ইরান যুদ্ধ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কেন দু’সপ্তাহ সময় নিলেন ট্রাম্প? আলোচনায় ৫ কারণ! আসরে রাশিয়া, চিন, ইইউ

ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা অস্ত্র ধরবে কি না, দু’সপ্তাহের মধ্যে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইজ়রায়েল যখন প্রবল ভাবে চাইছে, আমেরিকা এখনই যুদ্ধে নামুক, তখন কেন ট্রাম্প ১৪ দিন সময় নিলেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। উঠে এসেছে পাঁচ কারণও। এই পরিস্থিতিতে ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধ নিয়ে ফের বার্তা দিল রাশিয়া। জল্পনা তৈরি হয়েছে ইরানের আকাশে চিনা বিমান এবং জেনেভায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইরানের বৈঠক ঘিরেও।

বৃহস্পতিবার ট্রাম্পকে উদ্ধৃত করে হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট বলেন, “বাস্তব এই যে, অদূর ভবিষ্যতে (ইরানের সঙ্গে) বোঝাপড়ায় আসার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আমি সেই পথে হাঁটব কি না, সেই বিষয়ে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেব।” হোয়াইট হাউস এ-ও জানিয়েছে, ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসার পথ এখনই বন্ধ করে দিতে চান না ট্রাম্প। তবে তেহরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিতে যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সায় নেই, তা আরও এক বার স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

অনেকের মত, ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার পথ খোলা রাখতেই খানিক সময় নিলেন ট্রাম্প। দু’সপ্তাহের কথা বলে আসলে তিনি ইরানকে বার্তা দিতে চাইলেন যে, এখনও তারা চাইলে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন সে রকমই ইঙ্গিত দিয়েছে। বলা হয়েছে, “প্রেসিডেন্ট কূটনৈতিক সমাধানই চান। তিনি শান্তিপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেরা একজন। যদি কূটনৈতিক সমাধানের কোনও পথ থাকে, অবশ্যই প্রেসিডেন্ট সেই পথ ধরে হাঁটবেন।”

শুধু কূটনীতিই নয়, দু’সপ্তাহের মধ্যে ট্রাম্প নিজেও কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাইছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। তাঁদের মত, যদি ইরানের সঙ্গে শেষমেশ আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্বের অবসান না হয়, যদি শেষমেশ আমেরিকাকে যুদ্ধে যোগ দিতেই হয়, সে ক্ষেত্রে আগে থেকে কিছু প্রস্তুতি সেরে রাখা প্রয়োজন। আমেরিকা ইরানে হামলা চালালে, তেহরানও যে পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালাবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত। ইরানও সেই হুমকি দিয়ে রেখেছে। ফলে হাতে সময় নিয়েই রণনীতি তৈরি করতে চাইছেন ট্রাম্প। যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যতটা সম্ভব কমানো যায়।

তৃতীয় কারণ হিসাবে কেউ কেউ আবার ইজ়রায়েলের আগ্রাসী মনোভাবের কথাও বলছেন। তাঁদের মত, আমেরিকা খুব ভাল করে জানে, ইজ়রায়েলের একার পক্ষে এই যুদ্ধ বেশি দিন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। টেনেটুনে বড়জোর দু’সপ্তাহ ‘আগ্রাসন’ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তেল আভিভের। তারা চাইবে, তার মধ্যেই আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে। তার জন্য লাগাতার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলবে। ইজ়রায়েল যদি তাদের লক্ষ্যপূরণে সফল হয়, তা হলে তো মিটেই গেল। যদি না-ও হয়, সে ক্ষেত্রে ইজ়রায়েলের মুহুর্মুহু হামলায় ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়বে। পরে আমেরিকা মাঠে নামলে তাদের সুবিধাই হবে। তেহরানের পক্ষে তখন আমেরিকার হামলা সামলানো সম্ভব হবে না।

ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধে আমেরিকার ‘নাক গলানো’ নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে নানা কথা উঠতে শুরু করেছে। রাশিয়াও ওয়াশিংটনকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছে। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প আরও কিছুটা জল মাপতে চাইছেন বলেও অনেকে মনে করছেন। তবে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের দাবি, ট্রাম্প আসলে দু’সপ্তাহের কথা বলে ইরানের সঙ্গে ছলনাই করলেন। ওই অংশের দাবি, এত দিন ইরান ভেবে রেখেছিল, আমেরিকা যে কোনও মুহূর্তে যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। সেইমতো ইরানও প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু ট্রাম্প হাতে সময় নেওয়ায় ইরান এখন আমেরিকার কথা না ভেবে পুরোপুরি ইজ়রায়েলের দিকে নজর দেবে। তার মধ্যে আমেরিকা যদি আচমকা ইরানের উপর হামলা চালায়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট মোটেই বলেননি যে, তিনি দু’সপ্তাহ পর সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি দু’সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন।

আবার মার্কিন প্রশাসনের একাংশের দাবি, ‘দু’সপ্তাহ’ লব্জটির ব্যবহার ট্রাম্প হামেশাই করে থাকেন। মাস দুয়েক আগে ট্রাম্পকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। সেই সময়েও তিনি দু’সপ্তাহের কথা বলেছিলেন। সাংবাদিকদের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘‘দু’সপ্তাহের মধ্যে জানাব।’’ নির্বাচনী প্রচারের সময়েও আমেরিকার নতুন কর কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল ট্রাম্পকে। সে সময়েও দু’সপ্তাহের কথা বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হোয়াইট হাউসের এক আধিকারিক একটি মার্কিন সংবাদপত্রকে বলেছেন, ‘‘দু’সপ্তাহ শব্দবন্ধ উনি প্রায়ই ব্যবহার করে থাকেন!’’

ইরানে চিনা বিমান

একটি-দু’টি নয়, পাঁচ পাঁচটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান চিন থেকে উড়ে গিয়েছে ইরানের দিকে। বিশ্বে বিমান চলাচলের উপর নজরদারি চালানো সংস্থা ‘ফ্লাইটরেডার২৪’-কে উদ্ধৃত করে এমনটাই জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘ফক্স নিউজ়’। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিমানগুলি উত্তর চিন থেকে উড়ে কাজ়াখস্তানের দিকে যায়। তার পর দক্ষিণে বাঁক নিয়ে উজ়বেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান পৌঁছোয়। রেডার-তথ্য বলছে, সেই সময় বিমানগুলির অভিমুখ ছিল ইরানের দিকে। তার পর অবশ্য রেডারে সেগুলির গতিবিধি ধরা পড়েনি। প্রতিবেদনে একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, চিনের ওই বোয়িং বিমানগুলি আদতে লুক্সেমবার্গ যাচ্ছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিমানগুলিকে ইউরোপের আকাশসীমায় দেখতে পাওয়ার কথা। তেমনটা ঘটেনি বলে জানিয়েছে ‘ফক্স নিউজ়’। আর এখানেই ঘনীভূত হয়েছে রহস্য। ভূরাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, বিমানগুলি ইরানে পাঠিয়ে আদতে তেহরানের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছে বেজিং। যদিও প্রকাশ্যে এই বিষয়ে মুখ খোলেনি চিন কিংবা উড়ান সংস্থা। বিমানগুলি ইরানেই রয়েছে, না কি কিছু সময়ের জন্য অবতরণ করে অন্যত্র উড়ে গিয়েছে, তা-ও এখনও স্পষ্ট নয়। প্রসঙ্গত, বরাবরই বেজিংয়ের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক বেশ মসৃণ। তা ছাড়া চিন তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে যে গ্যাস এবং তেল আমদানি করে, তার ৪৩ শতাংশ আসে পশ্চিম এশিয়া, মূলত ইরান থেকে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ইরান বেজিংয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অন্য দিকে, শুল্কযুদ্ধের আবহে ওয়াশিংটন-বেজিং দূরত্ব আরও একটু বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে সংঘাতে চিন তলে তলে ‘বন্ধু’ ইরানকে সাহায্য করছে কি না, তা নিয়ে এখন জোর গুঞ্জন শুরু হয়েছে।

ইরানে নতুন গোয়েন্দাপ্রধান

ইরানের নতুন গোয়েন্দাপ্রধান হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাজিদ খাদেমি। গত ১৫ জুন ইজ়রায়েলি হামলায় মৃত্যু হয়েছিল সে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মহম্মদ কাজ়েমির। সেই হামলাতেই মারা যান ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর-এর (আইআরজিসি) প্রধান (চিফ অফ স্টাফ) মেজর জেনারেল মহম্মদ হোসেন বাগেরি, প্রধান কমান্ডার জেনারেল হোসেন সালামি এবং ডেপুটি কমান্ডার জেনারেল গোলাম আলি রশিদ। ইরান ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের গোয়েন্দা সুরক্ষা সংস্থার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন মাজিদ। এর আগে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তথ্য সুরক্ষা দফতরেরও দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ওই দফতরের প্রধান ছিলেন মাজিদ। জাতীয় নিরাপত্তায় তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। এ বার তাঁর হাতেই দেশের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হল।

নেতানিয়াহুর হুমকি

আমেরিকা পাশে থাক বা না-থাক, ইজ়রায়েল তা নিয়ে ভাবিত নয়। তাদের লক্ষ্য ইরানের সমস্ত পরমাণুঘাঁটি ধ্বংস করে দেওয়া। এমনটাই জানালেন ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। বৃহস্পতিবার রাতে (স্থানীয় সময়) হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছে, ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা অস্ত্র ধরবে কি না, তা নিয়ে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাম্প। তার মাঝেই নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, ইরানের পরমাণুঘাঁটিগুলি ধ্বংসের লক্ষ্যে মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হচ্ছে। এই কাজের জন্য অন্য কোনও দেশের ‘সবুজ সঙ্কেত’ তাঁদের প্রয়োজন নেই। এ বিষয়ে ইজ়রায়েলই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। কারও অনুমতি নেওয়া হবে না।

ইঙ্গিত রাশিয়ার

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেইকে সরিয়ে (হত্যা করে) জমানা বদলের কথা বলেছে ইজ়রায়েল। সরাসরি জমানা বদলের কথা না-বললেও খামেনেইয়ের গোপন ডেরার কথা আমেরিকা জানে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই আবহে রাশিয়া জানিয়ে দিল, ইরানে জমানা বদলের বিষয়ে সায় নেই তাদের। শুক্রবার ‘স্কাই নিউজ়’-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, “ইরানে জমানা পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা অকল্পনীয়। এটা নিয়ে কথা বলাও সমর্থনযোগ্য নয়।” খামেনেইকে হত্যা করলে ইরানে চরমপন্থা বাড়তে পারে বলেও সতর্ক করেছেন পেসকভ। বৃহস্পতিবারই আমেরিকাকে সতর্ক করে রাশিয়া জানিয়েছিল, ইরানে হামলা চালালে তার পরিণাম ভয়ঙ্কর হবে। সে দেশের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জ়াখারোভা বলেন, ‘‘ওই ধরনের পদক্ষেপ করলে পুরো পরিস্থিতিই ঘেঁটে যেতে পারে।’’ তাতে পরমাণু বিপর্যয় ঘটতে পারে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করে মস্কো। শুক্রবারও ইরানে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে আমেরিকাকে সতর্ক করেন রুশ মুখপাত্র পেসকভ। তবে ইরানে হামলা চালানো হলে রাশিয়া তার জবাব দেবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.