বিনায়কের সন্ধানে
কল্যাণ গৌতম
প্রায় আঠেরো-ঊনিশ বছর আগের কথা। আমার এক প্রিয় অভিভাবকের (বর্তমানে প্রয়াত) কাছে যেতে সেদিন তিনি বলেলেন, তোমার এক সহকর্মী-শিক্ষক প্রায়ই আমাকে ফোন করে প্রায় জোর করে তোমার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ শোনান। আমি এতদিন তোমায় বলি নি। আজ তাকে বলে দিলাম, এটা তার বাড়ির ফোন নয়, এক আত্মীয়ের ফোন নম্বর, তাছাড়া আপনার সঙ্গে আমার আলাপও নেই। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে আর ফোন করবেন না। আমি বললাম, শুধু উনি নন, প্রতিষ্ঠানে নানান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব কর্মস্থলে অজস্র কটূকথা বলেন, রোজই চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলেন, রাজনৈতিক ভয় দেখান, হুমকি দেন।
উনি বললেন, তুমি কি তোমার স্তরের অন্য সহকর্মীকে তা খেদের সঙ্গে বলো? বললাম, বলি তো! এর প্রতিকার হওয়া দরকার। বললেন, যতদূর বুঝলাম তোমার কর্মস্থলে শাসকদলের রাজনৈতিক রমরমা। তোমার স্তরেও যারা কাজে আছেন, তারও রাজনৈতিকভাবে ওদের সমর্থক, পক্ষপাতদুষ্ট, তারাও মজা দেখছেন। তুমি যদি এর মোকাবিলা রাজনৈতিক ভাবে করতে না পারো, তোমার অন্য সহকর্মীদের কাছে কটূকথা আর সার্বজনিক করে তুলো না, উপহাসের পাত্র হবে, নিজের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে যাবে। আত্মবিশ্বাস লোপ পেলে কাজ করতে পারবে না। এটা রাজনৈতিক অত্যাচার মনে করে, নিজের উপর বিশ্বাস না হারিয়ে, তুমি বরং এসব তোমার নিজের মধ্যেই সমাহিত করো। এই সমস্যায় শ্রী গণেশ আমাদের ভরসা। আমাদের শাস্ত্রে ‘লম্বোদর’-এর কথা আছে, তিনি বিনায়ক গণেশ। ‘লম্বোদর’ নামটি স্মরণ করলে নিন্দা-কটূক্তি তরল হয়ে যায়, হিন্দুদের এমনই বিশ্বাস। তুমি মাঝেমধ্যে তাঁর অপর নাম ‘ধুম্রকেতু’-র স্মরণ নিও, কর্মজীবনে সকল বাঁধাবিঘ্ন সরিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে এই নাম অদ্বিতীয়, নাম মাহাত্ম্যের কোনো জুড়ি নেই।
যার কাছ থেকে এই ঐশীবাণী পেয়েছিলাম, তিনি জানতেন আমার বৈবাহিক সম্বন্ধ যখন চলছিল ভাবী শ্বশুরালয় থেকে কর্মক্ষেত্রে পাত্র সম্পর্কে খোঁজখবর করতে গেলে (এটা প্রায় সবক্ষেত্রেই দেখাশোনার বিয়েতে করা হয়) অজস্র বাজে কথা বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তারা। খুব স্বাভাবিক কারণেই পাত্রীপক্ষ সহকর্মীদের কাছে মিথ্যে বদনান শুনে, বিবাহ বিষয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্যক মনে করলেন না; চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাদের বিদেশী আত্মীয় ও বন্ধুরা তা জানতে পারলেন। তারা উপদেশ দিলেন, পশ্চিমবঙ্গে বাম-আমলে এটা হামেশাই ঘটে থাকে। তাদের দলে নাম না লেখালে মিথ্যা বদনামের সম্মুখীন হতে হয়, এ তেমনই এক নিদর্শন। চুপচাপ গণপতি বাপ্পার নাম করে বিয়েটা দিয়ে দাও। এই প্রতিষ্ঠানেই বছর পাঁচ-ছয় বাদে দেখা গেল অন্য রাজ্য থেকে পড়তে আসা ছাত্রেরা গণেশ চতুর্থীর উদযাপন করছেন হোস্টেলে এবং সেই সূত্রে তাদের বিচারধারার স্বকীয়তা, মতাদর্শ প্রকাশ পাচ্ছে, যা বামেরা জানতে পারলে সুখকর নয়। যতদূর মনে হয়, প্রতিষ্ঠানের ‘গণশক্তি’ পড়া নেতৃবৃন্দের উপলব্ধির বাইরে ছিল গণপতির ক্ষমতা ও প্রবেশ্যতা কত জোরালো।
গণেশ উৎসবের মাধ্যমে যেভাবে স্বরাজ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলক, সেই একই ধারার স্রোত আনতে চেয়েছিলেন গাণপত্যের উপাসকেরা। তাদের অনেকেই মহারাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন, নাগপুর-সামীপ্যতাও ছিল অনেকের। সে রাজ্যে গণেশ চতুর্থী এক মহোৎসব। গোয়া, গুজরাট, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশে পড়াশোনা করা ছাত্রেরাও সেই উৎসবমুখরতার সঞ্চারক। শিবাজি উৎসবের মতো গণপতি-উৎসবকে সাধারণ মানুষের মধ্যে একত্রিতকরণের কাজে অনবদ্যভাবে ব্যবহার করেছিলেন তিলক। বারোয়ারী মণ্ডপে স্থাপন করে গণেশ মূর্তিকে পারিবারিক আরাধনা থেকে সমষ্টির আরাধনায় নিয়ে গেলেন। মেলবন্ধন ও সঙ্ঘকাজে বিঘ্ননাশকের শুভ-স্মরণ অনুষ্ঠান মাত্রা পেলো।
“সুমুখশ্চৈকন্দতশ্চ কপিলো গজকর্ণক:।
লম্বোদরশ্চ বিকটো বিঘ্ননাশো বিনায়ক:।
ধূমকেতুর্গণাধ্যক্ষো ভালচন্দ্রো গজানন:।
দ্বাদশৈতানি নামানি য: পঠেচ্ছৃণুযাদপি।
বিধ্যাংরভে বিবাহে চ প্রবেশ নির্গম তথা।
সংগ্রামে সংকটে চৈব বিঘ্নস্তস্য ন জায়তে।”
সুমুখ, একদন্ত, কপিল, গজকর্ণ, লম্বোদর, বিকট, বিঘ্ননাশক, বিনায়ক, ধূম্রকেতু, গণাধ্যক্ষ, ভালচন্দ্র তথা গজানন। যাঁরা বিদ্যা শুরুর পূর্বে, বিবাহ, গৃহ প্রবেশ, সংগ্রাম বা সংকটের সময় গণেশের দ্বাদশ নাম জপ করেন, তাঁদের জীবনে কখনই বিঘ্ন আসে না। পশ্চিমবঙ্গে দিকে দিকে গণেশপূজার যে ব্যাপকতা বিগত দুই/আড়াই দশক ধরে শুরু হয়েছে তার পশ্চাতে সাংগঠনিক শুভঙ্করী শক্তির অনবদ্যতা এখনও অপ্রকাশিত। গণপতি বাপ্পা ভাদ্রমাসের শুক্লা চতুর্থীতে গণাধ্যক্ষ হিসাবে সেই সঙ্ঘশক্তির পাল্লা ভারী করতেই এসেছেন। কারণ মানুষ ভারত বিরোধিতার পাল্লা বন্ধ করতে তাঁর আরাধনায় মহারাষ্ট্রের একটি জাতীয় উৎসবকে ১২৫ বছর আগের রূপে মহীয়ান করতে চান।
*গণেশ কল্পনায় অরণ্য-কৃষির যুগলবন্দী:* কৃষিজীবী মানুষ মাত্রেই জানেন হাতি অরণ্য সন্নিহিত কৃষিক্ষেত্রে কতটা বিঘ্নকারী পশু। এই পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে যখন দলমা পাহাড় থেকে দলে দলে হাতির পাল নেমে এসে ফসলের জমি তছনছ করে যায়, তখন তাকে কী বলা যাবে, দেবতা? হাতি নিজেই বিঘ্নকারী আর বিঘ্নের প্রতীক; তার বাহনটিও তো তাই — ইঁদুর পাকা ফসল কাটে, যত না খায় তার চাইতে ঢের সংগ্রহ করে তার গর্তে। সুতরাং একদিকে হাতি, আর একদিকে ইঁদুর; “একা রামে রক্ষা নেই, লক্ষ্মণ তার দোসর”। হাতিমুখো গণেশ সওয়ার হয়েছেন কিনা অলক্ষ্মীরূপী ইঁদুরের পিঠে! কৃষিজীবনের পরতে পরতে এরা সর্বনাশের প্রতিভূ। অন্তত হাতিমুণ্ডধারী, ইঁদুর বাহন ফসল-বন্ধু হতে পারেন না। আর এখানে রয়েছে এক মনস্তাত্ত্বিক লোক-দর্শন; চিন্তার বৈপরীত্য। ভয়ে-ভক্তিতে এক বিঘ্নকারী শক্তি হয়ে ওঠে বিঘ্ননাশক দেবতা। বিঘ্নকারীকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত না করে বিঘ্ননাশকের দরকার লোকসমাজের। মানুষ কল্পনা করলো — যিনি দুর্গতির হেতু, তিনিই আবার কল্যাণময়; তাই ইঁদুর বাহন হস্তিদেবতা যেন ছেড়ে দিয়েছেন তার চিরাচরিত বিঘ্নকারী স্বভাব। চিন্তার এই বৈপ্যরীত্যে ভয়ঙ্কর-শক্তি হয়ে যায় শুভঙ্কর-শক্তি।
আর সেকারণেই ফসল ভক্ষণকারী হাতির পাল হয়ে দাঁড়ায় কৃষি সহায়ক দেবতা।নৃতত্ত্বের ভাষায় গণেশ হচ্ছেন থেরিওমর্ফিক দেবতা বা অর্ধ-মানুষ দেবতা; তার মুণ্ডটি প্রাণীর আর বাকি অংশটি মানুষেরই মতো। অরণ্যের প্রান্তবাসী লোকসমাজের কাছে গণেশ কেবল হস্তীদেবতাই নন, তিনি হাতিদেরও দেবতা। গণেশ তার হাতি রূপে বন্যপ্রাণী আর অরণ্য-সংস্কৃতির প্রতীক। সভ্যতার বিবর্তনে দেখি আদিতে ছিল অরণ্য-কেন্দ্রিক মানব সভ্যতা — বনের ফল-মূল সংগ্রহ আর পশুশিকার করেই করেই মানুষের খাদ্য-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল; কৃষি-সভ্যতা এসেছে অনেক অনেক পরে।বন ছেড়ে মানুষ যখন বন-সংলগ্ন জমি হাসিল করে মানুষ চাষাবাদ শুরু করলো, তার লোভে দলে দলে আবির্ভূত হল বনের শাকাহারি, তৃণভোজী পশুর পাল। তাদের থেকে ফসলকে বাঁচাতে আদিম মানুষ সর্তক হল আর তাদের প্রাচীন রীতিতে বনের পশুকে সন্তুষ্টকরণ করতে উদ্ভূত হল হস্তী দেবতা, তিনিই আজকের সিদ্ধিদাতা গণেশ।