একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই – বিশ্বভারতীর আদর্শ।
সেই আদর্শ নাকি আর নেই, তাই গোটা শান্তিনিকেতনই গোল্লায় গেল।
আমি বিশ্বভারতীর প্রাচীন অর্বাচীন নানা জনের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলেছি, জানতে চেয়েছি এই আদর্শ ব্যাপারটা কি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে নানা মুনির নানা মত।
কেউ বলেন এটা, কেউ বলেন ওটা ।
মনে আছে ১৯৫৩ সালে ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী বিশ্বভারতীর উপাচার্য হবার পর বিশ্বভারতীর আদর্শ কি এবং এবং কোথায় কতটা নষ্ট হচ্ছে তা আলোচনার জন্য সব অধ্যাপক ও কর্মীদের এক আলোচনা সভায় ডাকেন। আমিও তাতে উপস্থিত ছিলাম। দুদিন আলোচনার পরেও কোন স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল না। বরং তুমুল তর্ক হয়ে গেল নানা জনের মধ্যে। প্রাচীন কেউ কেউ স্পষ্ট করে ব্যাপারটা ব্যাখ্যাও করতেও পারলেন না।
শেষ পর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বিশ্বভারতীর আদর্শ হচ্ছে কিছুটা “আদর” আর কিছুটা “শো”। আর মুজতবা আলির মতে, গুরুদেব ঠিক করতে পারেননি বিশ্বভারতীতে “বিশ্ব” বা ” রথী”, কে বেশি অগ্ৰাধিকার পাবে। ( রথীন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছেলে। )
ঠাট্টা থাক, আসল কথায় আসি। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনে রবীন্দ্রনাথের একটা বিশেষ চিন্তা নিশ্চয়ই কাজ করেছিল। প্রাচীন তপোবনের আদর্শ তাঁকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রধানতঃ ভগিনী নিবেদিতা ও ব্রম্ভবান্ধব উপাধ্যায়ের প্রেরণাতেই তিনি ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বোলপুর ব্রম্ভচর্যাশ্রম। নগ্নপদ মুন্ডিতমস্তক কাষায়বস্ত্রধারী আশ্রমবটুদের বৃক্ষতলে শিক্ষা দেবেন একালের যাজ্ঞবল্ক্য বশিষ্ঠ গৌতমরা। আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথ ও আশ্রমজননী মৃনালিনী দেবী। একসঙ্গে আহার বিহার উপাসনা শিক্ষালাভ ইত্যাদি এবং তার জন্যে কোন অর্থগ্ৰহণ করার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু তা কি বেশিদিন চলে ? সর্বাধ্যক্ষ পদ ত্যাগ করে ব্রম্ভবান্ধব উপাধ্যায় চলে গেলেন। তারপর আসতে লাগলেন একের পর এক মোহিতচন্দ্র সেন, ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল প্রমুখ। নতুন নতুন নিয়ম চালু হয় এবং নতুন নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা বর্ষে বর্ষে পরিত্যক্ত হয়।
প্রথমে ঠিক ছিল ছাত্রীদের প্রবেশ নিষেধ। পরে প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত হল। বেতন নেওয়া চালু হল। মস্তকমুন্ডন বন্ধ হল। পরীক্ষা ছিল না, তার ব্যবস্থাও করা হল। ১৯০১ থেকে ১৯২০ – এই কুড়ি বছর বিস্তর অদলবদলের পর বোলপুর ব্রম্ভচর্যাশ্রম হয়ে গেল বিশ্বভারতী।
বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের চিন্তাধারার সঙ্গে মিলিত হল লেঁভি বিন্টারনিৎজ লেজনি প্রমুখ বিদেশী পন্ডিতদের চিন্তাধারা। তারও পরিবর্তন হল প্রত্যেক দশকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরও পরবর্তী দু তিন দশকে তার আরও বদল হল। এখন যা অবস্থা, তাতে রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতী রয়ে গেছেন শুধু নামে।
১৯৫১ সালে যখন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল তখন বলা হয়েছিল ইউনিভার্সিটি অফ ন্যাশনাল ইম্পর্টেন্স। এখন বলা যেতে পারে ইউনিভার্সিটি অফ ন্যাশনাল ওয়েস্টেজ।
তখন বলা হয়েছিল, বিশ্বভারতী শুড নট বি দ্য রেপ্লিকা অফ আদার ইউনিভার্সিটিজ। হয়নি, হয়েছে রেপ্লিকা অফ অল ফোর্থক্লাস ইউনিভার্সিটিজ। শুধু পাবলিকের অর্থ নষ্ট। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা। সবই রবীন্দ্রনাথের নাম করে।
কিন্তু আজকাল শান্তিনিকেতনে সব শস্যেরই চাষ হয়, বাদ শুধু রবিশস্য।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীর গয়না বন্ধক দিয়ে ইস্কুল চালিয়েছেন আর এখনকার কর্মীরা স্ত্রীর গয়না দিয়ে ব্যাঙ্কের সব লকার ভর্তি করে ফেলেছেন। এখন যদি কোন অধ্যাপককে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী কোন অনুষ্ঠানের কোন কাজ করতে বলা হয় , তাহলে ওঁরা বলেন, এটা ইউ জি সি অর্থাৎ ইউনিভার্সিটি গ্ৰান্টস কমিশন করতে বলেনি। আর যদি ইউ জি সির নির্দেশিত কোন দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়, তখন ওঁরা বলেন, আমরা আশ্রমের লোক, ওটা করব না। চমৎকার আচরণ। গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব এবং সুযোগমত বিশ্বভারতীর ‘আদর্শ’ ‘আদর্শ’ বলে চেঁচাব।
শান্তিনিকেতনের সুনাম ছিল তার নানা বৈশিষ্ট্যে। নাচ গান ছবি প্রকৃতি খেলাধূলা লেখাপড়া মিলিয়ে এক সামগ্ৰিক জীবন। রবীন্দ্রনাথ বাঁধাধরা শিক্ষার বাইরে একটা উন্মুক্ত আনন্দময় শিক্ষা প্রচলন করেছিলেন। আজ তার ছিঁটেফোটাও নেই, অথচ রবীন্দ্রনাথের আদর্শ ও বিশ্বভারতীর আদর্শের নাম করে দেশবাসীর টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে।
আসলে গন্ডগোল করেছেন গোড়াতেই — রবীন্দ্রনাথ। তিনি একসঙ্গে যাজ্ঞবল্ক্য কালিদাস ও বিক্রমাদিত্য হতে চেয়েছিলেন। কালিদাস আর যাই করুন, গুরুগৃহের বর্ণনা দিয়েছেন, গুরুগৃহ প্রতিষ্ঠা করেননি। বিক্রমাদিত্যের মত রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনেও নবরত্নসভা বসিয়েছিলেন, কিন্তু বিক্রমাদিত্যের মত অর্থবল তার ছিল না। যাজ্ঞবল্ক্যদের আশ্রম তাদের মৃত্যুর পর বন্ধ করে দেওয়া হত। শিষ্যরা অন্যত্র আশ্রম খুলতেন। শান্তিনিকেতন নামক আশ্রমকে রবীন্দ্রনাথ নামক যাজ্ঞবল্ক্যর মৃত্যুর পরেও জিইয়ে রেখে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। এই সম্পর্কে শান্তিনিকেতনের বিশিষ্ট ছাত্র প্রমথনাথ বিশী যথার্থই বলেছেন —
” রবীন্দ্রনাথ কি ভরসা নিয়ে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠায় নেমেছিলেন ? তাঁর ধারণা হয়েছিল ব্রম্ভচর্যাশ্রম নাম শুনলেই দেশের ধনীদের টাকার থলি আলগা হবে। তার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। বরন্চ থলিগুলোর মুখ আরো চেপে বাঁধা হল। সংস্কৃত কাব্য বিশেষ করে কালিদাসের কাব্য পড়ে তাঁর মনের মধ্যে প্রাচীনকালের গুরুগৃহ সম্পর্কে একটা মনোরম ধারনার সৃষ্টি হয়েছিল। একথা তিনি অনেকবার অনেক স্থানে লিখিত আকারে বলেছেন। কাজে নেমে তার দুরূহতা দেখবার পরে বুঝতে পারলেন কালিদাস যে সব গুরুগৃহের বর্ণনা করেছেন, তাতে কোন বাজেটের বিবরণ দেননি। সেকালে রাজার রাজস্বের এক ষষ্ঠাংশ এইসব গুরুগৃহের জন্য বরাদ্দ ছিল। কাজেই বাজেটহীন কল্পনার প্রেরণায় কালিদাস শকুন্তলা কুমারসম্ভব ও রঘুবংশ প্রভৃতি লিখে গেছেন। এই সত্যটি আগে মনে হলে হয়ত কিন্চিৎ সন্তর্পণে অগ্ৰসর হতেন।”
এই ধরনের স্বকৃত ভ্রমের সংশোধন বিশ্বভারতী বা ব্রম্ভচর্যাশ্রমের ক্ষেত্রে বারবার করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। ফলে ১৯০১ সালের আদর্শ আর ১৯৩৫ সালের আদর্শে অনেক ফারাক থেকে গেছে। এখন আমাদের জিজ্ঞাস্য, আদর্শ মাথায় থাকুক, আদর্শের নাম করে বিশ্বভারতী জনসাধারণের টাকা নিয়ে আর কতদিন ছিনিমিনি খেলবে ?
প্রবন্ধ ; উলটপুরাণ
লেখক ; অমিতাভ চৌধুরী
শনিবারের চিঠি, ২২শে মার্চ , ১৯৮৬
এই লেখাটি সংকলিত হয়েছিল ” মতান্তরে ” বইতে, যেটি একটি প্রবন্ধসংকলন।
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরী ( ১৯২৭ – ২০১৫ ) শান্তিনিকেতনে শিক্ষা সমাপ্ত করে কিছুদিন সেখানে অধ্যাপনা করেন । পন্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেন । বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব সুনামের সঙ্গে পালন করেছেন। পরে যুগান্তর ও আজকাল সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। রবীন্দ্র – বিশেষজ্ঞ এই মানুষটির নিজের কথাতেই, ” আলখাল্লার ভিতরের মানুষ রবিকে চেনানোর চেষ্টা করেছি চিরকাল।”
১৯৮৩ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন।
অসংখ্য বই লিখেছেন, যার মধ্যে অন্যতম হল রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, রবি ইত্যাদি।
পোস্ট ; ঋতুপর্ণ বসু