বিনয় কুমার সরকার—- ‘স্বাধীনতা’ থেকে ‘স্বতন্ত্রতা’র পথপ্রদর্শক

১৯১৪ থেকে ১৯২১ এর মধ্যে প্রকাশিত হলো ‘The Positive Background of Hindu Sociology’ ; ১৯১৬ সালে লিখলেন ‘The beginning of Hindu culture as world-power’ , ১৯১৮ সালে ‘Hindu achievements in exact science a study in the history of scientific development’ ,আর ‘The Influence of India on Western Civilization in Modern Times’। আমেরিকার পত্রিকায় কৌটিল্য, মনু, শুক্র ও মহাভারতের বিশ্লেষণ করে লিখলেন Hindu theory of international relations”।
১৯২১ সালে প্রকাশিত হলো Hindu theory of States’ , বাংলায় ‘হিন্দু রাষ্ট্রের গড়ন’।
উদ্দেশ্য সভ্যতা’র গড়ে ওঠা, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন , নারীর অধিকার সমস্ত বিষয় নিয়ে ভারতের প্রতি ইউরোপীয় দৃষ্টিকোণ কে শুধরে দেওয়া —- “ইয়োরোপকে কথায় কথায় আমরা “স্বরাজে”র মুল্লুক, “স্বাধীনতা”র মুল্লক,“জাতীয়তার মুল্লক,“গণ-তন্ত্রে“র মুল্লক, “আইনে”র মুল্লুক, “ঐক্যের” মুল্লুক, “শান্তি”র মুল্লুক ইত্যাদি রূপে বিবৃত করিতে অভ্যস্ত। আসল
নিরেট সত্য গুলা কি ? প্রায় এক দম উল্টা”।
( হিন্দু রাষ্ট্রের গড়ন)
এখন ইউরোপের ‘ফেমিনিজম’ এর অনুকরণ করে ভারতেও ‘নারীবাদী’ দৃষ্টিকোণ দেখা যায়।
ইউরোপে নারীর প্রতি আচরণের যে ইতিহাস আছে সেক্ষেত্রে ‘ফেমিনিজম’ এর একটা যৌক্তিকতা আছে তা সরকার মহাশয়ের গবেষণা থেকে স্পষ্ট হয় — “নারীজাতীকে বে-ইজ্জৎ করিতে গ্রীক আইন, রোমাণ আইন এবং “খৃষ্টিয়ান” আইন সমান ওস্তাদ। ইয়োরোপীয়ান “সমাজে” নারীর ঠাঁই – কোনো দিনই সম্মান সূচক বা এমন কি “সহনীয়”ও ছিল না। কথাটা বোধ হয় বিশ্বাসযোগ্যই বিবেচিত হইবে না। জাৰ্ম্মাণ পণ্ডিত বেবেলের গ্রন্থ ঘাঁটিয়া দেখিলেই আপাততঃ চলিবে। পরে আরও “ইন্টেন্‌সিহব্” “রিসার্চ্চ” বা গভীরতর খোজ চালানো যাইতে পারে “।

কিন্তু, ভারতের ক্ষেত্রে বিনয় কুমার সরকারের মত আমাদের অবাক করলেও, তিনি প্রাচীন শাস্ত্র ঘেঁটে তথ্যপ্রমাণ এনেছেন এবং বিশ্বমঞ্চের শিক্ষাজগতে তুলেও ধরেছেন —– “বিজ্ঞানেশ্বর এবং জীমূতবাহনের স্ত্রী-ধন বিষয়ক পাতি দেখিয়া ইংরেজ- পণ্ডিত মেইন যারপরনাই বিস্মিত হইয়াছিলেন ৷ তাঁহার মতে, হিন্দুরাষ্ট্র নারীজাতিকে ধনদৌলত সম্বন্ধে নবীনতম পাশ্চাত্য রাষ্ট্র সমূহ অপেক্ষা অনেক বেশী একৃতিয়ার দিয়াছে। পুরাণো ইয়োরোপীয় আইনে স্ত্রীধন- বিষয়ক বিধান স্ত্রীজাতির উপর সুবিচার করে নাই। মেইন-প্রণীত “প্রতিষ্ঠান-বিষয়ক প্রাচীন ইতিহাস” গ্রন্থে এবং গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় – প্রণীত গ্রন্থে এই মত প্রচারিত হইয়াছে” ৷

‘ভারতত্ত্ববিদ’ বা ‘Indologist’ নামে খ্যাত ইউরোপীয়ানদের গবেষণা ও জ্ঞান কে পরাধীন ভারতের এই চিন্তাবিদ কটাক্ষ করতেও ছাড়েন নি — “পশ্চিমা পণ্ডিতেরা এই কথাটা মনে রাখিতে অভ্যস্ত নন। তাঁহাঙ্গ প্রাচীন ভারতীর জ্ঞান বিজ্ঞানকে বর্তমান জগতের আসরে বসাইয়া মনের সুখে ভারত-মাতাকে বে-ইজ্জৎ করিতে ভালবাসেন। গ্রীক রোমাণ এবং “ক্যাথলিক-খৃষ্টিয়ান” ইয়োরোপের অজ্ঞান, কুসংস্কার, “তুর্কমুক্ত,” “হাঁচি,” “টিকটিকি,” “ভুতুড়ে কাণ্ড” এবং লাখ লাখ অন্ত্যান্ত বুজরুক ইহারা বেমালুম ভুলিয়া যান। আর ভারতসন্তানেরা প্রাচীন এবং মধ্য যুগের ইয়োরোপীয়ান সভ্যতা-অসভ্যতা এবং সু-কু সম্বন্ধে প্রায় একৃদম কিছুই জানেন না। কাজেই পশ্চিমাদের সঙ্গে তর্ক করিতে অপারগ হইয়া ভারত সম্বন্ধে লজ্জায় অধোবদন হইয়া থাকা এতকাল আমাদের দস্তুর রহিয়াছে।”(হিন্দু রাষ্ট্রের গড়ন)

ফরাসী, জার্মান ও ইতালিয়ান পত্রিকায় তাঁর বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।১৮৮৭ সালে তৎকালীন যুক্তবঙ্গের মালদার মকদমপুরে জন্মগ্ৰহণ করেন , ‘মালদা জিলা স্কুলে’র ছাত্র।
যৌবনের প্রারম্ভে বিনয়কুমার ‘ডন সোসাইটির জনক সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের দ্বারা স্বদেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলেও তাঁর জীবনের ওপর বিবেকানন্দের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। বিবেকানন্দকে বাদ দিয়ে বিনয় সরকারের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব কখনও পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা যাবে না।’Cyclonic Hindu Monk’ এর ভেতর তিনি যে নতুন মন্ত্রের সন্ধান পান তাকে পাথেয় করেই তিনি বিশ্বকে চিনিয়ে ভারতীয় তথা হিন্দু সভ্যতার গড়নকে।বিবেকানন্দের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন দিগ্বিজয়ের দর্শন, সতীশচন্দ্রের নিকট থেকে তিনি পান স্বদেশসেবা ও নিঃস্বার্থ কর্মযোগের দীক্ষা। আচার্য সতীশচন্দ্রের প্রভাব এতই গভীর ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বড় সরকারী চাকরির সকল সুযোগ তিনি স্বেচ্ছায় বর্জন করে সাধারণ সেবক হিসাবে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ পরিচালিত ‘বেঙ্গল ন্যাশন্যাল কলেজ’ অবৈতনিক শিক্ষকরূপে যোগদান করেন।
আজ যখন ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ শব্দটিকে ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যা দেওয়া হয় তখন আমাদের বুঝতে হবে ‘ভারতীয়’ আর ‘হিন্দুত্ব’ সেই সময় ভারতীয় চিন্তাবিদ এমনকি বহির্বিশ্বের কাছেও সমার্থক ছিল। ভারতীয় চিন্তা যদি বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগী হয় , সেখানে ‘হিন্দু রাষ্ট্রের গড়ন’ হয় ভারতের উত্তর। সেই উত্তর দিয়েছিলেন বিনয় কুমার সরকার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯০৯ সাল নাগাদ ‘হিন্দু রসায়নীবিদ্যা’ প্রকাশ করেছিলেন আর বিনয় কুমার সরকার র ‘Hindu achievements in exact science a study in the history of scientific development’ এ সামনে আনলেন বিজ্ঞানের সবক্ষেত্রে হিন্দুদের অবদান কে।
রাষ্ট্রনীতি, বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা কোনো ক্ষেত্রেই যে হিন্দু পিছিয়ে ছিল না তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরাই বিনয় কুমার সরকারের জীবন সাধনা। এটাও উল্লেখযোগ্য যে তিনি কোথাও কোথাও সমালোচকের ভূমিকাও নিয়েছেন ভারতীয় সভ্যতাকে স্বাধীন ও সমৃদ্ধ করে তৎকালীন ইউরোপের সঙ্গে পাল্লা দিতে।

১৯৪৯ সালে বিনয় কুমার সরকার আমেরিকার ২৫ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় সমাজের, রাষ্ট্রের কথা রাখেন।
পরাধীনতা থেকে মুক্ত হতে গেলে শুধু ক্ষমতা দখল যথেষ্ট নয়, চাই চিন্তার স্তরে ‘স্বাধীনতা’ আর তারপর রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘স্বতন্ত্রতা’ । ভারত , ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পেলেও স্বতন্ত্রতা পায় নি কারণ আমরা এখনো ইউরোপীয় দৃষ্টি দিয়ে ভারতকে দেখতে অভ্যস্ত। পরাধীন ভারতবর্ষে যারা ভারত কে ঔপনিবেশিক মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন তার মধ্যে বিনয় কুমার সরকার অন্যতম কিন্তু তাঁর আজো মিটেছে কি ?
“এশিয়ার সঙ্গে তুলনায় গ্রীস, রোম এবং মধ্যযুগের ইয়োরোপকে পশ্চিমা পণ্ডিতেরা যে চোখে দেখিয়া থাকেন আমরাও বিনা বাক্য ব্যয়ে গোলামের মতন ঠিক সেই চোখেই দেখিতে শিখিয়াছি। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর পূর্ব্বেকার ইয়োরোপকে রক্ত- মাংসের মানুষ ভাবে দেখিবার এবং বুঝিবার চেষ্টা আমরা করি নাই ৷ তাহার জন্য অনুসন্ধান “রিসার্চ” গবেষণা আবশ্যক। সেদিকে ভারতবাসীর খেয়াল কৈ ? ( হিন্দু রাষ্ট্রের গড়ন — বিনয় কুমার সরকার)

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.