প্রকৃতি থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করেও প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ রাখতে হবে : ‘প্রকৃতি দিবস’-এ শ্রী মোহন ভাগবত

প্রকৃতি দিবস’ উদযাপন সম্পর্কে মাননীয় শ্রী মোহন ভাগবত :

হিন্দু স্পিরিচুয়াল সার্ভিস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আজ ৩০ শে আগস্ট ‘পরিবেশ দিবস’ পালনের যে আয়োজন – ‘প্রকৃতি-বন্দনা’ করা হয়েছে আমরাও সেখানে অংশগ্রহণ করছি ।

পরিবেশ সংরক্ষণ’ এই শব্দবন্ধটি আমরা এখন প্রায়শঃ বলি ও শুনি। ‘পরিবেশ সংরক্ষণ’ এর জন্য একটি বিশেষ দিন উদযাপন করাও সমীচীন । কারণ গত কয়েক শতাব্দী ধরে জীবনযাপনের যে রাস্তায় আমরা চলেছি বা এখনো যেভাবে চলছি তা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের অনুকূল নয়। জীবনযাপনের এই প্রচলিত পদ্ধতিতে মনে করা হয় প্রকৃতির জন্য মানুষ কেবলই উপভোক্তা , প্রকৃতির প্রতি তার কোন দায়বদ্ধতা নেই । প্রকৃতির ওপর সম্পূর্ণ অধিকার কায়েম করে বাঁচতে হবে এই অপরিণামদর্শী ভাবনা দ্বারা আমরা বিগত দুশো – আড়াইশো বছর ধরে চালিত হচ্ছি । তার কুফল আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি । এই অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো এমন একদিন আসবে যেদিন পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না কিমবা হয়তো এই পৃথিবীই থাকবে না । এজন্যই মানুষ আজ ভাবতে শুরু করেছে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ’ কত জরুরী । এজন্যই আজ আমরা পরিবেশ দিবস পালন করছি ।আজ আবার প্রায় ২০০০ বছরের প্রাচীন জীবন যাপন পদ্ধতি যেখান থেকে বিগত ৩০০ বছরে আমরা পিছিয়ে এসেছি – তা নিয়ে আলচনা হচ্ছে ।

কিন্তু আমাদের প্রাচীন ভারতে জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের ছিল। পৃথিবী – প্রকৃতি ও মানুষের অস্তিত্বকে একটি পূর্ণরূপে তারা দেখতেন এবং সর্বদা মনে করতেন আমরা সম্পূর্ণ প্রকৃতির একটি অঙ্গ মাত্র । মানবদেহের সব অঙ্গ সক্রিয় থাকলে তবেই সেই দেহ পূর্ণরূপে কার্যক্ষম থাকে , আবার দেহে যদি প্রাণ না থাকে তাহলে কোন অঙ্গই সচল থাকে না – প্রাণ না থাকলে হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায় , মস্তিস্ক স্তব্ধ হয়ে জায়, স্নায়ু বিকল হয়ে পড়ে – এভাবে সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ করার ফলে সেই মানুষের মৃত্যু হয়। শরীর যেমন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ওপর নির্ভরশীল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলির তেমন প্রয়োজন চালিকাশক্তি বা প্রাণশক্তি।প্রকৃতির সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক এরকম পারস্পরিক।আমরা এই বিশ্ব প্রকৃতির অঙ্গ সুতরাং তাকে রক্ষা করা , পরিপুষ্ট করা আমাদের কর্তব্য । জীবনধারণের জন্য যতটা প্রয়োজন তা আমরা প্রকৃতি থেকে নেবো কিন্তু প্রকৃতিকে আমরা যেন শোষণ না করি । আমরা যেন প্রকৃতিকে দোহন করি । আমাদের পূর্বপুরুষরা অনুভব করেছিলেন যে শুধু একদিনের জন্য নয় , এক জীবনের জন্য নয় সমগ্র মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রকৃতির উপস্থিতি । অনেক সময় বলা হয় রাত্রে গাছে হাত দিতে নেই , গাছেরা ওই সময় ঘুমায় – এভাবেই মানুষকে বোঝানো যে হয় উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে , তারাও জীবজগতের অংশ । আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞান আসার হাজার হাজার বছর আগেই আমাদের দেশের লোকে মেনে চলতো – সন্ধ্যাবেলায় গাছে হাত দিতে নেই

আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি কেমন হবে – কি করা উচিত কি করা উচিত নয় সব কিছুই সুপরিকল্পিত । ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র প্রানীর জন্য খাবার দেওয়া , গৃহপালিত গরু, কুকুরকে খাওয়ানো ,পাখীর জন্য খাবার রেখে দেওয়া এবং গ্রামে যদি কোন অতিথি অভুক্ত থাকেন তাকে খাওয়ানোর পরই গৃহকর্তা অন্নগ্রহণ করতেন । এই ত্যাগের মধ্যে সহিংসতা ছিল না, এই ত্যাগের অর্থ আপনার আশেপাশে থাকা পশু-পাখী , কীট-পতঙ্গ সকলকে পরিপুষ্ট করা মানুষের কর্তব্য কারণ তাদের সাহায্যেই মানুষ বাঁচার রসদ সংগ্রহ করে। এই ভাবনাকে ধরে থেকেই আমরা জীবিত আছি – এজন্যই আমাদের দেশে নদীকে পুজা করা হয়, তুলসীসহ অন্যান্য গাছপালাকে পুজা করা হয় ; পাহাড় , পর্বত , সাপ সবকিছুই এদেশে পুজা পায় ।


সম্পূর্ণ বিশ্ব , সম্পূর্ণ পার্থিব জগত চৈতন্যময় । পৃথিবীর সমস্ত বস্তুকে চৈতন্যময় হিসাবে দেখা , শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা , আত্মীয়তার ভাবে গ্রহণ করা , তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করা , পরস্পরের সহযোগিতায় জীবন নির্বাহ করা – এটাই ভারতীয় জীবনশৈলী
ভগবত গীতায় বলা হয়েছে ‘পরস্পরম ভাবোয়ন্তম’ – দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা পূর্ণ ব্যবহার করো , দেবতারাও তোমার প্রতি সদয় হবেন। পরস্পরের প্রতি ভাল ব্যবহারই এই সৃষ্টিকে প্রাণবন্ত রেখেছে। আমাদের ভারতীয় জীবনযাপন পদ্ধতি এরকমই ছিল কিন্তু নানা বিভ্রান্তিমূলক ধারণার প্রভাবে আমরা সেই জীবনযাপন পদ্ধতি থেকে সরে এসেছি । এজন্যই আজ পরিবেশ দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে আমাদের সেই জীবনযাপন পদ্ধতিকে স্মরণ করতে হচ্ছে । এটা খুবই ভাল ভাবনা , প্রতি ঘরে পরিবেশ দিবস পালনের মাধ্যমে ভারতীয় জীবনচর্যার অনুশীলন হওয়া দরকার। এবছর আজ ৩০ শে আগস্ট এই কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হচ্ছে কিন্তু আমাদের নাগপঞ্চমী, আমাদের গোবর্ধন পুজা, তুলসী বিবাহ – এইসব দিনগুলো আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ভালভাবে পালিত হওয়া উচিত । আমরা সবাই আমাদের জীবনে এই সংস্কারগুলো পুনর্জীবিত করে সেই অনুযায়ী জীবনযাপনে সচেষ্ট হই । এর ফলে নতুন প্রজন্মও এই সংস্কার দ্বারা প্রভাবিত হবে – তারাও শিখবে – আমরা সবাই প্রকৃতির অংশ – আমরা প্রকৃতি থেকে রসদ পাই – প্রকৃতিকে জয় করা নয় , প্রকৃতি থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করেও প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ রাখবো । এই ভাবনা সামনে রেখেই আগামীদিনে চলতে হবে – তবেই বিগত ৩০০ – ৩৫০ বছরে যে ক্ষতি হয়েছে আগামী ১০০ – ২০০ বছরে তা আমরা অনেকটাই পূরণ করতে পারব ; সৃষ্টি সুরক্ষিত হবে , মানবজাতি সুরক্ষিত থাকবে , জীবন আর সুন্দর হয়ে উঠবে


এই দিন উদযাপনের সময় খেয়াল রাখতে হবে আমরা শুধু মনোরঞ্জনের জন্য এই কার্যক্রম করছি না – সমগ্র সৃষ্টির সমৃদ্ধির জন্য , নিজের জীবনযাপনকে সুন্দরতর করার জন্য , সবার উন্নতির জন্য আমাদের এই প্রয়াস। আর চোখ কান খুলে রেখে আজকের এই একদিনের ভাবনা সারা বছর ছোট ছোট কথায় কাজে আমরা যেন চর্চা করি , রুপায়নের চেষ্টা করি । আজকের এই দিন সম্পর্কে আমার এই ভাবনা আপনাদের বিবেচনার জন্য রাখলাম। আজকের এই দিন পালনের জন্য আপনাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার বক্তব্যে বিরাম দিলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.