শান্তিনিকেতন : “আমাদের”? – (নাকি সকলের “আমোদের”?)

২৫ – শে জুলাই ১৯৪১ সালকবি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আসবেন। সকলেই জানতো, হয়তো কবিও জানতেন, এটাই শান্তিনিকেতনে তাঁর শেষ বারের জন্য আসা। কিছুকাল আগে থেকেই কবি গুরুতর অসুস্থ। ১৯৪১ সালের ১৬-ই জুলাই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় এবং তাঁর সহকারী কয়েকজন ডাক্তার শান্তিনিকেতনে এসে কবির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে গেছেন। বলে গেছেন চিকিৎসার জন্য কবিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। কলকাতায় যাবার সময় এসে গেছে। এবার চিরবিদায় জানাতে হবে শান্তিনিকেতনকে। ১০ বছর বয়স থেকে বাবার সাথে এই লাল মাটির দেশে আসছেন রবীন্দ্রনাথ। তখন থেকে এই শান্তিনিকেতন তাঁর জীবনের অঙ্গ। নিছক ছুটি কাটানোর বা শখের সমাজসেবার জায়গা নয়। সেই শান্তিনিকেতন ছেড়ে কবি চলে যাবেন।

সেই শেষযাত্রায় ব্যবস্থাপনার কোন ত্রুটি রাখেন নি আশ্রম কর্তৃপক্ষ। ভোরবেলায় বৈতালিকের আয়োজন করেছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। বিশ্বভারতীর শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্রছাত্রী এবং আশ্রমিকরা সমবেত হলেন ‘ উদয়ন ‘ – এর সামনে। কবির উদ্দেশে গাইলেন কবির লেখা গান, “এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার “। শান্তিনিকেতন থেকে বোলপুর স্টেশন আসার রাস্তাটা ছিল ভাঙাচোরা। কবির যাতে কষ্ট না হয় তাই বীরভূমের তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড রাস্তাটা সারিয়ে দিয়েছিলেন। কবির জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ সেলুন কারের। সেলুন কারটি জুড়ে দেওয়া হবে পাকুড় প্যাসেঞ্জারের সাথে। কবিকে যখন স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তখন সারিবদ্ধ হয়ে সকলে দাঁড়িয়ে। গাড়ি যখন চলতে শুরু করলো সকলে গাইতে শুরু করলো আশ্রমসঙ্গীত ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’। সকলের চোখে জল। কবির দুচোখেও তখন জলের ধারা। রাস্তার দুধারে গ্রামের মানুষেরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। কবির গাড়ি সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দুহাত জড়ো করে সকলেই নমস্কার করে বিদায় জানালেন কবিকে। বীরভূমের এক অখ্যাত অঞ্চল যে কবির জন্যই বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছে

১৭-ই আগস্ট, ২০২০। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন থেকে বিদায় নেওয়ার ৮০ বছর পর সশব্দে বিদায় জানানো হলো রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্য, তাঁর ভাবনা, তাঁর দর্শনকে। জে সি বি মেসিন আর পে লোডার দিয়ে। গদ্যময় এই বাংলায় তাঁর ফিরে আসা খুবই কঠিন। এবার হয়তো ট্রাফিক সিগন্যালেই আটকে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ।  বর্ষাকালে হয়তো বাজবে " বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা ", কিংবা প্রখর গ্রীষ্মে " হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে "। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এই জোয়ার দেখে মাও - সে - তুং হয়তো (স্বর্গ কিংবা নরক থেকে) এসে আমাদের পায়ের ধুলো নিয়ে যাবে। তবে ২৫-শে বৈশাখ, ২২-শে শ্রাবণ ঘটা করেই হতে থাকবে,  সশব্দে, ডিজে চালিয়ে - সারারাত্রিব্যাপী মিউজিক্যাল ধামাকার আয়োজন করে। 

মেসিন দিয়ে সেদিন কেবল বিশ্বভারতীর দেওয়াল ভাঙা হয় নি, প্রতিটি ধাক্কায় ভাঙার চেষ্টা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ভাবধারাকে, বাংলার সংস্কৃতিকে। তিনি টিকে থাকলে কিছুটা বিবেক বেঁচে থাকবে, কিছুটা যুক্তি বেঁচে থাকবে, হয়তো কিছু পরিমাণ প্রতিবাদও বেঁচে থাকবে। বিদায় দিলে নিশ্চিত। নতুন ‘কিংডম’ তৈরি হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। তবে কেষ্টবিষ্টুদের রাজত্বে তখনো রবীন্দ্রনাথ থাকবেন না তা কি হয়? থাকবেন। তাঁর একটা গান হয়তো চারদিকে বাজবে – ” চলো নিয়মমতে “। “দূরে তাকিও নাকো, ঘাড় বাঁকিও নাকো “। একেবারে সত্যিকারের কিংডম।

 ১৭-ই আগস্টের ঘটনা কতগুলো ধারণার জন্ম দিল। জন্ম দিল কারণ ধারণাগুলো ছিল না। রবীন্দ্রনাথ নাকি পাঁচিল দেওয়ার বিরোধী। গনগতানুগতিকতার বাইরে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে রবীন্দ্রনাথ এর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলেন।  তারই ফল শান্তিনিকেতনে খোলামেলা মুক্ত পরিবেশে শিক্ষার ব্যবস্থা। জানতে মন চায় রবীন্দ্রনাথ কোথায় বলেছিলেন বাড়ির চারদিকে বেড়া দেওয়া যাবে না। যারা রবীন্দ্রনাথের উন্মুক্ত পরিবেশে শিক্ষার দোহাই দিয়ে, আর স্থানীয় মানুষের 'সেন্টিমেন্ট'-এর ধুয়ো তুলে বিশ্বভারতীর পাঁচিল ভাঙার মতো ঘৃণ্য কাজ করে তারা এরাজ্যের এক কুৎসিত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। পশ্চিম বাংলায় এই সংস্কৃতির সূত্রপাত হয়েছে সূত্রপাত হয়েছে বিগত শতাব্দীর ৬০-এর দশক থেকে। এই রাজ্যেই সরকারি সম্পত্তি নিয়ে যা খুশী করা যায়, তাকে জোর করে দখল করে নিজের পকেট ভর্তি করা যায় - পিছনে একটা সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মদত থাকলেই হলো। এ কারণে শহরের ফুটপাথ বেদখল হয়ে যায়। তুলতে গেলে পুনর্বাসনের দাবি ওঠে। সাধারণ করদাতাদের টাকায় পুনর্বাসন দিলে তা হাতে রেখে কিংবা নগদ অর্থে বেচে দিয়ে আবার দখলের জন্য জায়গা খোঁজা শুরু হয়। আর সাধারণ মানুষ ফুটপাথে হাঁটতে না পেরে রাস্তায় হাঁটে আর গাড়ি চাপা পড়ে।

 বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এই দখলদারি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারা এটা হয়তো বোঝে নি যে দখলদারি সংস্কৃতির ধারক বাহকরা আইনকে ডরায় না। বরং আইনই তাদের সাহায্য করার জন্য একপায়ে খাড়া থাকে। তাই সীমানা দেওয়ার সব সরঞ্জাম লুট হয়ে যায়, জে সি বি মেসিন দিয়ে বিশ্বভারতীর গেট ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, আর আইনের চোখে কাপড় বাঁধা থাকে। 

১৭-ই আগস্টের ঘটনা আরো একটি বিষয়কে স্পষ্ট করে দিল। এ রাজ্যের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ সত্যিই প্রফেসর শঙ্কুর ভাবনার সেই বুদ্ধিসর্বস্ব প্রাণীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের ভৌত অস্তিত্ব আছে কিনা সন্দেহ। প্রায় ফসিলে পরিণত হওয়া এই বুদ্ধিজীবীকূল অনেক ভেবে চিন্তে একটি বিবৃতি খাড়া করেছেন যাতে "রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার তাগিদ জনসমক্ষে জানিয়ে রাখার প্রয়াস স্পষ্ট "। এটা কি সত্যিই এক "সদর্থক ও সংবেদনশীল এক অবিচল পক্ষপাতহীনতা" নাকি নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রেখে সমাজের বিবেক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার এক অক্ষম প্রয়াস? রাস্তায় চলা লজঝড়ে ভাঙাচোরা বাসও নিজের পিছনে লিখে রাখে 'প্লিজ কিপ সেফ ডিসট্যান্স'। এঁদের দেখে সেই লজঝড়ে বাসের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। এক বামমার্গী অভিনেতা সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নাকি বলেছেন এই ঘটনা অন্যায়। কিন্তু এর বেশী নিন্দে করলে নাকি বিজেপি সুবিধে পেয়ে যাবে। বামেদের কাছ থেকে একটা দারুণ বিষয় জানা গেল। কোন ঘটনার নিন্দা করতে গেলে আগে পরিস্থিতি ভালো করে বুঝে নিতে হয়, জেনে নিতে হয় সব পক্ষের কৌশলগত অবস্থান। তারপর নিন্দা করার প্রশ্ন আসে। কি চমৎকার অবস্থান! আর বিশ্বভারতী একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তার উপর আঘাত এসেছে। এই ঘটনার নিন্দা করতে গেলে দল দেখে করতে হবে কেন? এখানে বিজেপিই বা আসছে কোথা থেকে?  এরা বুদ্ধিজীবী নাকি একদল ভণ্ড?  বহু বুদ্ধিজীবী তো শান্তিনিকেতনে শখের বাড়ি বানিয়ে রেখেছেন। তার সীমানায় পাঁচিল দেন নি তাঁরা ? বিশ্বভারতীর খোলামেলা পরিবেশের  দোহাই দিয়ে কেউ যদি তাঁদের বাড়ির পাঁচিলগুলো ভেঙে দিতে বলে এই বুদ্ধিজীবীরা মানবেন তো?   এদের কারোর কারোর বক্তব্য হলো সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে কথা বলে কাজ করলে নাকি এই ঘটনা ঘটতো না। আসলে কোন সমস্যার কোন সমাধান না করে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য টিকিয়ে রাখার একটা সোজা উপায় হলো সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মতির উপর ছেড়ে দেওয়া যাতে কোনদিন এর সমাধান না হয়। জায়গাটা বিশ্বভারতীর। সে তার সম্পত্তি রক্ষা করতে চায়। পক্ষ সে একাই। বাকী সকলেই বি-পক্ষ। কেউ  বেআইনী সুবিধাভোগী কেউ বা বেআইনী  দখলদার। তারা কোন পক্ষ নয়। এই সব জায়গার অনেকগুলোতে সন্ধ্যের পর নানা ধরনের নোংরামি চলে। এসব কাজ যারা করে তারাও কি একটা পক্ষ?  এই যুক্তি মানলে পাঁচিল দেওয়ার আগে তাদের সাথেও আলোচনা করতে হতো।

শান্তিনিকেতন (Santiniketan) আশ্রম আর বিশ্বভারতী শিক্ষায়তন গড়ে তোলা হয়েছিল উন্নত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে। প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তির লক্ষ্যে। আমোদ প্রমোদের জন্য নয়। শান্তিনিকেতন আমাদের, আমোদের নয়।

বিমল শংকর নন্দ (Bimal Shankar Nanda)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.