ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং গনপতিং বিদ্যুদ্বর্ণং গজাননং ।
শ্বেতাম্বরং সিতাব্জস্থং স্বর্ণমুকুট শোভিতম্ ।।
শ্বেতমূষিক পৃষ্ঠন্যস্তবামচরনং সিদ্ধিদং ।
বামজান্বারোপিতদক্ষিনপদং চতুর্ভুজম্ ।।
অর্থাৎ যিনি বিদ্যুৎবর্ণ, গজানন, শ্বেতবস্ত্র পরিহিত, শ্বেতপদ্মে অবস্থিত, মাথায় স্বর্ণমুকুট শোভাস্থিত, যাঁর বামচরণ শ্বেতমূষিকের পৃষ্ঠে রাখা এবং বাম পা হাঁটুর ওপর অবস্থিত। যিনি সিদ্ধিদাতা ও চতুর্ভুজ, বাম দিকের দুই হাতে শঙ্খ ও চক্র, ডান দুই হাতে পুস্তক ও লেখনী ধারণকারী সেই সিদ্ধিদাতা শ্রীগণেশকে আরাধনা করি।
হ্যাঁ, গনেশ ঠাকুর , সনাতন ও সকল সনাতনী মার্গে তিনি প্রথম পূজ্য দেবতা। তিনি ভারত ও বৃহত্তর ভারত একল স্থানে পূজ্য এবং আরাধিত । তিনি একত্রে বুদ্ধি এবং সকল কর্মের সিদ্ধি দান করেন । তিনিই গণপতি, পিল্লাইয়ার ,বিঘ্নেশ্বর, যানইমুগতবন, বিনায়ক, গজপতি, একদন্ত। #গনেশ এই নামের অর্থ কি ?
গণেশ’ নামটি একটি সংস্কৃত শব্দবন্ধ। ‘গণ’ ও ‘ঈশ’ শব্দদুটির সন্ধির মাধ্যমে এই শব্দটির উৎপত্তি। ‘গণ’ শব্দের অর্থ একটি গোষ্ঠী, সমষ্টি বা বিষয়শ্রেণি এবং ‘ঈশ’ শব্দের অর্থ ঈশ্বর বা প্রভু। গণেশের নামের পরিপ্রেক্ষিতে ‘গণ’ শব্দটির মাধ্যমে বিশেষভাবে একই নামের একপ্রকার উপদেবতার গোষ্ঠীকে বোঝায়। এঁরা গণেশের পিতা শিবের অনুচরবর্গ। সাধারণভাবে ‘গণ’ বলতে বোঝায় একটি বিষয়শ্রেণি, শ্রেণি, গোষ্ঠী, সংঘ বা জনসমষ্টি। কোনো কোনো টীকাকারের মতে, ‘গণেশ’ নামের অর্থ ‘গোষ্ঠীর ঈশ্বর’ বা পঞ্চভূত ইত্যাদি ‘সৃষ্ট বিষয়সমূহের ঈশ্বর’।
‘গণপতি’ নামটি গণেশ নামের সমার্থক। এটিও একটি সংস্কৃত শব্দবন্ধ। ‘গণ’ ও ‘পতি’ শব্দদুটির মিলনের মাধ্যমে এই শব্দটির উৎপত্তি। এখানে ‘গণ’ শব্দের অর্থ গোষ্ঠী এবং ‘পতি’ শব্দের অর্থ শাসক বা প্রভু। গণপতি শব্দটির উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় ঋগ্বেদের ২য় মণ্ডলের ২৩ সূক্তের ১ম শ্লোকে।
প্রাচীন সংস্কৃত অভিধান অমরকোষ গ্রন্থে ‘গণেশ’ নামের আটটি সমার্থক শব্দ পাওয়া যায়। এগুলি হল: ‘বিনায়ক’, ‘বিঘ্নরাজ’ (যা ‘বিঘ্নেশ’ নামেরও সমার্থক), ‘দ্বৈমাতুর’ (যাঁর দুইজন মাতা), ‘গণাধিপ’ (যা ‘গণপতি’ ও ‘গণেশ’ নামেরও সমার্থক), ‘একদন্ত’ (যাঁর একটি দাঁত, এখানে গণেশের হস্তীমুণ্ডের বাইরের দাঁতের কথা বলা হয়েছে), ‘হেরম্ব’, ‘লম্বোদর’ (যাঁর স্ফীত উদর) ও ‘গজানন’ (যাঁর গজের ন্যায় মস্তিক)।
‘বিনায়ক’ নামটি গণেশের একটি বহুল-পরিচিত নাম। এই নামটি পুরাণ ও বৌদ্ধ তন্ত্রগুলিতে বহু বার উল্লিখিত হয়েছে। মহারাষ্ট্রের আটটি বিখ্যাত গণেশ মন্দিরের নামকরণের ক্ষেত্রেও এই নামটির প্রতিফলন লক্ষিত হয়। এই আটটি মন্দিরকে ‘অষ্টবিনায়ক’ । তিনি বিঘ্নেশ’ ও ‘বিঘ্নেশ্বর’ ,তাঁর প্রধান কাজ বিঘ্নের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন ও বিঘ্ন অপসারণ।
তামিল ভাষায় গণেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল ‘পিল্লাই’ বা ‘পিল্লাইয়ার’ । এ. কে. নারায়ণের মতে, ‘পিল্লাই’ শব্দের অর্থ ‘শিশু’ এবং ‘পিল্লাইয়ার’ শব্দের অর্থ ‘মহান শিশু’। তিনি আরও বলেছেন যে, দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠীতে ‘পাল্লু’, ‘পেল্লা’ ও ‘পেল্ল’ শব্দগুলির মাধ্যমে ‘দাঁত বা হাতির দাঁত’ বোঝায়। অনিতা রাইনা থাপান বলেছেন যে, ‘পিল্লাইয়ার’ নামটির মূল ‘পিল্লে’ শব্দটির আদি অর্থ সম্ভবত ‘হস্তীশাবক’। কারণ, পালি ভাষায় ‘পিল্লাকা’ শব্দের অর্থ তাই।
বর্মি ভাষায় গণেশ ‘মহা পেইন্নে’ । এই নামটির উৎস পালি ‘মহা বিনায়ক’ নামটি। থাইল্যান্ডে গণেশের জনপ্রিয় নামটি হল ‘ফ্রা ফিকানেত’। অধুনা ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম ভূখণ্ডে প্রাচীনতম যে সব মূর্তি ও উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে, তা খ্রিস্টীয় ৭ম ও ৮ম শতাব্দীর সমসাময়িক ।এগুলিতে ভারতের ৫ম শতাব্দী বা তার পূর্ববর্তী গণেশ মূর্তি ও তার বিবরণের প্রতিফলন দেখা যায়।
শ্রীলঙ্কার সিংহল বৌদ্ধ অঞ্চলগুলিতে গণেশ ‘গণ দেবিয়ো’ নামে পরিচিত। সেখানে বুদ্ধ, বিষ্ণু, স্কন্দ ও অন্যান্য দেবতার সঙ্গে গণেশ প্রথম পূজ্য হন ।
শ্রীতত্ত্বনিধি গ্রন্থে উল্লিখিত গণেশের ৩২টি রূপের প্রথমটি হলেন বাল-গণপতি। গণেশের অন্যান্য রূপের মতো তিনিও গজানন। শুধু এই রূপে তাঁর শৈশবাবস্থা কল্পিত হয়েছে। কোনো কোনো গ্রন্থে তাঁকে শিশু রূপে বর্ণনা না করে শুধুমাত্র তাঁর শিশুসুলভ মুখভঙ্গিমাটি বর্ণনা করা হয়েছে।তাঁর গলায় সদ্য প্রস্ফুটিত পুষ্পের একটি মালা দোদুল্যমান। তাঁর চার হাতে রয়েছে আম, আম্রশাখা, ইক্ষুদণ্ড ও একটি মিষ্টান্ন। অন্য একটি বর্ণনা অনুসারে, তাঁর চার হাতে থাকে আম, কলা, কাঁঠাল ও ইক্ষুদণ্ড। এই বস্তুগুলি পৃথিবীর “অতিপ্রাচুর্য ও উর্বরতা”র প্রতীক। কোনো কোনো বর্ণনায় আবার কাঁঠালের পরিবর্তে পুষ্পস্তবকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর শুঁড়ে থাকে একটি মোদক অথবা কয়েতবেল। তাঁর গাত্রবর্ণ “বালসূর্য” বা নবোদিত সূর্যের মতো লাল। অন্য বর্ণনা অনুসারে, তার গায়ের রং স্বর্ণাভ।
ঋগ্বেদে বলা হয়েছে –
গণানাং ত্বাং গণপতি হবামহে কবিং কবীনামুপমশ্রবস্তম্।জ্যেষ্ঠরাজং ব্রহ্মণাং ব্রহ্মণস্পত আ নঃ শৃন্বন্নূতিভিঃ সীদ্ সাদনম্।।
তাঁকেই পরম ব্রহ্ম স্বরূপ উপলব্ধি করে গাণপত্য সম্প্রদায়ের উদ্ভব। পঞ্চদেবতার মধ্যে গনেশ হলেন অন্যতম। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে এই সম্প্রদায় বিশেষ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। পরে মোরয়া গোসাবি এই ধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় সপ্তদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় মহারাষ্ট্র অঞ্চলে গাণপত্য সম্প্রদায় বিশেষ প্রাধান্য বিস্তার করে। এখনও উচ্চবর্ণীয় মারাঠিদের মধ্যে ও দক্ষিণ ভারতে এই মত বিশেষ জনপ্রিয়।
গুপ্তযুগে প্রাপ্ত কয়েকটি গণেশমূর্তি অষ্টভূজ থেকে দশভূজ। আবার তন্ত্রগ্রন্থ তন্ত্রসার, কাশ্মীরে, নেপালে ও গান্ধারের কোনও কোনও ক্ষেত্রে গণেশের বাহন সিংহ। এদিকে প্রসন্ন গণেশ সাধারণ রূপেই বিরাজমান।
একটি কথা বলে রাখি, সুপ্রাচীন কাল হতে মানব সনাতনী। মানব নিরাকার যেকোনো শক্তিকে উপাসনা করে এসেছেন। সেই শক্তি আদি, অন্তত। সেই শক্তি আসে নানারূপে এবং নানা ভাবে মহাশূন্য থেকে। সেই শূন্য এবং শক্তি কল্যাণকামী। তার উপাসনা চিরকাল ছিল। এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। মহামায়ার সংসারে সুখকে খুঁজে নিতে হয়। মৃত্যুময় জগতে মানবকে অমৃতের সন্ধান করতে হয় ।
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাআ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ ।।
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ ।
তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতিনান্যঃ পনথা বিদ্যতে অয়নায় ।। (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ ) শোনো বিশ্বজন ,শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণদিব্যধামবাসী , আমি জেনেছি তাঁহারেমহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারেজ্যোতির্ময় । তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহিমৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো , অন্য পথ নাহি ।
যা বা যার থেকে মানব খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান পায় বা উপকৃত হয় তাই পূজ্য। আদিম সনাতনী বিশ্বাস এমনই। প্রতিটি মানবজাতির মধ্যেই সেই ব্রহ্ম ও শক্তির অবস্থান ছিল নানাভাবে , নানা রূপে। সেখানে ব্রহ্মই হলেন রুদ্র , সয়ম্ভূ, আদিম এবং শক্তি হলেন আদি পরাশক্তি। তাঁরা বৃক্ষ, শিলা, জল, বাতাস , আলোক , নদী , ভূমি , সূর্য , চন্দ্র, গ্রহ, তারা সর্বত্র অবস্থান করেন। নিরাকার থেকে তখন তাঁরা সাকার হয়ে ওঠেন।
বিষ্ণু রূপে শালগ্রাম শীলা, শিব রূপে লিঙ্গ , ধর্ম রূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু। এগুলিই শূন্য ও শক্তি স্বরূপ। তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর। সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা। বিষ্ণু , শিব, দুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ। আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন। সুরেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেছেন – ” অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না। “
আমরা দেখিতে পাই , নিরাকার সেই পরম ব্রহ্মের উপাসনা দেহিদের পক্ষে অতি কষ্টকর । এইজন্যই নানা রূপে তাঁহার উপাসনা ব্যবহার দেখা যায়।”
ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থী তিথিতে গণেশের পূজা বিধেয়। সাধারণত এই দিনটি ২০ অগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মাঝে কোনো এক দিন পড়ে। দশদিনব্যাপী গণেশোৎসবের সমাপ্তি হয় অনন্ত চতুর্দশীর দিন। ভাদ্রপদ শুক্লপক্ষ চতুর্থী মধ্যাহ্নব্যাপিনী পূর্বাবিদ্ধ – এই পূজার প্রশস্ত সময়। চতুর্থী দুই দিনে পড়লে পূর্বদিনে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি দ্বিতীয় দিন মধ্যাহ্নের সম্পূর্ণ সময়ে চতুর্থী বিদ্যমান হলেও পূর্বদিন মধ্যাহ্নে এক ঘটিকার (২৪ মিনিট) জন্যও যদি চতুর্থী বিদ্যমান থাকে তবে পূর্বদিনেই গণেশ পূজা নিয়ম।
আজ এই বাল্য রূপী ছোট্ট গণেশের একটি গল্প বলি। ঈশ্বর সর্বদা দর্প চূর্ণ করেন । তিনি অহং বিনাশ করেন। তাই ঈশ্বরকে পেতে গেলে কাম, ক্রোধ, অহং, লোভ ইত্যাদি ষড়রিপুর দোষ পরিত্যাগ করতে হয়। সেই কোন সুপ্রাচীন কাল থেকে মুনি, ঋষি, রাজা , মহারাজা , দেব , দানব, দৈত্য হতে সাধারণ মানুষ সকলের দর্প চূর্ণ করেন তিনি , নানাভাবে , নানা রূপে। লক্ষ্মীর বরপুত্র ছিলেন কুবের । তিনি প্রচুর ধনসম্পদ ঐশ্বর্যের মালিক। তাঁর কোনো অভাব নেই। প্রাচুর্যে বিলাসে তিনি এক সময় অত্যন্ত গর্বিত হয়ে উঠলেন।
তাঁর এত সম্পদ ছিল যে তিনি প্রায়ই তাঁর কুবের পুরীতে নানা অনুষ্ঠান করতেন। ত্রিলোক থেকে দেব, ঋষি, পন্ডিত, রাজা সকলে সেসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন। প্রচুর সোনা রূপার উপঢৌকন পেতেন তাঁরা। এমন করতে করতে একদিন কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে কুবের ভাবলেন , “এবার যদি অনুষ্ঠানটি কেবলমাত্র দেবাদিদেব এবং দেবীশক্তিকে কেন্দ্র করে করি এবং তাঁদের আমার গৃহে আমন্ত্রণ জানাই তাহলে নিশ্চয় ত্রিলোকে আমার এক অমোঘ দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। দেব , দানব , দৈত্য ,যক্ষ, গান্ধর্ব , মানব সকলে কেবল আমার জয়জয়কার করবেন না বরং আমার প্রাচুর্য , আমার ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হবেন।” এই ভেবে কুবের অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। দিকেদিগন্তে সেই সংবাদ মত্ত অগ্নির ন্যায় , উত্তাল বায়ুর ন্যায়, উদ্ধত বারিধারার ন্যায় ছড়িয়ে পড়ল।
মহযোগী মহাজ্ঞানী সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের অধিকারী মহারুদ্র তুষারাবৃত পর্বতের শিখরে বসে ধ্যান যোগে সকল ঘটনা সম্পর্কে অবগত হচ্ছিলেন। তিনি কেবল অপেক্ষায় ছিলেন কবে কুবের তাঁর নিকট আসেন ?
এদিকে অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে এল। অজস্র নতুন অতিথি গৃহ নিৰ্মাণ করলেন কুবের। সোনা , রূপার অজস্র তৈজস পত্রাদি, পাকশাল, গৃহসজ্জার সামগ্রী নির্মিত হল। এই মহাউৎসবে সকলে নিমন্ত্রিত হলেন । এবার কুবের চললেন মহাদেব এবং মহাশক্তিকে নিমন্ত্রণ করতে । মহাকাল তখন ধ্যানমগ্ন। তাঁর পায়ে পড়ে কুবের স্তব করতে লাগলেন । মহাদেব সব জানতেন, তিনি তাঁর পদ্মলোচন উন্মোচিত করে বললেন , ” বল কুবের , কি তব অভিলাষ ? অবশ্য তোমার তো কিছুরই অভাব নেই যে তোমার কোনো অভিলাষ থাকবে। তবুও বল …”
কুবের করজোড়ে বললেন , ” মহাদেব আপনি আমার গৃহের অতিথি হন । এই টুকুই অভিলাষ আমার। “
দেবাদিদেব হেঁসে বললেন , ” কুবের ,আমি সন্ন্যাসী, যোগী । আমি শ্মশান চারী। আমি গৃহী হয়েও গৃহস্থ নয়। আমাকে জগৎ ত্যাগের মূর্ত রূপে পূজা করেন। তাই তোমার মনোরঞ্জন আমি পূরণ করতে পারব না। এই সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের ব্রহ্মাণ্ডের প্রতি কণায় আমি বিরাজিত তাই আমার বহু কাজও বাকি। তুমি একবার দেবী পার্বতীর নিকট আবেদন করতে পার। তবে আমি ও তিনি এক , তাই আমি না গেলে তিনিও যাবেন না বোধয়। তাও ….”
কুবের গিয়ে দেবীর পায়ে পড়লেন। বললেন , ” হে মাতা, মহাদেবী আমি যে সকলকেই বলে ফেলেছি আপনাদের আমার গৃহে আগমনের কথা । আপনি চলুন দেবী । নাহলে আমার মুখ পুড়বে। “
দেবী আদিশক্তি স্বরূপ পার্বতী বললেন , ” কুবের তোমার এসব অনুষ্ঠানের নির্ণয় নেবার পূর্বে একবার আমার অনুমতির কি প্রয়োজন পড়ে নি ? অবশ্য তুমি ধনপতি , তবে কিনা আমি আদিদেব ব্যতীত কোথাও যাব না। তিনি যখন না করেছেন তখন আমারও যাবার প্রশ্ন ওঠে না ।”
কুবের কেঁদে পড়ে বললেন, ” মা গো, এখন আমি কি করি? আমার গৃহে আপনাদের দর্শনের নিমিত্ত সকল অথিতির আগমন সূচিত হয়েছে।”
পার্বতী স্মিত হেঁসে বললেন , ” তোমার জন্য একটি যোজনা আমি ভেবেছি। তুমি পুত্র গনেশকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাও। সে ছোট এবং খাদ্যরসিক। সে খুবই খুশি হবে আর তুমিও তাকে খাইয়ে আনন্দিত হবে।”
কুবের অনেক ভেবে বললেন, ” বেশ তাই হোক। গণপতি খুবই ছোট । তিনি আর কত খাবেন ? ওনার বয়সী হাজার হাজার শিশুদের খাবার ব্যবস্থা আছে। তাই উনি যত ইচ্ছে খাবেন। মনে হয় শেষ করতে পারবেন না।”
পার্বতী হেঁসে বললেন, ” বেশ, দেখা যাক কি হয়?”
কুবের স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তন করলেন। উৎসবের জন্য তাঁর পুরীতে যক্ষ পাহাড়া আরো দৃঢ় করলেন। সকলকে সূচিত করলেন যে , গনেশ আসছেন। উৎসবের দিন কাছে এসে পড়ল। সকল দেব, পন্ডিত, মহারাজা , রাজকুমার, গন্ধর্ব, যক্ষ তাঁদের পরিবার পরিজন নিজে সুসজ্জিত হয়ে কুবের গৃহে উপস্থিত হতে লাগলেন। বিশাল আয়োজন দেখে সকলে অবাক হয়ে গেলেন।
উৎসবের দিন প্রভাতে গনেশ এলেন খুব সুন্দর করে সেজে। তাঁর মাথা ঝুঁটি, তাতে ময়ূর, কোনো এক নাম না জানা ফুলের সাজে তাঁকে সাজিয়ে দিয়েছেন মা। কপালে চন্দনের প্রলেপ। সবাই ছোট্ট গণেশের ভুবন ভোলানো রূপ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। অবশ্য গণেশের তখন বেজায় ক্ষিদে পেয়েছিল। কুবের গনেশকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁর বৈভব ও প্রাসাদ দেখালেন। তারপর, তাঁর সঙ্গে মহারাজা , পন্ডিত প্রমুখের পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে গনেশ বললেন , ” আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত। আগে আমার ক্ষুন্নিবৃত্তি করো তারপর এসব পরিচয় করব।”
কুবের তখন গণেশকে নিয়ে গিয়ে এক সুবিশাল ভোজনশালায় বসালেন। সেখানে চারিদিকে সোনার প্রদীপে উৎকৃষ্ট মানের ঘি দহন হচ্ছে, গবাক্ষে গবাক্ষে প্রদীপের আলোয় আলোকিত, চারিদিকে সুগন্ধি ধূপ ধুনায় সুবাসিত, গন্ধর্বলোকের সুরমূর্ছনায় সকল দিক সেথায় ধ্বনিত হচ্ছে। কুবের পত্নী খুব পরিপাটি করে গনেশকে খাবার পরিবেশন করলেন সোনার থালা। বসতে দিলেন হীরা মানিক খচিত আসনে। খেতে দিলেন দেবভোগ্য সুস্বাদু সব খাদ্য। গনেশ মহাখুশিতে ভোজন শুরু করলেন।
কিন্তু কি অবাক ব্যাপার । নিমেষের মধ্যে সব খাবার শেষ হয়ে গেল। বারংবার সব থালা বাটি ভরে দিয়ে গেল পাচক , ভৃত্য, পরিজন, পরিচারকগণ ….কিন্তু ওমা সব উধাও। সকল জন তাঁর খাদ্য যোগান দিতে থরহরি কম্পমান হয়ে উঠলেন। রান্না করার বড় বড় পাত্রগুলি খাবার ভর্তি করে এনে তাঁর সম্মুখে বসানো হল। গনেশ তাও শূন্য করে খেয়ে ফেললেন। এদিকে অথিতি অভ্যাগতদের কেউ তখনো খায়নি। এমনি করে সব রান্না করা খাবার শেষ হয়ে গেল।
বাকিরা কি খাবেন সেই ভাবনায় পড়ে গেলেন কুবের।গণেশের তখন প্রচন্ড ক্ষুধা। তিনি রূঢ় স্বরে বললেন, ” কুবের , আমার ক্ষুধা এখনো একটুও মেটেনি। তুমি আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনে অপমান করছ। আমাকে আমার পরিমিত খাদ্যটুকু তোমার দেবার ক্ষমতা নেই।” এই বলে গনেশ কুবের উৎসবের জন্য যে ভাঁড়ার বানিয়েছিলেন সেই ভাঁড়ারও উজাড় করে খেয়ে নিলেন। তারপর আরো আরো খাবার চাইলেন। কুবের গৃহে তখন একটি ধান্য কণাও আর অবশিষ্ট নেই। লজ্জায় নতমস্তক কুবের তাঁর প্রতিবেশী যক্ষদের নিকট সাহায্য চাইলেন। প্রতিবেশীরাও তাঁদের সকল খাদ্য এনে দিলেন কিন্তু গনেশ শান্ত হলেন না।
এবার গনেশ কুবের গৃহের সকল থালা বাটি তৈজসপত্রাদি খেয়ে ফেলতে লাগলেন। কুবের প্রমাদ গুনলেন। কুবেরের যত সোনা সম্পদাদি ছিল গনেশ তাও খেতে লাগলেন। তারপর গণেশ কুবেরকে ভর্সনাৎ করে বললেন, ” আমার মাতার নিকট তুমি অহংকার করে বলেছিলে ওইটুকু ছোট্ট গণেশ কতটুকু আর খেতে পারে ? এখন এই ছোট্ট গণেশের পেট ভরাতে হিমশিম খাচ্ছে? বল এখন আমি কি খাব? অহংকারে অন্ধ হয়ে তুমি মিথ্যা কথা বলেছ। আমার মাতা-পিতাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলে পর্যাপ্ত খাবার থাকবে। কিন্তু আমার পেটভরা খাবার ও তুমি যোগান দিতে পারলে না ।পেটে খিদে নিয়ে আমাকে চলে যেতে হবে। আমি ক্ষুদা সহ্য করতে পারি না । এবার আমি তোমায় খাব।”
এই বলে গনেশ রুদ্র রূপে কুবেরকে গ্রাস করতে ছুটলেন । কুবের ভয়ে শিবে নিকট ছুটলেন। মহাদেব মহাদেবী সকল বিষয় অবগত ছিলেন। তাঁদের যুগলকে একসঙ্গে পেয়ে পায়ে পড়ে কুবের কেঁদে উঠলেন, ” প্রাহিমাং প্রভু , প্রাহিমাং… আমার অহংকার আমার অপরাধ প্রভু। গনেশ সব খাদ্য , সম্পদ গ্রাস করে এখন ক্ষুন্নিবৃত্তির নিমিত্ত আমাকে গ্রাস করতে আসছে। আমাকে রক্ষা করুন ।”
কুবেরের কথা শুনে মহাদেব হাঁসলেন।
কুবের বললেন , ” আপনি হাঁসছেন ? থালা , বাটি তৈজস সব খেয়ে ফেলেছেন। ভান্ড ভান্ড খাদ্য গণেশের নিকট নস্য। সে আমার নিমন্ত্রিত অথিতি। তাকে অর্ধভোজন করার জন্য আমি যারপরনাই লজ্জিত। কিন্তু আপনারা আমাকে দয়া করুন।”
মহাদেব শান্ত কন্ঠে বললেন , ” কুবের তুমি প্রচুর ঐশ্বর্যের অধিপতি। কিন্তু তার জন্য তো তোমার অহংকার করার কিছু নেই। আজ দেখ তোমার সব আছে তাও তুমি কত অসহায় । তুমি যাকে ছোট্ট ভেবেছিলে সে আদপে বিশাল, অন্তত। সে আমার ও দেবীর গণ। সে অযোনি সম্ভব। সে সেই অর্থে সুবিশাল নিরাকার , সর্বব্যাপী। তার ক্ষুদা অহং দিয়ে মেটানো সম্ভব ? তুমি তোমার ভুল বুঝেছ এই যথেষ্ট। যাও গনেশকে অহং, লোভ , ঘৃণা, হিংসা , কুচিন্তা, কাম, ক্রোধ ইত্যাদি সকল ষড়রিপুর দোষকে পরিত্যাগ করে শুদ্ধ মনে , নিজ মুখে দোষ স্বীকার করে সামান্য শাকান্ন প্রদান করো। তাতেই গণেশের ক্ষুধা পরিতৃপ্তি হবে।”
দ্বিচতুর্দশবর্ণভূষিতাঙ্গ, শশিসূর্য্যাগ্নি বিলোচন সুরেশম্।
অহিভূষিতকন্ঠমক্ষসূত্রম, প্রময়েত্তং হৃদয়ে গণেশম্।।
গৃহে ফিরে কুবের দেখলেন গণেশ ক্ষুধার জ্বালায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করে রয়েছেন। কুবের তখন মনের সকল দোষ ত্যাগ করে , শুদ্ধ মনে কদলী পত্রে সামান্য অন্ন ও শাক সবজি গণেশের সম্মুখে নিবেদন করলেন। বললেন, ” আমার সকল অহং করে তুমি মার্জনা ও নাশ করো। আমি তোমার মহত্ত্ব , বিশালত্বকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমাকে ক্ষমা করো। এই শাকান্নটুকু গ্রহণ করো। এর অধিক আমার এখন আর কোনো ক্ষমতা নেই। ”
গণেশ শান্ত হলেন। প্রসন্ন চিত্তে খাদ্যবস্তু গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত হলেন । পুনরায় তুষার পর্বতে মাতার নিকট ফিরে গেলেন।
তাই যেকোনো পূজা , যেকোনো আরাধনা ভাবের আরাধনা।নিজের অন্তরকে শুদ্ধ করে ঈশ্বরকে ডাকলে আড়ম্বর লাগে না, তিনি এমনি এসে ভক্তকে ধরা দেন।
একদন্তং মহাকায়ং লম্বোদর গজাননম।
বিঘ্নবিনাশকং দেবং হেরম্বং পনমাম্যহম।।
অর্থাৎ,যিনি একদন্ত, মহাকায়, লম্বোদর, গজানন এবং বিঘ্ননাশকারী সেই হেরম্বদেবকে আমি প্রণাম করি।
©দুর্গেশনন্দিনী