‘হু এলস’! ইংল্যান্ডের ত্রাতা সেই জুড, মনে করালেন শ্যাম থাপাকে, হতে পারে শাস্তিও

‘হু এলস বাট জুড’! জুড ছাড়া আর কে!

গত এক বছরে কত বার যে জুড বেলিংহ্যামকে নিয়ে এই কথা লেখা হয়েছে তার হিসাব নেই। সংবাদের শিরোনাম, ধারাভাষ্যকারদের উচ্ছ্বাস, সমর্থকদের চিৎকার— সব জায়গায় একটাই কথা। ইংরেজরা সমর্থকেরা মজা করে বলে থাকেন, যখন ঈশ্বর কারও সঙ্গ দেন না, তখন বুঝতে হবে তিনি বেলিংহ্যামের পাশে রয়েছেন। রবিবারও তিনি হয়তো ছিলেন ইংরেজ ফুটবলারের পাশেই। অবশ্য শেষ মুহূর্তে গোল করে বেলিংহ্যাম যে উৎসবটি করলেন, তার জন্য শাস্তি হতে পারে তাঁর।

ফুটবল জীবনের শুরু থেকে এ ভাবেই বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছেন বেলিংহ্যাম। অতীতে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের কোনও ম্যাচে ৯০ মিনিট পূরণ হয়ে গেলে বলা হত, ‘ফার্গি টাইম’ শুরু হয়েছে। তৎকালীন ম্যান ইউ কোচ অ্যালেক্স ফার্গুসনের দল ৯০ মিনিটের পর গোল করা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল।

২০১৪ সালের পর থেকে ‘ফার্গি টাইম’ বদলে গেল ‘রামোস টাইম’-এ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের সের্খিয়ো রামোস ৯৩ মিনিটে সমতা ফেরানোর পর থেকে এই নাম। এখন ৯০ মিনিটের পর শুরু হয়েছে ‘বেলিংহ্যাম টাইম’।

রবিবার স্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের ম্যাচের ৯৪ মিনিটের খেলা চলছে তখন। গেলশেনকার্চেনের আউফশালকে অ্যারেনা ছেড়ে অনেক ইংরেজ সমর্থকই মাঠের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছেন। হঠাৎই প্রবল চিৎকার। অনেকে সোৎসাহে পিছনের দিকে ছোটা শুরু করলেন। অনেকে দাঁড়িয়েই কাঁদতে শুরু করলেন। বুঝতে পারেননি এই ম্যাচেই ‘বেলিংহ্যাম টাইম’ চলে আসবে।

ইংল্যান্ডের কোচ গ্যারেথ সাউথগেট ম্যাচের পরে স্বীকার করেছেন, একটা সময় বেলিংহ্যামকে তুলে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। স্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে এতটাই খারাপ খেলছিলেন তিনি। না পারছিলেন বল ধরতে বা কাড়তে, না পারছিলেন নিয়ন্ত্রণ করতে, না পারছিলেন ভাল কোনও মুভ তৈরি করতে। কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছিল না। যে সমর্থকেরা চোখের মণি করে লেখেছিলেন এত দিন, তাঁরাই গ্যালারি থেকে ব্যাঙ্গাত্মক শিস দিতে থাকেন।

কাইল ওয়াকারের লম্বা থ্রো থেকে মার্কে গেহির ব্যাক হেড যখন তাঁর দিকে ভেসে আসছিল, খুব বেশি ভাবনাচিন্তা করার সময় ছিল না বেলিংহ্যামের কাছে। বাতাসে বাঁ হাতটা ভর দিয়ে শূন্যে ভাসতে অবস্থায় শরীরটা কোনও মতে মুচড়ে ডান পা-টা চালিয়ে দিয়েছিলেন। স্লোভাকিয়া গোলকিপার জিয়োর্জি মামারদাশভিলিকে দাঁড় করিয়ে বল জালে জড়িয়ে গিয়েছিল। বেলিংহ্যাম ধন্যবাদ জানাতে পারেন স্লোভাকিয়ার ডেনিস ভাভরোকে, যিনি বেলিংহ্যামের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও শট নেওয়া আটকাতে কোনও চেষ্টাই করেননি।

বেলিংহ্যামের কাছে এ সব নতুন নয়। ছোটবেলার ক্লাব বার্মিংহাম সিটির হয়ে খেলার সময় অভিষেক ম্যাচে তাঁর গোলেই সমতা ফিরিয়েছিল ক্লাব। সেই মরসুমে তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। বেলিংহ্যাম সে সব পাত্তা না দিয়ে চলে যান জার্মানিতে। ডর্টমুন্ডের হয়ে বেলিংহ্যামের প্রথম ঝলক দেখা যায় ২০২২-এর জানুয়ারিতে। ফ্রাঙ্কফুর্টের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ৮৭ মিনিট পর্যন্ত পিছিয়ে ছিল ডর্টমুন্ড। তার পরেই হেডে বেলিংহ্যামের গোল। শেষ দিকে মাহমুদ দাহুদের গোলে জয়।

গত সেপ্টেম্বরে গেটাফের মতো তুলনামূলক ছোট দলের বিরুদ্ধে সংযুক্তি সময়ে কিছুতেই গোল করতে পারছিল না রিয়াল মাদ্রিদ। ৯০ মিনিট পেরোতেই ত্রাতা সেই বেলিংহ্যাম। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রথম ম্যাচে ইউনিয়ন বার্লিনের বিরুদ্ধে আর একটু হলেই আটকে গিয়েছিল মাদ্রিদ। সেই বেলিংহ্যামের গোলেই জয় পায় তারা। এর পর বার্সেলোনার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষাতে সেই ৯০ মিনিটের পরে গোল করে ‘এল ক্লাসিকো’র রাজা হয়ে যাওয়া।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম থেকে সমর্থকেরা প্রতিটি দলের মধ্যেই একজন তারকাকে খুঁজে পান। তাঁকে নিয়ে হইচই হয় সবচেয়ে বেশি। যুগে যুগে ডেভিড বেকহ্যাম, মাইকেল ওয়েন, অ্যালান শিয়েরারদের নিয়ে উন্মাদনা হয়েছে। ইংরেজ জনতা কিছু দিন আগে পর্যন্তও মুগ্ধ ছিল হ্যারি কেনকে নিয়ে। সেই জনপ্রিয়তায় ভাগ বসিয়েছেন বেলিংহ্যাম।

রবিবারের গোল নিয়ে অনেকেই দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বলছেন এটি বাইসাইকেল কিক। কেউ বলছেন, মোটেই নয়। এটি সাইডভলি। অনেকটা গত বিশ্বকাপে ব্রাজিলের রিচার্লিসনের গোলের মতো। তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে তিনি গোলটি করেছেন, যে ভাবে চাপের মধ্যে মাথা ঠান্ডা রেখেছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

অতীতে কলকাতা ময়দানে এমন গোল করেছিলেন শ্যাম থাপা। ১৯৭৮ সালে কলকাতা লিগে মোহনবাগানের হয়ে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন তিনি। অনেকের চোখে এখনও ভাসে সেই গোল। গত বছর একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “বর্ষার সময়ে আমি বেশি করে বাইসাইকেল কিক অনুশীলন করতাম। তাতে মাটিতে পড়লেও আঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকত না। না হলে মাটিতে সজোরে আছাড়া খেয়ে চোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাইসাইকেল কিক মারতে গেলে রিফ্লেক্সের দরকার হয়। তাই জন্য আমি প্রচুর স্প্রিন্ট করতাম।”শ্

শ্যাম থাপার সেই গোল।

তবে স্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে গোল নায়কের পাশাপাশি খলনায়কও বানিয়ে দিয়েছে বেলিংহ্যামকে। গোলের পরেই সাজঘরের দিকে তাকিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি। সেই অপরাধে শাস্তি পেতে পারেন ইংরেজ ফুটবলার। উয়েফা ঘটনার ভিডিয়োটি খতিয়ে দেখছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে সুইৎজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে পারবেন না বেলিংহ্যাম। যদিও সেই আচরণের ব্যাখ্যা পরে দিয়েছেন ইংরেজ ফুটবলার। জানিয়েছেন, খুব কাছের কিছু সতীর্থকে ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছিলেন। স্লোভাকিয়াকে অপমান করার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তাদের ফুটবলকে সমীহ করছেন তিনি।

গোল করার পর উচ্ছ্বাস করতে গিয়ে মাত্র দু’টি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন বেলিংহ্যাম।

‘হু এলস’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.