১৯২১ সালের মালাবার মোপলা বিদ্রোহ কি কোনো কৃষক বিদ্রোহ নাকি একটি সুপরিকল্পিত হিন্দু গণহত্যা?

১৯২১ সালের মোপলা বিদ্রোহের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রধান চরিত্র ভারিয়ামকুন্নাথ
কুনজাহমেদ হাজীর বীরত্ব বর্ণনা করে একটি সিনেমা আসতে চলেছে

মোপলা দাঙ্গার বন্দীদের নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী

নতুন দিল্লি: মোপলাহ বিদ্রোহ (১৯১২-২২) ছিলো ভারতের ইতিহাসের একটি কুখ্যাত ঘটনা যা সাধারণ মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছিলো। আর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই জুন মাসে একটি মালায়ালাম সিনেমা আসতে চলেছে‚ যা এই দেশ জুড়ে মূহুর্তে বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে।

বিদ্রোহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত ব্যক্তি ভারিয়ামকুন্নাথ কুনজাহমেদ হাজীর বায়োপিক হিসাবে ভারিয়ামকুন্নান পর্দায় আসতে চলেছে। ২০২১ সালে বিদ্রোহের শতবর্ষে‚ জুন মাসে সিনেমাটি মুক্তি পেতে চলেছে বলে আশা করা যাচ্ছে। এর পরিচালক আশিক আবু‚ আর নামচরিত্রে অভিনয় করবেন পৃথ্বীরাজ।

এই সিনেমায় হাজির চরিত্র ইতিবাচকভাবে দেখানো হবে বলে জানা গেছে। যদিও সবাই তা মেনে নিতে কখনোই রাজি নয়।

হাজীকে গৌরবান্বিত করার এই কুচেষ্ঠার সমালোচনা করে ও মোপলা বিদ্রোহের কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চেয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর প্রচারক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কাজ করা সংগঠন প্রজ্ঞা প্রভার জাতীয় আহ্বায়ক জে. নন্দকুমার বলেছেন যে এই আন্দোলন হিন্দুবিরোধী গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই ছিলোনা।

নন্দকুমার বলেন‚ “এই ইসলামপন্থী প্রকল্পের নায়ক, কুনজাহমেদ হাজী জন্মেছিলো একটি উগ্রবাদী ধর্মান্ধ পরিবারে। এর আগে তার বাবাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চালানোর অভিযোগে মক্কায় নির্বাসিত করা হয়”

তিনি আরো জানান যে‚ “এই কুনজাহমেদই ১৯২১ সালের হিন্দু গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিলো। তাতে হাজার হাজার হিন্দুর গণহত্যা, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, হিন্দু মহিলা ও শিশুদের ধর্ষণ এবং হিন্দুদের সম্পত্তি ও মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিলো।

জানা গিয়েছে যে এই বায়োপিকে কুনজাহমেদকে একজন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক রূপে তুলে ধরা হয়েছে আর হিন্দুদের দেখানো হয়েছে ব্রিটিশদের পক্ষে থাকা খলনায়ক হিসাবে। তার এই “বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা” নাকি দেশের দিকে দিকে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম জাগিয়ে তোলে ও সে কিছু মাসের জন্যে জন্যে স্বাধীন মালায়ালাস্তান (মালয়ীদের দেশ) প্রতিষ্ঠা করে।

তিনি আরো জানান‚ “বাস্তবে, সে যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা হ’ল আল-দৌলা (ইসলামী রাষ্ট্র) যেখানে সে নিজের অঞ্চলের হিন্দুদের উপর জিজিয়া (ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের বেঁচে থাকার জন্যে প্রদেয় কর) চাপিয়ে দিয়েছিল।”

এই জেহাদী অত্যাচার শুরু হয় কেরালার দক্ষিণ মালবারের তিরুরানগাদিতে ১৯১২ সালের ২০ আগস্ট ও চলেছিল একটানা চারমাসেরও বেশী। এর ফলে ১০টা তালুকের মধ্যে ৬টা তেই সামরিক আইন প্রয়োগ করতে হয়েছিলো। এক লাখেরও বেশী হিন্দু এই আন্দোলনের ফলে বাস্তুহারা হয়।”

“মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকরাই প্রথম এই সাম্প্রদায়িক জেহাদী আক্রমণকে কৃষক বিদ্রোহ রূপে তুলে ধরার কাজটি করেছিলো। যাতে এটি তাদের আদর্শিক ন্যারেটিভের সাথে মিলে যায় ও বাম-দলগুলি একটি নির্দিষ্ট সংগঠিত সম্প্রদায়কে ভোটব্যাংক হিসাবে পেতে পারে” নন্দকুমার জানান।

কৃষক বিদ্রোহের এই মিথ্যে তত্ব প্রতিনিয়ত বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে। এই ঘটনার শতবর্ষ উপলক্ষে বিষয়টি প্রায় জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

এই বিদ্রোহ আম্বেদকর‚ সাভারকার ও অ্যানি বেসান্তকে মিলিয়ে যেভাবে দিয়েছিলো

বিনায়ক দামোদর সাভারকরই প্রথম তাঁর সেমি-ফিকশন উপন্যাস “মোপলা”তে এই মোপলা বিদ্রোহকে হিন্দুগনহত্যা রূপে চিহ্নিত করেন। ১৯২৪ সালে প্রকাশের পরপরই বইটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়।

অন্য আরেকটি বই‚ “মোপলা বিদ্রোহ‚ ১৯২১” এর মতে হাজী ছিলো একজন অপরাধী‚ যে এই বিদ্রোহে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বইটি ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়। সেই অঞ্চলের তৎকালীন ডেপুটি কালেক্টর সি. গোপালন নায়ারের লেখা বইটি এই গনহত্যা সম্পর্কিত তথ্য পাওয়ার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বলে বিবেচিত হয়।

নায়ার তার বইতে লিখেছিলেন‚ “হত্যা‚ লুট‚ জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ ও হিন্দু মহিলাদের উপর অত্যাচারই এই সময়ের নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়।”

এমনকি ডাঃ বি.আর. আম্বেদকরও ‘
পাকিস্তানের বিদ্রোহ বা ভারতের বিভাজন’ এ

(ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর, রচনা ও বক্তৃতা, খণ্ড ৮, পৃ – ১৬৩) এই বিদ্রোহ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ লিখে গেছেন। আর তা অবশ্যই মার্ক্সবাদীদের বিবরণের মতো মানুষ ভোলানো চকচকে বিবরণ নয়।

আম্বেদকর লিখেছিলেন‚ “১৯২০ সালে শুরু হয়ে সেই বছর মালাবারে যা চলেছিলো তা মোপলা বিদ্রোহ বলে পরিচত। এটি ছিল দু’টি মুসলিম সংগঠন, খুদ্দাম-ই-কাবা (মক্কার দাস) এবং কেন্দ্রীয় খেলাফত কমিটি দ্বারা পরিচালিত।”

“আন্দোলনকারীরা আসলে এই মতবাদ প্রচার করেছিল যে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ভারত হচ্ছে দার-উল-হার্ব এবং মুসলমানরা অবশ্যই এর বিরুদ্ধে লড়াই করবে এবং তারা যদি তা না করতে পারে তবে তাদের অবশ্যই হিজরতের বিকল্প নীতিটি পালন করতে হবে। এই প্রচারের ফলে মোপলারা হঠাৎ করেই এতে জড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনটি প্রাথমিকভাবে ছিলো ব্রিটিশ বিরোধী। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করে ইসলামের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা।”

ডঃ আম্বেদকর আরও উল্লেখ করেছিলেন যে বিদ্রোহের পেছনের শক্তিগুলি খিলাফত রাজ্য ঘোষণা করেছিল

“ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসাবে এটা হয়তো মানা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হওয়ার বিষয়টি হ’ল মালাবারের হিন্দুদের সাথে মোপলাদের আচরণ” – তিনি লিখেছিলেন।

“মোপলাসদের হাতে হিন্দুদের এক ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল। গণহত্যা‚ জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ‚ মন্দির অশুচি করা‚ মহিলাদের শ্রীলতাহানি ও গনধর্ষন‚ গর্ভবতী মহিলাদের কেটে ভ্রূণ বের করে আনা‚ লুটতরাজ‚ অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসকার্য – সংক্ষেপে বলতে গেলে সবধরণের নির্মম ও অপরিমিত নৃশংসতা মোপলারা প্রয়োগ করেছিলো হিন্দুদের উপর‚ যতক্ষণ না সৈন্যরা এসে দেশের এই অংশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে।

“এটা কোনো হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা ছিলো না। এটা ছিলো স্রেফ একটা জাতিগত নির্মূলীকরণ। কতজন হিন্দু আহত‚ নিহত বা ধর্মান্তরিত হয়েছিল তা জানা যায়নি। কিন্তু সংখ্যাটি অবশ্যই বিশাল ছিলো।”

এই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্রিটিশদের
চার মাসেরও বেশি সময় লেগে গিয়েছিল
। সরকারী রেকর্ডে দেখা গেছে যে ২‚২৬৬ জন নিহত, ১,৬১৫ জন আহত, ৫,৬৮৮ জন বন্দী হয়েছে, এবং ৩৮,২৫৬ জন সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো।

বিংশ শতকের থিওসোফিস্ট এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও
১৯২১ সালের বসন্তে মালাবারের প্রথম ‘সংস্কার সম্মেলন’ এর সভাপতি অ্যানি বেসান্তও এই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন।

ফিউচার অফ ইন্ডিয়ান পলিটিক্সে (থিওসফিক্যাল পাবলিশিং হাউজ‚ ১৯২২‚ পৃ-২৫২) তিনি লিখেছিলেন‚
“এই কর্মসূচী ১৯২০ সালের ১লা আগস্ট শুরু হয়েছিলো। লক্ষ্য ছিলো এক বছরের মধ্যেই স্বাধীনতা অর্জন করা। আর ১৯২১ সালের ১লা আগস্ট মালবার বিদ্রোহের প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তিন সপ্তাহ ধরে অস্ত্র প্রস্তুত করার পর সেই জেলার মুসলমানরা (মোপলারা) নির্দিষ্ট অঞ্চল জুড়ে বিদ্রোহ শুরু করে এই বিশ্বাস করে যে‚ তাদের বলা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়ে গেছে এবং তারা স্বাধীন।”

তিনি আরো লেখেন‚ “তারা খিলাফত রাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলো, একজনকে রাজা হিসাবে বসিয়েছিলো‚ প্রচুর খুন ও লুন্ঠন চালিয়েছে‚ যেসব হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হতে রাজি হয়নি তাদের হয় হত্যা করেছে নয়তো তাড়িয়ে দিয়েছে। কোথাও কোথাও প্রায় লক্ষাধিক মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরনের পোষাকটুকু ছাড়া সবকিছুই তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিলো।”

(লেখক দিল্লি-ভিত্তিক চিন্তন শিবির বিচার বিনিময় কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক)

অরুণ আনন্দ (Arun Anand)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.