গত ১৪ ই আগষ্ট সকাল সাড়ে ন’টায় শ্রীরামকৃষ্ণলোকে যাত্রা করলেন স্বামী অমেয়াত্মানন্দ। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অগণিত ছাত্র ও ভক্তমণ্ডলী তাঁকে ‘সুরেন মহারাজ‘ বলেই চেনেন। তিনি রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক এবং বাংলাদেশের দিনাজপুর রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশনের অধ্যক্ষ। বেশ কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা ও সম্পাদক। প্রয়াণকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।
রহড়া বালকাশ্রমে উদ্যান রচনার নানা কাজে, নানা সমস্যা হলে নানান সন্ন্যাসীর কাছ থেকে নিয়মিত ডাক পেতাম, এখনও পাই। কারণ রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের অনাথ আশ্রমে প্রতিপালিত হয়েছিলাম। ফলে তাঁরা আমাকে ঘরের ছেলে বলেই মনে করেন। যতদিন খড়দায় থাকতাম, যাতায়াত বেশি ছিল। তবে এখনও যোগাযোগ অটুট আছে। আর এইভাবেই ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম সুরেন মহারাজের সঙ্গে। রহড়া বালকাশ্রম ছাত্রাবাসের একটি ছাদে নির্মাণ করা তাঁর মালঞ্চের অসাধারণ সৌকর্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না! সবসময় হাসিমুখ, চট করে সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন, কোনোরকম দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ-মা সারদা-স্বামীজি এই ‘ত্রয়ী’-র উপর অমোচ্য অন্তহীন নির্ভরতা ছিল তাঁর। গাছের বৈচিত্র্যে, ফুলে-পল্লবে তিনি সর্বত্র রামকৃষ্ণময় দেখতেন। বলতেন শহরের ছাদগুলি কেন অপুষ্পক থাকবে?
২০১১ সালে এক মাসের জন্য কেরালায় যেতে হয়েছিল আমাকে। সেখানে নানান আশ্রম থেকে তাঁর অনুরোধে এনে দিয়েছিলাম নানান শ্রীময়ী উদ্ভিদ, এক এক জায়গার তীর্থ-শ্যামলের ছোঁয়া। পরম যত্নে তিনি তা প্রতিপালন করে ফুল ফুটিয়েছিলেন। তার ছবি পাঠাতেন নানান সময়। সেসব আর আমার কাছে আজ সংরক্ষিত নেই। তিনি ছাদ-বাগানে তৈরি ফুলের চারা নানান ভক্তকে স্নেহ-উপহার হিসাবে দিতেন, যত্ন করে ফুল ফোটাতে বলতেন। আর দিতেন তাঁর লেখা ও সম্পাদিত বই। বলতেন, উদ্যান রচনা আর গ্রন্থরচনা যেন তাঁর কাছ আলাদা নয়। গাছের প্রাণস্পন্দনে ঠাকুরের অন্তহীন লীলা কীর্তন শুনতেন। শহরে নগরে যখন মানুষ লোহা, ইঁট, পাথরে হাঁসফাঁস করছেন, তখন তার বিপ্রতীপে তাঁর সুপারিশ ছিল, ছাদে বা বারান্দায় সীমিত আয়োজনে টবে গাছ লাগিয়ে আনন্দযজ্ঞে ঐশীকাজে সামিল হওয়া। বলতেন, রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয় চত্বরে যদি পর্যাপ্ত জায়গা থাকতো তবে উদ্যান রচনা করাতাম ছাত্রদের দিয়ে, চেনাতাম ঠাকুর-মা-স্বামীজির পছন্দের গাছ ও ফুলগুলি। আমাকে বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের এক একটি শাখাকেন্দ্রের কুসুমোদ্যান বিষয়ে যেন ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করি।
জবাগাছের প্রতি তাঁর অনন্য আকর্ষণ ছিল, কত যে বৈচিত্র্যের ফুল তিনি ফুটিয়েছিলেন আর বাগানবিলাসীদের ফোটাতে সহায়তা করেছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। অনেক ভক্তের বাড়িতে গিয়ে তার বাগানটি আগে দেখতে চাইতেন। কিছু পরামর্শও দিতেন। খুব যত্ন করে লাগাতেন নানান অর্কিড, টিউলিপ আর নানান পাতাবাহার। ২০১৪ সালে তিনি যখন দিনাজপুর আশ্রমের অধ্যক্ষ হয়ে চলে যান, তারপরেও তিনি দূরভাষে আমাকে নতুন কর্মক্ষেত্রের বাগান নিয়ে কত কথাই না বলতেন, সেসব ছবির মতো দেখতে পেতাম। দিনাজপুরে যাবার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। আমার পাসপোর্ট আছে কিনা, জানতে চেয়েছিলেন। তিনি বহু ভক্তমণ্ডলীর সন্তানকে কৃষি, গ্রামোন্নয়ন নিয়ে পড়াশোনা করার পরামর্শ দিতেন এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন। বলতেন গ্রাম বিকাশ না হলে সমৃদ্ধশালী ভারতরাষ্ট্র গড়া হবে কী করে! এখনও তাঁর সামীপ্যে সান্নিধ্যে আসা ছাত্রদের কারও কারও সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ আছে।
আমি রহড়া মিশন থেকে উত্তীর্ণ হবার পর তিনি রহড়ায় আসেন, ফলে সরাসরি শিক্ষক বা অভিভাবক হিসাবে তাঁকে পাইনি। ১৯৮৯ সালে বেলুড়ের ব্রহ্মচারী ট্রেনিং সেন্টার থেকে তিনি রহড়ায় আসলেন। তার আগে তিনি মেদিনীপুর রামকৃষ্ণ মিশনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন আর কলকাতার ভক্তমণ্ডলীর কাছ থেকে আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করে মেদিনীপুরে নিয়ে যেতেন। তারও পূর্বে তিনি কয়েক মাসের জন্য পুরী আশ্রমে কাজ করেছিলেন। তাঁর পূর্বাশ্রম ছিল ময়না ব্লকের বলাইকোণ্ডা হাটের কাছে দোনাচক গ্রাম। পূর্বাশ্রমের নাম সুরেন্দ্র নাথ মাইতি।
মেদিনীপুর কলেজ থেকে তিনি সংস্কৃতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।
তিনি শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজীর কাছে মন্ত্রদীক্ষা পান। ১৯৭৮ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর তিনি মেদিনীপুর আশ্রমে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালের শ্রীরামকৃষ্ণের তিথিপুজো পর্যন্ত ওই আশ্রমে কাজ করেছেন। তারপর বেলুড়ের ব্রহ্মচারী ট্রেনিং সেন্টারে আসেন। ব্রহ্মচর্যে তাঁর নাম হয় ‘ব্রহ্মচারী উমেশ চৈতন্য’। তিনি রহড়ায় যখন যোগদান করেন, তখনও ব্রহ্মচারী। প্রথমে দায়িত্ব নিলেন ছাত্রাবাসের অভিভাবক হিসাবে। পরে সম্ভবত ১৯৯৫ সাল থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পেলেন। তিনি সন্ন্যাস লাভ করে শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজের কাছ থেকে। প্রায় দেড় দশক তিনি প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব কৃতিত্বের সঙ্গে সামলেছেন। তাঁর সময়েই উচ্চ বিদ্যালয় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। সুশর্মা মহারাজ, সুবল মহারাজের পরে তিনি গত শতকে নয়ের দশকে আশ্রমের ‘বড়বাড়ি’ অর্থাৎ শিবানন্দ-ব্রহ্মানন্দ ধামের উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের অভিভাবক-সন্ন্যাসী হিসাবে দায়িত্ব নিলেন এবং মুন্সীয়ানার সঙ্গে কাজ করলেন। প্রাক্তন ছাত্র শ্রী সঞ্জয় ঢালী জানাচ্ছেন, “যতক্ষণ কেউ অভিযোগ বা নালিশ না করতো, ছাত্রদের ছোটোখাটো অপরাধকে তিনি আমল দিতেন না। কিন্তু অভিযোগ এলে তা যথেষ্ট তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তি দিতেন। ফলে ছাত্রেরা ভয়ের পরিবেশে অকারণে আঁটোসাঁটো হয়ে থাকতো না, একটা আনন্দধারা অথচ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অপরাধের মাত্রা এবং গভীরতা তিনি বুঝতেন, আর তা থেকে ছাত্রদের সংশোধন মূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।”
তিনি নানান সময়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন। সম্পূর্ণ তালিকা এই মুহূর্তে পরিবেশন করতে না পরলেও বাংলাদেশের দিনাজপুরে গিয়ে যে কয়েকটি গ্রন্থে অবদান রেখেছিলেন তার নাম উল্লেখ করছি। যদিও তার আগেও তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। ২০১৯ সালের ২৪ শে আগষ্ট তাঁর সম্পাদনায় রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশন, দিনাজপুর, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী সপ্তশতী প্রসঙ্গ ও শ্রীমদভগবদগীতা প্রসঙ্গ‘। বইটি স্বামী অমৃতত্বানন্দজীর লেখা, তাঁর সম্পাদনায় উজ্জ্বল-ভাস্বর হয়ে ওঠে বইটি। ২০১৭ সালের ৯ ই জুলাই গুরুপূর্ণিমার দিন দিনাজপুর থেকেই প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘অর্ঘশ্রী’। ২০১৬ সালের ২৫ শে আগষ্ট জন্মাষ্টমীর দিন প্রকাশ করেন ‘শক্তি আরাধনা’ নামে গ্রন্থ। ‘শক্তি আরাধনা’-য় দুর্গাপূজা ও তার মন্ত্রতন্ত্র নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ‘অর্ঘশ্রী’ গ্রন্থে রয়েছে গুরুপূর্ণিমা ও জন্মাষ্টমীর তাৎপর্য বিষয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা, রয়েছে মায়াশক্তি বিষয়ে তাঁর বিচারবোধ। প্রতিটি বই ভক্তমহলে বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে। তিনি নানান সময়ে দুর্গাপূজা ও কালীপূজার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গিয়ে শক্তি আরাধনা কেন বাঙালিকে করতে হবে তার বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করতেন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে দিনাজপুরে থাকাকালীন তিনি প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন। রক্তে উচ্চমাত্রায় শর্করা এবং রক্তের উচ্চচাপ জনিত সমস্যা ছিল। আকস্মিক স্ট্রোকে তাঁর শরীরের একটি অংশ অবশ হয়ে যায়। আশ্রম কর্তৃপক্ষ দিনাজপুর থেকে ঢাকায় পাঠায়, পরে ঢাকা থেকে দমদম হয়ে রামকৃষ্ণ সেবাপ্রতিষ্ঠান হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০১৮ সালে তিনি চোখের অপারেশন করার জন্য ভারতে এসেছিলেন। তখনই চিকিৎসকেরা তার রোগজনিত সমস্যার কথা তুলে ধরেন। বহু চিকিৎসার পর তাঁর চোখের অপারেশন করা সম্ভব হয়। কিন্তু সেবারের মতো দিনাজপুরে ফিরে গেলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা হয়তো জারি রাখা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতুলতা হয়তো ছিল। তাঁকেও নানান পাঠচক্রে বক্তৃতার জন্য নিয়মিত কাছে-দূরে যেতে হত। অনেকসময় সেখানে তাঁর অনিয়ম হত। শেষ পর্যায়ে তিনি বেলুড়ের আরোগ্য ভবনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। তাঁর স্নেহ সান্নিধ্য লাভের মধ্যে সবুজ কথা আমার সবচাইতে বড় পাওনা। আগামী দিনে তার নানান ধারা আমার মানসচর্চার মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে পারলে উনি খুশি হবেন। তাঁর আত্মা শ্রীরামকৃষ্ণ পাদপদ্মে বিলীন হোক; সুরেন মহারাজের জীবনের-সুর তাতে মিলুক এই প্রার্থনা জানাই।
(প্রস্তুত নিবন্ধ রচনার জন্য কলকাতার বেলগাছিয়া নিবাসী শ্রী দিলীপ কুমার মণ্ডল, বারাসাতের শ্রী প্রদীপ্ত কবিরাজ এবং রহড়ার শ্রী সঞ্জয় ঢালির কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। (Dr. Kalyan Chakraborty)