সঞ্জয়ের কী শাস্তি হওয়া উচিত? যাবজ্জীবন না ফাঁসি? কী চান আমরণ অনশনকারী ১০ ডাক্তার?

আরজি করে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করে শিয়ালদহ আদালত। সোমবার তাঁর সাজা ঘোষণা করা হবে। আরজি করের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর কলকাতা তথা গোটা রাজ্যের চিকিৎসক মহল বিশেষ ভাবে আলোড়িত হয়েছিল। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে জুনিয়র ডাক্তারেরা অবস্থান বিক্ষোভ করেন। ডাক দেন কর্মবিরতির। কলকাতার ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা ‘আমরণ’ অনশনেও বসেছিলেন। টানা ১৭ দিন ধরে সেই অনশন চলে। আরজি করের ঘটনায় সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করার পর কী বলছেন সেই অনশনকারীরা? তাঁরা কি সকলেই সঞ্জয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ, মৃত্যুদণ্ড চান?

সঞ্জয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক, চাইছেন অধিকাংশই। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের কারও কারও মত এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। অপরাধ যা-ই হোক, ফাঁসির পক্ষে মত দিতে পারছেন না কেউ কেউ। আবার কেউ জানিয়ে দিচ্ছেন, সাজা নিয়ে মন্তব্য করার ‘এক্তিয়ার’ই তাঁর নেই। তবে সাজার বিষয়ে দু’-একটি ভিন্ন মত থাকলেও অনশনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা সকলে একটি বিষয়ে একমত। সঞ্জয়কেই একমাত্র দোষী বলে মানতে পারছেন না তাঁরা কেউ। সিবিআইয়ের তদন্তে তাঁরা কেউই সন্তুষ্ট নন। আরজি করের অনিকেত মাহাতো শনিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘আমরা দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। কিন্তু সেই পুরনো প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সঞ্জয় ছাড়া আর কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত? সেটা জানা দরকার।’

এক সুর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ক্যানসার বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট স্নিগ্ধা হাজরার গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনার জন্য সঞ্জয় যদি দোষী হয়, তা হলে তো অবশ্যই তাঁর ফাঁসি চাই। তদন্তে যা পাওয়া গিয়েছে, তার ভিত্তিতে আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু আদালত তো তদন্ত করে না। তদন্তের উপরে ভরসা রাখতে পারছি না। অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও পাচ্ছি না। তদন্তে আর কিছু যে পাওয়া গেল না, এতে আমরা একেবারেই খুশি নই।’’

আদালতের সিদ্ধান্তের সঙ্গেই সহমত এসএসকেএম হাসপাতালের নেফ্রো বিভাগের পিডিটি অর্ণব মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘ভারতের বিচারব্যবস্থা সঞ্জয়কে যে শাস্তিই দেবে, আমি সেটাকে স্বাগত জানাব। আদালত যদি ফাঁসির সাজা দেয়, তা-ই হোক।’’ এর পরেই অর্ণবের সংযোজন, ‘‘কিন্তু শুধু তো সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়। তদন্তে অনেক ফাঁক থেকে গিয়েছে। সঞ্জয় ধরা পড়েছে। কিন্তু যারা ধরা পড়ল না, যাদের সেই সুযোগটা করে দেওয়া হল, তাদেরও যথাযোগ্য শাস্তি হোক, আমরা সেটাই চাই।’’

নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাস্থেশিয়া বিভাগের পিজিটি পুলস্ত্য আচার্য আবার অন্য কথা বলছেন। তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পক্ষে। বলেন, ‘‘ফাঁসি দিলেই তো সব হয়ে যায় না। আমি অবশ্যই সঞ্জয়ের শাস্তি চাই। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পক্ষে।’’ এর পরেই সিবিআইয়ের তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে পুলস্ত্যের গলায় আক্ষেপ, ‘‘যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড, যা-ই হোক, আসল ঘটনা তো অন্য। তদন্তে অনেক ফাঁকফোকর থেকে গেল, সেখান থেকে অনেকে বেরিয়ে গেল। অনেকের শাস্তি হল না।’’

শিশুমঙ্গল হাসপাতালের ইএনটি বিভাগের পিজিটি পরিচয় পাণ্ডা সঞ্জয়ের শাস্তি প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘এটা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না। এটা ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উপরেই ছাড়তে হবে। কী শাস্তি হবে, তা নিয়ে মন্তব্য করার এক্তিয়ারই নেই আমার।’’

কেপিসি মেডিক্যাল কলেজের প্যাথোলজি বিভাগের পিজিটি সায়ন্তনী ঘোষ হাজরার কথায়, ‘‘সঞ্জয় যে নির্দোষ নন, আমরা সবাই জানি। ঘটনাস্থল থেকে ওঁর নমুনাও পাওয়া গিয়েছে। আমরা ওঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই চাই। কিন্তু আরও যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত, তাঁদের দিকে আলোকপাত করা হলে আমরা আরও খুশি হতাম।’’

কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি বিভাগের পিজিটি আলোলিকা ঘোড়ুই ধর্মতলায় অনশনে বসেছিলেন ১১ অক্টোবর থেকে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ৪০ ঘণ্টা ধরে টানা তিনি ডিউটিতে রয়েছেন। সোমবারের আগে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন না। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইএনটি বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট তনয়া পাঁজাও মন্তব্য করতে চাননি। প্রশ্ন শুনে ফোন কেটে দেন তিনি। আর ফোন ধরেননি। এ ছাড়া, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায় এবং অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্‌থের পভার্টি মেডিসিন বিভাগের রুমেলিকা কুমারকে একাধিক বার ফোন করা হয়েছিল। তাঁরা ফোন ধরেননি।

উল্লেখ্য, আরজি কর-কাণ্ডের বিচার চেয়ে এবং রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় পরিবর্তনের দাবিতে ৫ অক্টোবর থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ধর্মতলায় ‘আমরণ অনশন’ করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। কেউ কেউ মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়ায় অনশনমঞ্চ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে নির্যাতিতার জন্য এক সুরে বিচার চেয়েছিলেন প্রত্যেকেই। শনিবার সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত জানায়, ৯ অগস্ট ভোরের দিকে তিনিই আরজি করে ঢুকেছিলেন এবং মহিলা চিকিৎসককে আক্রমণ করেছিলেন। গলা টিপে ওই মহিলাকে খুনও করেছিলেন সঞ্জয়। তাঁর অপরাধ প্রমাণিত। তাঁকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪, ৬৬, ১০৩(১) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন বিচারক অনির্বাণ দাস। এ-ও জানিয়ে দেন, তাঁর সর্বোচ্চ ফাঁসির সাজাও হতে পারে। সোমবার বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ এজলাস বসবে শিয়ালদহ আদালতে। সঞ্জয়, তাঁর আইনজীবী এবং নির্যাতিতার পরিবারের বক্তব্য শুনবেন বিচারক। তার পর সাজা ঘোষণা করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.