স্পেশাল কেক, রসগোল্লার হাঁড়ি, মিস্টির প্যাকেট, ফুলের তোড়া, শংসাপত্র নিয়ে কাল রাজ্যের সমস্ত নেতামন্ত্রীরা থানায় থানায় গিয়ে পুলিশ দিবস পালন করবে বলে খবরে প্রকাশ। আইন শৃঙ্খলার রক্ষকদের ‘নবান্ন’ সভাঘরে পুলিশবাহিনীকে সংবর্ধনা দেবেন বেলা একটার সময়। পুলিশদের প্রতি অন্যায় অবিচারকে একে দেওয়ার জন্যই আরো একটা প্রশা্নত কিশোরের স্ট্রাটেজি রুপায়িত হতে চলেছে সাধারণ মানুষের পয়সায়। অথচ, তৃণমূল গুন্ডাদের হাতে প্রহৃত পুলিশকর্মীরা বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। পুলিশ হত্যার তদন্ত বিশবাঁও জলে।
মাননীয়া পুলিশমন্ত্রী হয়ে তৃণমূল গুন্ডাদের ছাড়িয়ে এনেছিলেন থানা থেকে সে বিভীষিকার থেকে সাধারণ পুলিশকর্মীরা এখনো মুক্তি পাননি।
রাজীবকুমারের মত আইপিএস অফিসারেরা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন পুলিশের বড়কর্তারা নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে মমতা ব্যানার্জীর প্রশাসনের কাছে। সাধারণ পুলিশকর্মীদের দুঃখদুর্দশা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই তাদের, ওনারা ব্যস্ত তৃণমূলের নেতাদের তাঁবেদারি করতে।
দেখা নেওয়া যাক সাধারণ পুলিশকর্মীদের দাবীগুলি, যা বর্তমান রাজ্য সরকার কোনোমতেই দিতে রাজি নন, অথচ মিডিয়ার সহযোগিতায় পুলিশ দিবসের ‘উৎসবে’ নাটক করছেন সাধারণ পুলিশকর্মী ও সাধারণ মানুষদের বোকা বানানোর জন্য।
১) পে কমিশন হওয়ার আট মাস পরেও হোমগার্ড ও NVF কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়নি।
২) যে সমস্ত পুলিশকর্মী কর্তব্যরত পরিস্থিতিতে মারা যান, তার স্ত্রী অথবা ছেলে/মেয়েকে চাকরি প্রদান করা হয়। কিন্তু বর্তমানে কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত পুলিশের পরিবারের সদস্যেরা চাকরি পাননি। কিছুদিন আগেই নবান্নের ক্লার্ক ও এক পুলিশ কর্মচারী এই বিষয়ে ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পরেছে।
পশ্চিমবঙ্গ ব্যতীত অন্য রাজ্যে বা কেন্দ্রীয় বাহিনীর কোনো কর্মী কর্তব্যরত অবস্থায় মারা গেলে ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পান এক্স-গ্রেশিয়া হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কর্মীর পরিবারদের ক্ষেত্রে সেই অনুদান মাত্র ৫ লক্ষ টাকা।
পুলিশদের রেশন ভাতার পরিমাণ মাত্র ১৫০০ টাকা, অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ ৩০০০ থেকে ৬০০০ টাকা।
৩) পশ্চিমবঙ্গ সরকার পুলিশকর্মীদের ডিউটি করবার যে পোশাক দেয়, তা ব্যবহারের অযোগ্য। তাই, অধিকাংশ পুলিশকর্মীদের নিজের পয়সাতে ইউনিফর্ম বানাতে হয় বাইরে থেকে।
৪) কিছুদিন আগে বিভিন্ন পুলিশ ডিস্ট্রিক্ট এর প্রশাসনিক প্রধান পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট এর অফিসের সামনে পুলিশকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা ধর্ণায় বসেছিলেন, পুলিশকর্মীদের তাদের বাড়ির কাছাকাছি পোস্টিং দেওয়ার দাবীতে। অধিকাংশ পুলিশকর্মীরা নিজেদের বাড়ি থেকে ২০০, ৩০০, ৪০০ কিলোমিটার দূরে ডিউটি করতে বাধ্য হন।
ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, পুলিশকর্মীদের বাড়ির ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে পোস্টিং দেওয়া হবে, পুলিশকর্মীদের সন্তানদের জন্য স্কুল খোলা হবে। সে প্রতিশ্রুতি এখনো অপূর্ণ।
৫) পুলিশকর্মীরা অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের মত বছরে ৩০টি আর্নড লিভ, ১৪ টি সিএল ও ১০ টি সিসিএল ছুটি পেতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে পুলিশকর্মীদের ৮০% এই ছুটিগুলির মোট ৫০% ছুটি নিতে পারেন না, তাদের ছুটির দরখাস্ত নামঞ্জুর হয়ে যায়।
নিম্নপদাধিকারী পুলিশদের পদোন্নতি নিয়ে টালবাহানা করা হয়, একজন কনস্টেবলের আ্যসিট্যান্ট সাব ইনস্পেকটর হতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। ২০১৬ সালে আ্যসিট্যান্ট সাব ইনস্পেকটর হওয়ার জন্য যে পরীক্ষা হয়েছিল, সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পুলিশকর্মীদের পদোন্নতির কাজ ২০২০ সালে শেষ হয়েছে।
৬) ২০১২ সালে পুলিশের ইউনিয়ন তুলে দিয়ে পুলিশ ওয়েলফেয়ার বোর্ড গঠন করা হয়েছিল প্রচুর ঢক্কানিনাদের সাথে। কিন্তু তাতে নিম্নপদাধিকারী পুলিশকর্মীদের সমস্যার কোনো সমাধান তো হয়নি বরং তাদের দুর্দশা বেড়েছে। পুলিশ ওয়েলফেয়ার বোর্ডের মাথায় বসে রয়েছে আইপিএস অফিসারেরা এবং জেলাতে এস পি রা। কাজেই কোন পুলিশের ঘাড়ে কটা মাথা আছে পুলিশ ওয়ালফেয়ার বোর্ডে অভিযোগ জানাবে? অভিযোগ জানালেই সেই পুলিশকর্মী চিহ্নিত হয়ে যাবেন।
৭) ওয়েস্টবেঙ্গল হেল্থ স্কিম-০৮ এর অধীনে কোনো পুলিশকর্মী বা তার পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে যে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে ক্যাশলেস এক লাখ টাকা অবধি চিকিৎসার সুযোগ পেতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে, পুলিশকর্মীরা বেসরকারি হাসপাতালে গেলে ‘বেড নেই’ এই অজুহাতে পুলিশকর্মীদের ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, হেলথ স্কিমে বেড চার্জ ৬০০ টাকা মোটে, আর বেসরকারি হাসপাতালের বেডচার্জ কত সে সবাই জানেন অল্প বিস্তর। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মীরা সবকিছু জেনেও নিশ্চুপ থাকে, কারণ কোনো না কোনো নেতা বেসরকারি হাসপাতালগুলির থেকে সুবিধে নেন।
৮) কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী কোভিড পরিস্থিতিতে জরুরী পরিষেবা প্রদানকারী সরকারী কর্মচারীদের মৃত্যু হলে এককালীন ৫০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সুবিধে নিতে দেননি কোভিডে মৃত পুলিশকর্মীদের পরিবারদের। রাজ্যের ১০ লক্ষ টাকা নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এই বৈষম্য কেন?
৯) সবশেষে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রচুর সংখ্যক শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও পুলিশে নিয়োগ প্রায় বন্ধ, আর সেই দায়ভার নিতে হচ্ছে বর্তমান পুলিশ কর্মচারীদের।
যারা রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রাণপাত করে নিজেদের কাজ করে চলেছেন, তাদের জন্য পুলিশ দিবস ঘোষণা করে মিডিয়ার লাইমলাইটে সংবর্ধনা দেওয়া তাদের কাছে এক নির্মম রসিকতা ছাড়া কিছু নয়।