ভ্যাসিলি গ্ৰসমান (Vasily Grossman): একজন সোভিয়েত সাংবাদিকের বিবেক-বিদ্রোহ

কমিউনিস্টরা বাক-স্বাধীনতার কথা বলে গণতান্ত্রিক দেশে অগণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন খাড়া করে ওস্তাদ। তারা নিজেরা বাক-স্বাধীনতার কথা বললেও তারা যে মতাদর্শে বিশ্বাসী তাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো জায়গাই নেই।
সোভিয়েত রাশিয়ার ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে মার্ক্সবাদ কে প্রয়োগ করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি করা যায় না, বরং মানবতাবিরোধী একটা ব্যবস্থা খাড়া হয় আর তার নেতৃত্বে থাকে একজন স্বৈরাচারী। বিভিন্ন দেশে এই কথাটিই প্রমাণিত হয়েছে বারবার।
সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষেত্রে সেই অত্যাচারী শাসকের নাম — যোসেফ স্তালিন।
সংবাদমাধ্যম কে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার নৃশংসতার কথা বহির্বিশ্ব যাতে না জানতে পারে তার জন্য সাংবাদিকদের কন্ঠরোধ করেছিল স্তালিন।
এইরকম শত শত সাংবাদিকদের জীবন মার্ক্সবাদের অগণতান্ত্রিক, নৃশংস রূপ সামনে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু সারা বিশ্বে কমিউনিস্টদের ইকোসিস্টেম এইসব সাংবাদিকদের আত্মকাহিনী কে প্রচারের আলোয় আনতে দেয় নি।
এইরকমই একজন সাংবাদিক ভ্যাসিলি গ্ৰসম্যান। গ্ৰসম্যান নিজের চোখে হলোডোমোরের ভয়াবহতা দেখেছিলেন , স্তালিনের মৃত্যুর পরেও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে সাংবাদিকদের কন্ঠরোধ করার প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। কিন্তু সেই লৌহ যবনিকা সত্যের আলোকে রুখতে পারে নি।
ভ্যাসিলি সেমিওনোভিচ গ্ৰসম্যান ছিলেন একাধারে একজন রসায়নবিদ, সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক, যিনি সোভিয়েত শাসনের অধীনে দেশপ্রেমিক হিসেবে জীবন শুরু করলেও, তাঁর সাহিত্যজীবন রূপ নেয় সোভিয়েত একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে নীরব কিন্তু গভীর এক বিদ্রোহে।

যুদ্ধজীবনের সূচনা

গ্রসম্যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় Krasnaya Zvezda (লাল তারা) পত্রিকার War Reporter ছিলেন। তিনি স্ট্যালিনগ্রাদ, কিয়েভ, ত্রেলেবুর্গসহ বহু ফ্রন্টলাইন থেকে প্রতিবেদন পাঠান। তাঁর লেখায় ছিল সোভিয়েত সৈনিকদের সাহস, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও নাৎসি নৃশংসতার সৎ বিবরণ। এই সময় তাঁকে রাষ্ট্রপ্রেমিক লেখক হিসেবে দেখা হতো।

তবে এই অভিজ্ঞতা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়। তিনি নাৎসি বর্বরতার বিরুদ্ধে যতটা ক্ষুব্ধ ছিলেন, তেমনি ধীরে ধীরে অনুধাবন করেন যে সোভিয়েত রাষ্ট্রও নিজ জনগণের ওপর একটি আলাদা ধরনের সন্ত্রাস চাপিয়ে দিচ্ছে।

“Life and Fate”: এক নিষিদ্ধ উপন্যাস

গ্রসম্যানের কালজয়ী উপন্যাস Life and Fate (জীবন ও নিয়তি), টলস্টয়ের War and Peace-এর আধুনিক উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচিত। এতে তিনি নাৎসিবাদ ও স্তালিনবাদের মধ্যে একটি সাদৃশ্য তুলে ধরেন। উপন্যাসে দেখানো হয়েছে কিভাবে রাষ্ট্র এক ব্যক্তির আত্মাকে পিষে ফেলে, এবং কিভাবে স্বাধীনতা, বিশ্বাস ও বিবেক টিকে থাকার চেষ্টা করে এক অনমনীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে।

১৯৬০ সালে তিনি এই উপন্যাসটি প্রকাশের জন্য জমা দিলে কেজেবি এসে তাঁর নোটবুক, টাইপরাইটার রিবন, এমনকি কার্বন কপিও জব্দ করে নিয়ে যায়। একজন অফিসার তাকে সাফ জানিয়ে দেয়, “এই বইটি আর এক হাজার বছরেও প্রকাশ পাবে না।”

গ্রসমানের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মৌল প্রতিবাদ

যদিও তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না, গ্রসম্যান বিশ্বাস করতেন, সমাজতন্ত্র মানবিক হতে পারে। কিন্তু স্তালিনবাদ তার স্বপ্নকে চূর্ণ করে দেয়। Life and Fate-এ তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তব্য:

“If we allow the state to have supreme power over human lives, we commit the gravest of all crimes — the annihilation of the human soul.”

এই সাহসী অবস্থান তাকে অপ্রকাশিত, অব্যক্ত এবং শেষ জীবনযাত্রায় একা করে দেয়। তাঁর আরেকটি কাজ, Everything Flows (সবকিছু প্রবাহিত হয়), আরও সরাসরি স্টালিন-যুগের দমননীতি, হোলডোমোর দুর্ভিক্ষ, এবং সোভিয়েত গুলাগ ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে।

মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন

১৯৬৪ সালে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জীবদ্দশায় তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলি সোভিয়েত সেন্সরের কারণে প্রকাশিত হয়নি। তবে তাঁর বন্ধুরা—বিশেষত লেখক স্যামিজদাত নেটওয়ার্কের সহায়তায়( কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে গোপনভাবে নিষিদ্ধ সাহিত্য প্রকাশিত করার আন্দোলন) —Life and Fate গোপনে পশ্চিমে পাচার করেন এবং ১৯৮০-তে প্রকাশিত হয়। এতে পশ্চিমা বিশ্ব এক নতুন গ্রসম্যানকে আবিষ্কার করে—যিনি ছিলেন লিও টলস্টয়ের মতো দার্শনিক, আবার সোলোঝেনিৎসিনের মতো প্রতিবাদী।
ভ্যাসিলি গ্ৰসম্যান ছিলেন একজন “অসহায় দেশপ্রেমিক”—যিনি প্রথমে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, পরে নিজের দেশের দমননীতির বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। তাঁর সাহসিকতা ছিল শান্ত, কিন্তু কমিউনিজমের মিথ্যাচারের প্রতি ধ্বংসাত্মক এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন—যা স্তালিনের নীরবতা ও ভয়ের সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে।

তিনি বলেছিলেন:
“তুমি স্বাধীন হতে পারো, এমনকি একটি গুলাগ শিবিরে বন্দী থেকেও, যদি তোমার বিবেক এবং চিন্তা স্বাধীন হয়।”
এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে সোভিয়েত সাহিত্যে এক অনন্য ও অমর চরিত্রে পরিণত করেছে।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.