স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে অনেক শিক্ষা কমিশন, কমিটি গঠন হয়েছে অথচ আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক কাঠামাে থেকে মুক্ত করে ভারতকেন্দ্রিক শিক্ষা গড়ার কাজকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারিনি। ১৯৮৬ সালের শিক্ষানীতির পর দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে ভারতে আর কোনাে নতুন শিক্ষানীতি প্রণীত হয়নি। ইতিমধ্যে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে, অনেক নতুন বিষয় এসেছে, নতুন। প্রযুক্তি এসেছে, এসেছে নতুন চিন্তাভাবনা। ২০১৭ সালে ইসরাের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. কে কস্তুরী রঙ্গনের নেতৃত্বে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি ভারত সরকার গঠন করে। এই কমিটি দুই বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একবিংশ শতাব্দীর জন্য উপযুক্ত শিক্ষা নীতির খসড়া তৈরি করে ৩১ মে ২০১৯-এ তা সরকারের হস্তগত করে। এই সময়কালে এই কমিটি প্রায় দুই লক্ষ শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বিদ্যার্থী, অভিভাবকদের থেকে মতামত সংগৃহীত করে। এত বৃহৎ আকারে মানুষের মতামত নিয়ে তার প্রত্যেকটির উপর বিচার-বিমর্ষ করে দেশের শিক্ষানীতি নির্ধারণ ইতিপূর্বে কোথাও হয়নি। এই কমিটির প্রতিবেদনই গত ২৯ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট দ্বারা অনুমােদনপ্রাপ্ত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হলাে জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ রূপে।
ঘােষণার পর থেকেই এই নীতির বিভিন্ন প্রস্তাব সম্পর্কে সমস্ত মহলে চর্চা শুরু হয়েছে। প্রায় সকলেই এই নীতিকে অত্যন্ত ইতিবাচক ও ভবিষ্যদমুখী দিকনির্দেশ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে যদিও কিছু রাজনৈতিক ও অন্যান্য মহল থেকে সমালােচনাও শােনা গেছে। তবে অধিকাংশ শিক্ষাবিদদের মত অনুসারে এই নীতি একদিকে ভারতের সনাতন ঐতিহ্য, তার জ্ঞান পরম্পরা, তার মূল্যবােধ ও চরিত্রগঠনমূলক শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা সম্বন্ধে সচেতন ও এই সমস্ত বিষয়গুলিকে পঠনপাঠনের অন্তর্ভুক্ত করছে। অপরদিকে নতুন বিশ্বায়িত জগতের সঙ্গে তাল রাখার জন্য যে ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, পরিকাঠামাে ও পাঠ্য বিষয়সমূহের প্রয়ােজন সেগুলিকেও। শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করছে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সত্যের আদর্শকেই নীতির সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। নীতির খসড়ার প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রাচীন ও সনাতন ভারতীয় জ্ঞান ও চিন্তা এই নীতি নির্ধারণে আলােকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে। প্রাচীন ভারতের তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, বল্লভির উল্লেখ, চর্চা এবং সেই জ্ঞানকেন্দ্রগুলির থেকে শেখার কথা এই নীতির মধ্যে বারবার উঠে এসেছে। মৈত্রেয়ী, গার্গী থেকে শুরু করে ভারতীয় বিদ্বান ও বিদূষীগণের উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থার এই মৌলিক সংস্কারের কেন্দ্রবিন্দুতে শিক্ষককে রাখা হয়েছে। কারণ যে কোনাে শিক্ষানীতির সাফল্যের চাবিকাঠি শিক্ষক সমাজের হাতে। শিক্ষকরাই সমাজজীবনে সবচাইতে সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ,যদিও বিগত কয়েক দশকে বিভিন্ন কারণে এই সামাজিক সম্মান হ্রাসমান। এই নীতি শিক্ষকদের পুনরায় সেই সম্মানের স্থানে বসানাের কথা বলে ও তাদের সশক্তিকরণের কথা বলে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সকল স্তরেই শিক্ষকদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ, প্রস্তুতি ও কর্মক্ষেত্রে তাদের সঠিক পরিকাঠামাে প্রদানের কথা বলে। আর তাই বি.এড-কে স্নাতক পাঠ্যক্রমের সঙ্গে একত্রিত করে চার বছরের কোর্সে পরিণত করা হচ্ছে। এছাড়াও স্পষ্টভাবে বলা আছে। যে পড়ানাে ছাড়া অন্যান্য অপ্রয়ােজনীয় দায়িত্ব বিশেষ করে নির্বাচনের দায়িত্ব শিক্ষকদের দেওয়া যাবে না।
ছাত্রদের জন্য সর্বস্তরে উন্নত গুণমানের শিক্ষার অঙ্গীকার এই শিক্ষানীতির মধ্যে আছে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য প্রকৃত মানুষ নির্মাণ এবং এই আদর্শের আলােকেই যে এই নীতি প্রস্তুত করা হয়েছে তা খসড়ার প্রথমেই বলা হয়েছে। সমগ্র পাঠ্যক্রম ও পঠনপাঠনের মাধ্যমে এই দেশের সংস্কৃতি ও মূল্যবােধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা উৎপন্ন করার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থা যাতে ‘লেভেলার’ রূপে কাজ করতে পারে অর্থাৎ সকল শ্রেণী, জাতি, অঞ্চল প্রভৃতি ভেদাভেদ নির্বিশেষে যাতে সকল ছাত্র – ছাত্রীর সমান ধরনের উচ্চগুণমান-সম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া যায় তার কথা এই নীতির মধ্যে আছে। তাই এখানে স্পষ্ট বলা আছে যে, এই নীতির সমস্তটাই সরকারি ও বেসরকারি উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর সমানভাবে প্রযােজ্য হবে। ইতিপূর্বে আমরা দেখে অভ্যস্ত যে, সমাজের উচ্চবিত্তদের ছেলে-মেয়েদের জন্য এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা বেসরকারি কনভেন্ট ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ঘিরে এবং সাধারণদের জন্য আরেক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি স্থানীয় ভাষামাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে। এই বৈষম্য সম্পূর্ণভাবে দূর করার কথা এই নীতির মধ্যে আছে।
সকল শিশুর জন্যই তিন বছর বয়স থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের পর্ব শুরু করার কথা বলা হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর পূর্বের এই তিন বছর, শিশুকে বিভিন্ন খেলা ও খেলনার মাধ্যমেই শিক্ষার ভিত স্থাপন করা হবে। এই সময়ে শিশুর পুষ্টি ও শারীরিক বিকাশের উপরও জোর দেওয়া হবে। মিডডে মিল ছাড়াও প্রাত্যহিক পুষ্টিকর জলযােগের ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে ৬-১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এর আওতা বৃদ্ধি করে ৩-১৮ পর্যন্ত করা হয়েছে এবং বিদ্যালয় স্তরকে ভাগ করা হয়েছে ৫+৩+৩+৪ অর্থাৎ চারটি পর্যায়ে। শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশের ৮৫ শতাংশ আট বছর বয়স পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়ে যায়, তাই এই সময়েই নতুন ভাষা শেখা তার পক্ষে সহজ হয়। তাই এই নীতিতে প্রথম থেকেই ত্রিভাষা সুত্রের কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ মাতৃভাষা/স্থানীয় ভাষা ছাড়াও আরও দুটি ভাষা শেখানাে হবে যার চয়ন নির্ভর করবে রাজ্য সরকার ও ছাত্রদের উপর। সারা বিশ্বের অধিকাংশ গবেষণাই আমাদের জানাচ্ছে যে, শিশুদের পক্ষে সবচেয়ে ভালাে পঠনপাঠন হয় নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে। তাই এই নীতিতে বলা হয়েছে যে অন্তত পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। এবং সম্ভব হলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা/আঞ্চলিক ভাষা হবে। আরও স্পষ্ট করা হয়েছে যে এই নীতি সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযােজ্য হবে। বলা বাহুল্য, মাধ্যম মাতৃভাষা হলেও অন্য কোনাে ভাষা ভালােভাবে শেখার ক্ষেত্রে কোনাে বাধা নেই, বরং তিনটে ভাষাই, যার মধ্যে অন্তত দুটি ভারতীয় ভাষা রাখতে হবে, ভালােভাবে। শেখা বাধ্যতামূলক হবে।
ভারতের জ্ঞানপরম্পরা স্পর্শ করার মাধ্যম সংস্কৃত ভাষা। সংস্কৃতের চর্চা প্রােৎসাহিত না করলে এই বিশাল ও সমৃদ্ধ। জ্ঞানপরম্পরা হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল, আর যদি তা হয় তাহলে শুধু ভারতবর্ষ নয় সমগ্র মানবসভ্যতার ক্ষতি। তাই সংস্কৃতশিক্ষাকে সর্বস্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। ত্রিভাষা সূত্রের একটি বিকল্প ভাষা হিসেবে। অবশ্য কোনাে ভাষাকেই বাধ্যতামূলক করা হয়নি, বলা হয়েছে সংস্কৃত বিকল্প হিসেবে থাকা বাধ্যতামূলক কিন্তু সেটাকে চয়ন করার বা না করার স্বাধীনতা ছাত্রের। এছাড়াও ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যক্রমে ‘ভারতের ভাষা’নামক একটি পাঠ্যক্রম থাকবে যেখানে ভারতের সমস্ত ভাষা, তাদের উৎস ও সাহিত্যসম্ভার সম্বন্ধে শেখা যাবে এবং সব ভাষায় প্রাথমিক কিছু বাক্যবিনিময় শেখানাে হবে। সমস্ত ভারতীয় ভাষাকে প্রােৎসাহিত ও বিকশিত করার জন্য বলা হয়েছে যে প্রাথমিক থেকে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত পেশামূলক ও প্রযুক্তিমূলক শিক্ষা-সহ সকল শিক্ষাই ভারতীয় ভাষায় উপলব্ধ হবে ও বিশ্বের সাম্প্রতিকতম গবেষণাগুলিকে সব ভাষায় অনুবাদ করার জন্য একটি উন্নতমানের সংস্থা গঠন করা হবে। এই সদর্থক নীতির ফলে আশা করা যায় যে অল্পসংখ্যক ইংরেজি বলা মানুষের বাইরে যে বিপুল প্রতিভাসম্ভার আমাদের দেশে সুযােগের অভাবে লুকিয়ে আছে, সেই সমস্ত প্রতিভাগুলিকে বিকশিত করতে ও সামনের সারিতে আনতে এই নীতি ফলপ্রসূ হবে।।
তবে এই শিক্ষানীতির সমস্ত প্রস্তাবগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে মূলকাঠামাের অন্তর্ভুক্ত করা। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে মূল শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযােগ পাওয়া যাবে। এতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের পেশার থেকে শিক্ষাব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসকদের প্রবর্তিত শিক্ষানীতি যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শুধু কেরানি তৈরি করা, তার রেশ স্বাধীনতার এত বছর পরও রয়ে গেছে। এর ফলেই আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের সমস্যা এত অধিক। এই বস্তাপচা চিন্তাভাবনাকে অবশেষে বিসর্জন দিয়ে আমরা আমাদের শিক্ষাকে মানুষের পেশার সঙ্গে যুক্ত করতে চলেছি। কামার, কুমাের, ছুতাের, কৃষক, মালী, বিদ্যুৎ মিস্ত্রী প্রভৃতি পেশায় নিযুক্ত দক্ষ কারিগরদের থেকে যে কোনাে একটি বৃত্তিমূলক পেশা শিখে পারদর্শী হবার সুযােগ ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দেওয়া হবে। এতে আমাদের যুবসমাজের জন্য স্বরােজগারের পথ খুলে যাবে ও তার সঙ্গে স্কুলছুটের হারও হ্রাস পাবে। কারণ স্কুলে প্রাপ্ত শিক্ষা নিজেদের জীবন, জীবিকা ও পরিপার্শ্বের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বােধহবে। আবার যারা বিষয়। হিসেবে বৃত্তিমূলক পেশা বেছে নেবেনা সেই ছাত্র -ছাত্রীদের ও অন্তত দশ দিন বাধ্যতামূলকভাবে কোনাে একটি পেশার মানুষের কাছে তাদের কাজ সম্বন্ধে শিখতে হবে। অর্থাৎ এই নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ডাক্তার, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ারদের ছেলে-মেয়েরাও অন্তত কটাদিন এই কামার, কুমােরদের সঙ্গে কাটাবে, তাদের পেশা সম্বন্ধে জানবে, অনুভব করতে শিখবে যে এই সমস্ত কাজেও কেবল কায়িক শ্রম নয়, কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়ােগও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষা যেমন একদিকে সমাজজীবনের সমগ্রতা সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা দেবে, তেমনই সমস্ত পেশার গুরুত্ব বুঝতে ও সেই মানুষগুলিকে যথেষ্ট সম্মান করতেও শেখাবে। সামাজিক সাম্যের আদর্শকে রূপায়তি করতে এই পদক্ষেপের পরিণাম সুদূরপ্রসারী হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।
এই নীতির আরেকটি বহু চর্চিত প্রস্তাব হলাে বিভিন্ন ধরনের বিষয়ের মধ্যে ভেদাভেদের প্রাচীর ভেঙে দেওয়া। একদিকে মূল শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রাচীর ভেঙে যাচ্ছে। অপরদিকে কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য এই পৃথক পৃথক ধারাগুলির মধ্যেও বিভাজনের প্রাচীর ভাঙতে চলেছে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর মধ্যে এবং উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গণেও বিদ্যার্থীরা সমস্ত বিকল্পগুলির মধ্যে থেকে তাদের পছন্দমতাে বিষয়সমূহ বেছে নিতে পারবে। অর্থাৎ কেউ পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে সংস্কৃত পড়তে চাইলে পড়তে পারবে, ইতিহাসের সঙ্গে জীববিদ্যা পড়তে চাইলেও তা পারবে। তার সঙ্গে সঙ্গে সংগীত, চারকলা ও ক্রীড়াকেও পাঠ্যক্রম-বহির্ভূত ‘একস্ট্রা বিষয় হিসেবে না দেখে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত অন্য যে কোনাে বিষয়ের সঙ্গে সমান গুরুত্বসহকারে রাখা হয়েছে। বিষয় চয়নের এই বিস্তার ও স্বাধীনতা যেমন পছন্দমতাে বিষয় নিয়ে পড়াশােনার করার ও ছাত্রের ভবিষ্যত জীবনপথ গঠন করার স্বাধীনতা প্রদান করবে সেরকমই বিভিন্ন ধরনের প্রতিভাকে প্রােৎসাহিত করে আমাদের সমাজের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করবে। এতদিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিভা ও সৃজনশীলতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সকলকে এক ধাঁচে গড়ে তােলার যন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হয়তাে তারই ফলে এদেশে এত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও আমরা অত্যাধুনিক গবেষণার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছিলাম, উদ্ভাবনশক্তি বিকাশের বদলে গতানুগতিককেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি, এর পরিণাম হিসেবে প্রযুক্তির উৎপাদক না হয়ে ভােক্তায় পরিণত হয়েছি। এই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বের দরবারে আমাদের প্রযুক্তির উৎপাদক রূপে দাঁড় করানাের একটা প্রয়াস আমরা এই শিক্ষানীতির মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।।
বৃত্তিমূলক বিষয়ের ক্ষেত্রেই হােক অথবা সাধারণ বিষয়ের পাঠ্যক্রমের ক্ষেত্রেই হােক, এই শিক্ষানীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আঞ্চলিক ও স্থানীয় জ্ঞানপরম্পরাকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে। বলা হয়েছে বৃত্তিমূলক বিষয়ের চয়ন সেই অঞ্চলের ঐতিহ্য ও প্রয়ােজনীয়তা অনুযায়ী হবে এবং পাঠ্যক্রমের সমস্ত বিষয়ের মধ্যে স্থানীয় লৌকিক জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অর্থাৎ স্থানীয় কৃষক, মৎস্যজীবী প্রভৃতির যুগ যুগ ধরে চলে আসা বৃত্তিমূলক জ্ঞানকে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হচ্ছে তার সঙ্গে জনজাতীদের মৌখিক জ্ঞানপরম্পরা বিশেষ করে ভেষজ চিকিৎসার ক্ষেত্রে, পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় ও লৌকিক জ্ঞানের সঙ্গে আজকের বিশ্বের অত্যাধুনিক বিষয়সমূহ যেমন কোডিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ৩-ডি ও ৭-ডি ডিজাইন, ন্যানােপ্রযুক্তি প্রভৃতি। বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এতটাই যে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কোডিং শেখানাের কথা বলা হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বের ভালাে নাগরিক হবার জন্য যে সমস্ত বিষয়ে সচেতনতা দরকার যেমন পরিবেশ রক্ষা ও জৈব প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যরক্ষা প্রভৃতিও পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত করা হয়েছে। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহুবিষয়ভিত্তিক হবে অর্থাৎ কলা-বিজ্ঞান-বাণিজ্য – কৃষিমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি সকল বিষয়ই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানাে হবে। বিএড-এর কোনা পৃথক প্রতিষ্ঠান থাকবে না, বরং বহুবিষয়ভিত্তিক কলেজেই তা পড়ানাে হবে।
উচ্চশিক্ষাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য হাইয়ার এডুকেশন কমিশন অব ইন্ডিয়া গঠনের প্রস্তাব করা করা হয়েছে। এই সংস্থানের অধীনে অন্যান্য বিভিন্ন সংস্থান পাঠ্যক্রম, বিশ্ববিদ্যালয় ও সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি দেখাশােনা করবে। গবেষণাকে প্রােৎসাহিত করতে ও তার গুণমান উন্নত করতে একটি ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন গঠন করা হবে। এই প্রস্তাবগুলিকে কার্যকরী করতে হলে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়ােজন। বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে শিক্ষার অগ্রগতির জন্য ব্যয় করতে প্রােৎসাহিত করা হবে, যদিও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ রােধ করার ব্যবস্থাও বলা হয়েছে। আবার সরকারি ব্যয় প্রচুর বৃদ্ধির সুপারিশও রয়েছে। মােট দেশীয় উৎপাদনের ৬ শতাংশ (যা বর্তমানে ৪.৪৩ শতাংশ) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির। শিক্ষাখাতে মিলিত ব্যয় হওয়া উচিত বলে স্পষ্ট পরামর্শ করা হয়েছে।
এই শিক্ষানীতি যদি সঠিক ভাবে রূপায়িত হয় তবে ভারতবাসী হিসেবে আমরা নিজস্ব জাতীয় পরিচয় অক্ষুন্ন রেখেই একবিংশ শতাব্দীর উন্নত দেশের তালিকায় প্রবেশ করতে পারব। তারই দিকনির্দেশ এই নীতি করেছে। তবে এর জন্য সমস্ত রাজনৈতিক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সব রাজ্য সরকার, শিক্ষা প্রশাসকগণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাবিদদের এগিয়ে এসে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে এর বাস্তবায়ন করতে হবে। তা যদি আমাদের দ্বারা সম্ভবপর হয় তাহলে ভারত আবার সারা বিশ্বে শিক্ষার এক উজ্জ্বল কেন্দ্র হয়ে উঠবে এবং ‘এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ এই স্বপ্নকে আমরা অদূর ভবিষ্যতেই সাকার রূপ প্রদান করতে সক্ষম হব।
রবি রঞ্জন সেন
(লেখক সহযােগী অধ্যাপক, কাটোয়া মহাবিদ্যালয়)