১৯৮৬ থেকে ২০২০ দীর্ঘ ৩৪ বছর পরে আমাদের ভারতবর্ষ পেল নতুন শিক্ষানীতি। শেষবার ১৯৮৬ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘােষণা হয়েছিল। উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে প্রথম জাতীয় শিক্ষানীতি ঘােষিত হয় ১৯৬৮ সালে। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। দ্বিতীয় জাতীয় শিক্ষানীতি ঘােষিত হয় ১৯৮৬ সালে। তখন দেশে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজীব গান্ধী। আর সেই শিক্ষানীতিকে সংশােধিত করা হয় ১৯৯২ সালে। ২০০৯ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার শিক্ষার অধিকার আইন প্রণয়ন করে। ভারতের ষােড়শ লােকসভা নির্বাচন শেষে ভারতীয় জনতা পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং নরেন্দ্র মােদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গঠন হয়। এই সরকার একটি নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতিরচনার। জন্য প্রক্রিয়া হাতে নেয়। তার জন্য কেন্দ্র সরকার খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১৬ রূপরেখা প্রকাশ করেছে। এই ৪৩ পৃষ্ঠার রূপরেখার নাম দেওয়া হয়েছিল—- Some Inputs for Draft National Education Policy 2016। মােদী সরকার নতুন শিক্ষা নীতি রচনার জন্য ৩৩টি থিম বা বিষয়বস্তু কেন্দ্র সরকারের ‘মাই গভ’ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এবং দেশের বিভিন্ন। সংগঠন ও মানুষের কাছ থেকে মতামত জানতে চাওয়া হয়। তাই প্রায় ২৯ হাজার পরামর্শ জমা পড়ে। কেন্দ্র সরকার সেইথিম বা বিষয়বস্তু এবং মতামতগুলিকে নিয়ে একটি খসড়া শিক্ষানীতি তৈরি করার জন্য ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর কেন্দ্র সরকারের প্রাক্তন সচিব টিএস সুব্রহ্মণ্যমকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি কমিটি তৈরির কথা ঘােষণা করে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যসচিব শৈলজা চন্দ্র, গুজরাটের প্রাক্তন যুগ্মসচিব সুধীর মাকড়, দিল্লির প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব শেওয়ারাম শর্মা এবং
জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পর্ষদ (এনসিইআরটি)-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান জেএস রাজপুত। ২০১৬ সালের ২৭ ওই কমিটি তাদের রিপাের্ট ও ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে কেন্দ্র সরকারের কাছে এক রিপাের্ট জমা দেয়। রিপাের্টটি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি নতুন চূড়ান্ত জাতীয় শিক্ষানীতিতে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটে অনুমােদন প্রদান করে। এই নতুন চূড়ান্ত জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রথমেই চোখ পড়বে সমগ্র স্কুল শিক্ষার বিষয়ে নীতি প্রণয়নে স্বকীয়তা। সবার জন্য শিক্ষা’ স্লোগানটিকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সদর্থক চেষ্টা আছে এই নতুন চূড়ান্ত জাতীয় শিক্ষানীতিতে। শিক্ষানীতি হলাে একটি ‘নীতি’, কোনাে পৃথক ‘আইন’নয়। তাই ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার (আরটিই) আইনকে প্রয়ােজনীয় সংশােধন করতে হবে এখন। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় আইন তৈরি ও সংশােধন করতে পারবে এবং বাজেটের মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় অর্থও বরাদ্দ করতে পারবে। এই শিক্ষানীতির বাস্তব রূপায়ণ নির্ভর করবে। দেশের রাজ্য সরকারগুলির উপর।
স্কুলশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা, দুই ক্ষেত্রের পাশাপাশি সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করা হয়েছে। যার মধ্যে ‘রাইট টু এডুকেশন বা শিক্ষার অধিকারের বয়সসীমা ৩ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। নতুন শিক্ষানীতির ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মাত্রাতিরিক্ত পড়াশােনার চাপ কমবে। কেননা দশম শ্রেণীর বাের্ডের সঙ্গে পরীক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত একটি অভিন্ন ৮ সেমিস্টারের ব্যবস্থা আসতে চলেছে। সেকেন্ডারি স্তরে থাকবে না কলা, বিজ্ঞান বা বাণিজ্যের মতাে কোনও আলাদা বিভাগ। এক কথায় স্কুল শিক্ষায় ১০+২ পদ্ধতির বদলে ৫+৩+৩+৪ পদ্ধতি। এখন স্কুল শিক্ষায় থাকবে নীচের চারটি বিভাগ :
(১) ফাউন্ডেশন স্টেজ (৩ বছর প্রাক-প্রাথমিক স্কুলে, ২ বছর প্রাথমিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত, সব মিলিয়ে একটি শিশুর ৩ বছর থেকে ৮ বছর বয়স অবধি)।
(২) প্রিপারেটরি স্টেজ (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত) অর্থাৎ ৮ বছর বয়স অবধি।
(৩) মিডল স্টেজ (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত) অর্থাৎ ১১ থেকে ১৪ বছর অবধি।।
(৪) সেকেন্ডারি স্টেজ (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স অবধি)।
এছাড়াও প্রকৃত জাতীয়তাবাদী শিক্ষানুরাগীদের ভাবনা ও দাবির কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা, সংস্কৃতের মতাে ভারতীয় ভাষা জনপ্রিয় করার চেষ্টার প্রতিফলন আমরা নতুন শিক্ষানীতিতে পাই। নতুন শিক্ষানীতিতে আরও বলা হয়েছে যে, কোনও ভাষা শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে প্রয়ােগ করা হবে না। তাই একটি শিশু যদি তার মাতৃভাষা নিয়ে নার্সারি থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পারে তার থেকে ভালাে কিছুই হতে পারে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে এমন অনেকেই পাবেন যারা নিজেদের প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং ভারতের সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকর। দেশের একতা ও অখণ্ডতার জন্যও জরুরি স্থানীয় ভাষায় পড়াশুনা।।
পরিবর্তন করা হয়েছে স্নাতক স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রেও। উচ্চশিক্ষায় যারা গবেষণা করবে তাদের চার বছরের কোর্স হবে। স্নাতকোত্তরের পর সরাসরি পিএইচডি। এম,ফিল করতে হবে না। স্নাতক স্তরে প্রতি বছরের পর সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। দ্বিতীয় বছরের পর দেওয়া হবে ডিপ্লোমা। তৃতীয় ও চতুর্থ বছরের পর দেওয়া হবে স্নাতক সার্টিফিকেট। নতুন শিক্ষানীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞাতেও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বােঝানাে হবে যে কোনও বহু শৃঙ্খলাবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেখানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে উচ্চ মানের, গবেষণামূলক এবং গােষ্ঠীবদ্ধ শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষাগত যােগ্যতা সংরক্ষণের জন্য একটি অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অব ক্রেডিট গঠন করা হবে। সেখানে প্রত্যেক পড়ুয়ার শিক্ষাগত যােগ্যতা ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকবে। সারাদেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটিই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকবে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা উচ্চশিক্ষা কাউন্সিল (এইচইসিআই) গঠন করবে। আবার তার থাকবে চারটি অংশ। প্রথমটি অবশ্য চিকিৎসা এবং আইনি শিক্ষা এর আওতার বাইরে থাকবে। তার দ্বিতীয় অংশ হলাে একটি ‘মেটা-অ্যাক্রিডিটিং বডি। যাকে বলা হয় ন্যাশনাল অ্যাক্রিডেশন এডুকেশন কাউন্সিল, যা উচ্চ শিক্ষার কর্মসূচির জন্য প্রত্যাশিত শিক্ষার ফলাফলের কাঠামাে তৈরি করবে। এই রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়ােগ তৈরি করে তার ছাতার তলায় ইউজিসি, এআইসিটিই-র মতাে সংস্থাকে নিয়ে আসা এবং জাতীয় রিসার্চ ফাউন্ডেশন তৈরি– এইসব কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ভাবনারই প্রতিফলন বলা যায়।।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অনুপ্রাণিত ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল এই নতুন চূড়ান্ত শিক্ষনীতি তৈরি করার জন্য। তার প্রমাণ আমরা পাইনতুন শিক্ষা নীতি প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে তৈরি হওয়া থেকে। শিক্ষানীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত পড়াশুনা করে একজন ব্যক্তি যাতে ভারতীয় হিসেবে গর্ববােধ করে। নিজের ‘মৌলিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। নতুন শিক্ষানীতির ঘােষিত উদ্দেশ্যও কিন্তু সেই একই কথা বলছে।
নতুন শিক্ষানীতি দেশের যুবসমাজকে নিজের পথ বেছে নেওয়ার সুযােগ করে দেবে। চাকরি পাওয়ার বদলে চাকরি দিতে সক্ষম হয়ে উঠবে যুবসমাজ। নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ স্কুল ও উচ্চশিক্ষার ছাত্র-ছাত্রীর বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এই সময়কালে ১০ দিনের ব্যাগবিহীন ‘ইন্টার্নের’ব্যবস্থা করতে হবে স্থানীয় ক০ষক, কাঠের মিস্ত্রি, মালী, কুমাের, শিল্পী প্রমুখের কাছে। একই ভাবে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বৃত্তিমূলক বিষয়ে ইন্টার্নশিপ করার সুযােগ দিতে হবে (ছুটির দিন সমেত)। এই প্রস্তাবগুলি বাস্তবে রূপায়ণ হলে ছাত্র-ছাত্রীরা ভবিষ্যতে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে নিযুক্ত হতে পারবে। শুধু তাই নয়, এক্সচেঞ্জ প্রােগ্রাম বা বিদেশে পড়াশােনার বিষয়েও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষানীতিতে। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিদেশে ক্যাম্পাস গড়ে তুলবে। নির্দিষ্ট কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎযারা সেরা ১০০-তে রয়েছে তাদের মধ্যে ভারতে ক্যাম্পাস চালুর অনুমতি দেওয়া হবে। ভারতে ক্যাম্পাস গড়তে ইচ্ছুক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলির জন্য একটি আইনি পরিকাঠামাে গড়ে তােলা হবে।
আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মােহন ভাগবত বলেছিলেন, নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মনির্ভর, স্বাধীন ও স্বাভিমানী করে তােলা হােক। শিক্ষানীতির শিকড় প্রােথিত হােক ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতিতে। আজ নতুন শিক্ষানীতিতে সেইসব কথাই অক্ষরে অক্ষরে লেখা রয়েছে। সঙ্ঘের ভাবনার সিংহভাগই ফুটে উঠেছে নতুন চূড়ান্ত শিক্ষানীতিতে। সঙ্ঘ দাবি জানিয়েছিল ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’ নামটি পরিবর্তন করে শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রক’ রাখার জন্য। উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন শিক্ষামন্ত্রকের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয়েছিল মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। বর্তমান এই চূড়ান্ত শিক্ষানীতি অনুসারে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নাম পরিবর্তন করে শিক্ষামন্ত্রক করা হবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এ নিয়ে কোনাে আপত্তি বা অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেনি। কারণ শিক্ষা তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে না। সবচেয়ে বড়াে কথা হলাে, এই শিক্ষানীতিকে বাস্তবে প্রয়ােগ করতে হলে অর্থের প্রয়ােজন হবে। কোঠারি কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছিল জিডিপির ৬ শতাংশ সরকারকে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় করার জন্য। সেটা কোনও দিন মানাহয়নি। তাই শিক্ষার আজ এই হাল হয়েছে। তাই মােদী সরকার ইতিমধ্যে ঘােষণা করেছে এখন শিক্ষা খাতে জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ ব্যয় হবে। তার চেয়ে আনন্দ বা স্বস্তিদায়ক কী হতে পারে।
ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এই দেশের একটি গর্বের বিষয়। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পশ্চিমের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদভাণ্ডার আমাদের দেশকে বারে বারে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে বহির্দেশের মানুষের কাছে। বিচিত্র এ দেশের প্রাকৃতিক শােভা, বিচিত্র তার অধিবাসীরাও জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতির এক মিশ্ররূপ আমাদের দেশ। ‘বিবিধের মাঝে’-ও মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববােধ, ঐক্যবােধ, সবার জন্য কল্যাণ কাজে, দেশের গণতান্ত্রিক ভিতকে সুদৃঢ় করার কাজে বদ্ধপরিকর আমাদের দেশ। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে বলা হয়েছিল, সংবিধান চালু হওয়ার দশ বছরের মধ্যে প্রারম্ভিক শিক্ষা সার্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই ১৯৫০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৭০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও সে স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। বিশ্ববাসীর ১৭ শতাংশের বাস এই ভারতে। কিন্তু আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিশ্বে চরম দুর্দশাগ্রস্ত যত মানুষ আছে, তার ৩৭ শতাংশের বেশি ভারতে। অন্যদিকে অতি ধনী পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ভারত বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে। এই বৈপরীত্যের মধ্যে দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে দেশের যথার্থ শিক্ষানীতি। শীঘ্রই নয়া শিক্ষানীতি বাস্তবে প্রয়ােগ হােক।।
লেখাটি শেষ করছি ২০১৬ সালের খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবনার শেষ প্যারাগ্রাফে থাকা শ্রীঅরবিন্দের উক্তি দিয়ে ভারতীয়দের দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে যে ভারতকে উঠতে হবে ও মহান হতে হবে এবং যে সবকিছু ঘটে গেছে এবং যা অসুবিধা, যা বিপরীত ঘটেছে তা আবশ্যক ভাবে সাহায্য করবে লক্ষ্যের দিকে। আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে– ভোের শীঘ্রই সম্পূর্ণ হবে এবং সূর্য দিগন্ত ছেড়ে উঠবে। ভারতের ভাগ্যসূর্য উঠবে এবং তার রশ্মি সারা ভারত ভরে তুলবে এবং প্লাবিত করতে সারা ভারত, এশিয়া ও বিশ্বকে।
ধর্মানন্দ দেব
(লেখক বিশিষ্ট আইনজীবী)
১৯৮৬ থেকে ২০২০ দীর্ঘ ৩৪ বছর পরে আমাদের ভারতবর্ষ পেল নতুন শিক্ষানীতি। শেষবার ১৯৮৬ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘােষণা হয়েছিল। উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে প্রথম জাতীয় শিক্ষানীতি ঘােষিত হয় ১৯৬৮ সালে। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। দ্বিতীয় জাতীয় শিক্ষানীতি ঘােষিত হয় ১৯৮৬ সালে। তখন দেশে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজীব গান্ধী। আর সেই শিক্ষানীতিকে সংশােধিত করা হয় ১৯৯২ সালে। ২০০৯ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার শিক্ষার অধিকার আইন প্রণয়ন করে। ভারতের ষােড়শ লােকসভা নির্বাচন শেষে ভারতীয় জনতা পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং নরেন্দ্র মােদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গঠন হয়। এই সরকার একটি নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতিরচনার। জন্য প্রক্রিয়া হাতে নেয়। তার জন্য কেন্দ্র সরকার খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১৬ রূপরেখা প্রকাশ করেছে। এই ৪৩ পৃষ্ঠার রূপরেখার নাম দেওয়া হয়েছিল—- Some Inputs for Draft National Education Policy 2016। মােদী সরকার নতুন শিক্ষা নীতি রচনার জন্য ৩৩টি থিম বা বিষয়বস্তু কেন্দ্র সরকারের ‘মাই গভ’ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এবং দেশের বিভিন্ন। সংগঠন ও মানুষের কাছ থেকে মতামত জানতে চাওয়া হয়। তাই প্রায় ২৯ হাজার পরামর্শ জমা পড়ে। কেন্দ্র সরকার সেইথিম বা বিষয়বস্তু এবং মতামতগুলিকে নিয়ে একটি খসড়া শিক্ষানীতি তৈরি করার জন্য ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর কেন্দ্র সরকারের প্রাক্তন সচিব টিএস সুব্রহ্মণ্যমকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি কমিটি তৈরির কথা ঘােষণা করে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যসচিব শৈলজা চন্দ্র, গুজরাটের প্রাক্তন যুগ্মসচিব সুধীর মাকড়, দিল্লির প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব শেওয়ারাম শর্মা এবং
জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পর্ষদ (এনসিইআরটি)-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান জেএস রাজপুত। ২০১৬ সালের ২৭ ওই কমিটি তাদের রিপাের্ট ও ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে কেন্দ্র সরকারের কাছে এক রিপাের্ট জমা দেয়। রিপাের্টটি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি নতুন চূড়ান্ত জাতীয় শিক্ষানীতিতে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটে অনুমােদন প্রদান করে। এই নতুন চূড়ান্ত জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রথমেই চোখ পড়বে সমগ্র স্কুল শিক্ষার বিষয়ে নীতি প্রণয়নে স্বকীয়তা। সবার জন্য শিক্ষা’ স্লোগানটিকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সদর্থক চেষ্টা আছে এই নতুন চূড়ান্ত জাতীয় শিক্ষানীতিতে। শিক্ষানীতি হলাে একটি ‘নীতি’, কোনাে পৃথক ‘আইন’নয়। তাই ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার (আরটিই) আইনকে প্রয়ােজনীয় সংশােধন করতে হবে এখন। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় আইন তৈরি ও সংশােধন করতে পারবে এবং বাজেটের মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় অর্থও বরাদ্দ করতে পারবে। এই শিক্ষানীতির বাস্তব রূপায়ণ নির্ভর করবে। দেশের রাজ্য সরকারগুলির উপর।
স্কুলশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা, দুই ক্ষেত্রের পাশাপাশি সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করা হয়েছে। যার মধ্যে ‘রাইট টু এডুকেশন বা শিক্ষার অধিকারের বয়সসীমা ৩ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। নতুন শিক্ষানীতির ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মাত্রাতিরিক্ত পড়াশােনার চাপ কমবে। কেননা দশম শ্রেণীর বাের্ডের সঙ্গে পরীক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত একটি অভিন্ন ৮ সেমিস্টারের ব্যবস্থা আসতে চলেছে। সেকেন্ডারি স্তরে থাকবে না কলা, বিজ্ঞান বা বাণিজ্যের মতাে কোনও আলাদা বিভাগ। এক কথায় স্কুল শিক্ষায় ১০+২ পদ্ধতির বদলে ৫+৩+৩+৪ পদ্ধতি। এখন স্কুল শিক্ষায় থাকবে নীচের চারটি বিভাগ :
(১) ফাউন্ডেশন স্টেজ (৩ বছর প্রাক-প্রাথমিক স্কুলে, ২ বছর প্রাথমিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত, সব মিলিয়ে একটি শিশুর ৩ বছর থেকে ৮ বছর বয়স অবধি)।
(২) প্রিপারেটরি স্টেজ (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত) অর্থাৎ ৮ বছর বয়স অবধি।
(৩) মিডল স্টেজ (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত) অর্থাৎ ১১ থেকে ১৪ বছর অবধি।।
(৪) সেকেন্ডারি স্টেজ (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স অবধি)।
এছাড়াও প্রকৃত জাতীয়তাবাদী শিক্ষানুরাগীদের ভাবনা ও দাবির কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা, সংস্কৃতের মতাে ভারতীয় ভাষা জনপ্রিয় করার চেষ্টার প্রতিফলন আমরা নতুন শিক্ষানীতিতে পাই। নতুন শিক্ষানীতিতে আরও বলা হয়েছে যে, কোনও ভাষা শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে প্রয়ােগ করা হবে না। তাই একটি শিশু যদি তার মাতৃভাষা নিয়ে নার্সারি থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পারে তার থেকে ভালাে কিছুই হতে পারে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে এমন অনেকেই পাবেন যারা নিজেদের প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং ভারতের সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকর। দেশের একতা ও অখণ্ডতার জন্যও জরুরি স্থানীয় ভাষায় পড়াশুনা।।
পরিবর্তন করা হয়েছে স্নাতক স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রেও। উচ্চশিক্ষায় যারা গবেষণা করবে তাদের চার বছরের কোর্স হবে। স্নাতকোত্তরের পর সরাসরি পিএইচডি। এম,ফিল করতে হবে না। স্নাতক স্তরে প্রতি বছরের পর সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। দ্বিতীয় বছরের পর দেওয়া হবে ডিপ্লোমা। তৃতীয় ও চতুর্থ বছরের পর দেওয়া হবে স্নাতক সার্টিফিকেট। নতুন শিক্ষানীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞাতেও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বােঝানাে হবে যে কোনও বহু শৃঙ্খলাবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেখানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে উচ্চ মানের, গবেষণামূলক এবং গােষ্ঠীবদ্ধ শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষাগত যােগ্যতা সংরক্ষণের জন্য একটি অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অব ক্রেডিট গঠন করা হবে। সেখানে প্রত্যেক পড়ুয়ার শিক্ষাগত যােগ্যতা ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকবে। সারাদেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটিই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকবে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা উচ্চশিক্ষা কাউন্সিল (এইচইসিআই) গঠন করবে। আবার তার থাকবে চারটি অংশ। প্রথমটি অবশ্য চিকিৎসা এবং আইনি শিক্ষা এর আওতার বাইরে থাকবে। তার দ্বিতীয় অংশ হলাে একটি ‘মেটা-অ্যাক্রিডিটিং বডি। যাকে বলা হয় ন্যাশনাল অ্যাক্রিডেশন এডুকেশন কাউন্সিল, যা উচ্চ শিক্ষার কর্মসূচির জন্য প্রত্যাশিত শিক্ষার ফলাফলের কাঠামাে তৈরি করবে। এই রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়ােগ তৈরি করে তার ছাতার তলায় ইউজিসি, এআইসিটিই-র মতাে সংস্থাকে নিয়ে আসা এবং জাতীয় রিসার্চ ফাউন্ডেশন তৈরি– এইসব কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ভাবনারই প্রতিফলন বলা যায়।।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অনুপ্রাণিত ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল এই নতুন চূড়ান্ত শিক্ষনীতি তৈরি করার জন্য। তার প্রমাণ আমরা পাইনতুন শিক্ষা নীতি প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে তৈরি হওয়া থেকে। শিক্ষানীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত পড়াশুনা করে একজন ব্যক্তি যাতে ভারতীয় হিসেবে গর্ববােধ করে। নিজের ‘মৌলিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। নতুন শিক্ষানীতির ঘােষিত উদ্দেশ্যও কিন্তু সেই একই কথা বলছে।
নতুন শিক্ষানীতি দেশের যুবসমাজকে নিজের পথ বেছে নেওয়ার সুযােগ করে দেবে। চাকরি পাওয়ার বদলে চাকরি দিতে সক্ষম হয়ে উঠবে যুবসমাজ। নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ স্কুল ও উচ্চশিক্ষার ছাত্র-ছাত্রীর বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এই সময়কালে ১০ দিনের ব্যাগবিহীন ‘ইন্টার্নের’ব্যবস্থা করতে হবে স্থানীয় ক০ষক, কাঠের মিস্ত্রি, মালী, কুমাের, শিল্পী প্রমুখের কাছে। একই ভাবে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বৃত্তিমূলক বিষয়ে ইন্টার্নশিপ করার সুযােগ দিতে হবে (ছুটির দিন সমেত)। এই প্রস্তাবগুলি বাস্তবে রূপায়ণ হলে ছাত্র-ছাত্রীরা ভবিষ্যতে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে নিযুক্ত হতে পারবে। শুধু তাই নয়, এক্সচেঞ্জ প্রােগ্রাম বা বিদেশে পড়াশােনার বিষয়েও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষানীতিতে। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিদেশে ক্যাম্পাস গড়ে তুলবে। নির্দিষ্ট কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎযারা সেরা ১০০-তে রয়েছে তাদের মধ্যে ভারতে ক্যাম্পাস চালুর অনুমতি দেওয়া হবে। ভারতে ক্যাম্পাস গড়তে ইচ্ছুক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলির জন্য একটি আইনি পরিকাঠামাে গড়ে তােলা হবে।
আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মােহন ভাগবত বলেছিলেন, নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মনির্ভর, স্বাধীন ও স্বাভিমানী করে তােলা হােক। শিক্ষানীতির শিকড় প্রােথিত হােক ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতিতে। আজ নতুন শিক্ষানীতিতে সেইসব কথাই অক্ষরে অক্ষরে লেখা রয়েছে। সঙ্ঘের ভাবনার সিংহভাগই ফুটে উঠেছে নতুন চূড়ান্ত শিক্ষানীতিতে। সঙ্ঘ দাবি জানিয়েছিল ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’ নামটি পরিবর্তন করে শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রক’ রাখার জন্য। উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন শিক্ষামন্ত্রকের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয়েছিল মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। বর্তমান এই চূড়ান্ত শিক্ষানীতি অনুসারে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নাম পরিবর্তন করে শিক্ষামন্ত্রক করা হবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এ নিয়ে কোনাে আপত্তি বা অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেনি। কারণ শিক্ষা তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে না। সবচেয়ে বড়াে কথা হলাে, এই শিক্ষানীতিকে বাস্তবে প্রয়ােগ করতে হলে অর্থের প্রয়ােজন হবে। কোঠারি কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছিল জিডিপির ৬ শতাংশ সরকারকে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় করার জন্য। সেটা কোনও দিন মানাহয়নি। তাই শিক্ষার আজ এই হাল হয়েছে। তাই মােদী সরকার ইতিমধ্যে ঘােষণা করেছে এখন শিক্ষা খাতে জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ ব্যয় হবে। তার চেয়ে আনন্দ বা স্বস্তিদায়ক কী হতে পারে।
ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এই দেশের একটি গর্বের বিষয়। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পশ্চিমের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদভাণ্ডার আমাদের দেশকে বারে বারে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে বহির্দেশের মানুষের কাছে। বিচিত্র এ দেশের প্রাকৃতিক শােভা, বিচিত্র তার অধিবাসীরাও জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতির এক মিশ্ররূপ আমাদের দেশ। ‘বিবিধের মাঝে’-ও মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববােধ, ঐক্যবােধ, সবার জন্য কল্যাণ কাজে, দেশের গণতান্ত্রিক ভিতকে সুদৃঢ় করার কাজে বদ্ধপরিকর আমাদের দেশ। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে বলা হয়েছিল, সংবিধান চালু হওয়ার দশ বছরের মধ্যে প্রারম্ভিক শিক্ষা সার্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই ১৯৫০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৭০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও সে স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। বিশ্ববাসীর ১৭ শতাংশের বাস এই ভারতে। কিন্তু আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিশ্বে চরম দুর্দশাগ্রস্ত যত মানুষ আছে, তার ৩৭ শতাংশের বেশি ভারতে। অন্যদিকে অতি ধনী পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ভারত বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে। এই বৈপরীত্যের মধ্যে দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে দেশের যথার্থ শিক্ষানীতি। শীঘ্রই নয়া শিক্ষানীতি বাস্তবে প্রয়ােগ হােক।।
লেখাটি শেষ করছি ২০১৬ সালের খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবনার শেষ প্যারাগ্রাফে থাকা শ্রীঅরবিন্দের উক্তি দিয়ে ভারতীয়দের দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে যে ভারতকে উঠতে হবে ও মহান হতে হবে এবং যে সবকিছু ঘটে গেছে এবং যা অসুবিধা, যা বিপরীত ঘটেছে তা আবশ্যক ভাবে সাহায্য করবে লক্ষ্যের দিকে। আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে– ভোের শীঘ্রই সম্পূর্ণ হবে এবং সূর্য দিগন্ত ছেড়ে উঠবে। ভারতের ভাগ্যসূর্য উঠবে এবং তার রশ্মি সারা ভারত ভরে তুলবে এবং প্লাবিত করতে সারা ভারত, এশিয়া ও বিশ্বকে।
ধর্মানন্দ দেব
(লেখক বিশিষ্ট আইনজীবী)