই নির্বাচন। এসব রিস্ক নেওয়া যায়? অতএব একটু বেশি রােয়াব দেখিয়েই ভেঙে দাও বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যপূর্ণ সুদৃশ্য তােরণসজ্জা জেসিবি চালিয়ে।।
লক্ষ্যণীয় যা তা হলাে— গােটা আন্দোলনটাই ১৫ মিনিটের আন্দোলন। বিশ্বের ইতিহাসে জনআন্দোলনের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ। লক্ষ্য কী ছিল? পাঁচিল ভাঙা। ‘ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও’ স্লোগানের সঙ্গে কোথাও একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? গােটা আন্দোলনের সূত্র ওই একটাই— ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।
পশ্চিমবঙ্গে এখন উৎসব হয়। বামফ্রন্ট করত খুব উৎসব। জেলায় জেলায়। ব্লকে ব্লকে। এখন তৃণমূল সরকার করছে—ইলিশ উৎসব, আম উৎসব, পিঠে উৎসব ইত্যাদি। আমফানের ঝড়ে অতিক্রান্ত সুন্দরবনবাসী পেটে কিল মেরে পড়ে থাকে। টাকা খায়। দাদারা। কথা বললে পিঠে কিল পড়ে।
সংস্কৃতি শব্দটার মধ্যে সংহতি শব্দটা আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। সংহতি মানে একত্রিত হওয়া, দৈহিক নয়, সামাজিক মিলন। বঙ্গের সংস্কৃতি এখন হলাে রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালে মমতা-সংগীত বাজা। মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গসংস্কৃতির মানে হলাে লক্ষ
লক্ষ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে সরিয়ে পাঁচ টাকার পিয়াজি দশ টাকায় বিক্রি করা এবং সে হিসাব কোনােদিন না মেলানাে।
শান্তিনিকেতনে অশান্তির মূল সূত্র সেটাই। হিসাব দেব না। কিন্তু হিসাব বুঝে নেব। পড়াশােনা করব না কিন্তু ছাত্র হিসেবে ইউনিয়নবাজি করব। ক্লাস নেব না। আশ্রমিক। হয়ে আঁতলামি করব। চিরকাল কলকাতায় থেকে বুড়াে বয়সেশান্তিনিকেতনবাসী হয়ে রাবীন্দ্রিক হব। ব্রহ্ম কী? ব্রাহ্ম কী ? ব্রহ্মসংগীত কাকে বলে? তা শিখব না। কিন্তু। ‘তপােবন’-এর ধুয়াে তুলব।
আর কত? আলগা রাশের দিনগুলােতে যা করার করেছ। এবার একটু শৃঙ্খলিত হলাে অনুশাসন। অমল ও দইওয়ালার গল্প শুনিয়ে। কিংবা অচলায়তনের কাহিনি বিবৃত করে শৃঙ্খলার চরম সর্বনাশ করে ছাড়ব তা বােধহয় কোনাে প্রতিষ্ঠানই কোনােদিন মেনে। নেবে না। মেনে নেওয়া উচিতও নয়। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলেও মানতেন না।
মুখ্যমন্ত্রী তাে চব্বিশ ঘণ্টা বলছেনআইন আইনের পথে চলবে। আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবেন না। শান্তিনিকেতনে কী হলাে মুখ্যমন্ত্রী সাহেবান? কেউ জবাব দেবেন না জানি। কারণ জবাব দেওয়ার দায় যাঁদের তাঁরাই এতদিন তপােবন’কে বেলেল্লাপনার জতুগৃহ করে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের দোহাই দিয়ে রবীন্দ্রনাথেরই আদ্যশ্রাদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। বিশ্বস্তরে তাে পরের কথা। সামাগ্রিকভাবে সর্বভারতীয় স্তরে মান। প্রতিবছর নীচের দিকে নামছে বিশ্বভারতীর। কেন এই হাল? একবারও আওয়াজ উঠবে।
ষড়যন্ত্রকারীদের কালাে হাত ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও ?
সুজিত রায়
2020-08-31