রাজ্যে উলটপুরাণ, পদ্মের অপর্ণা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী পঞ্চায়েতে, ‘ইতিহাস’ সুকান্তের নিজের জেলায়

ইতিহাস তৈরি করে ফেললেন গৃহবধূ অপর্ণা বর্মণ। রাজ্যে তিনিই প্রথম বিজেপি প্রার্থী যিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেলেন কোনও নির্বাচনে। সাধারণত, এমন জয়ের অভিযোগ ওঠে শাসকদলের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এমন ভূরি ভূরি অভিযোগ ছিল। এ বারে জেলা পরিষদে না হলেও গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতিতে এমন অনেক আসন রয়েছে, যেখানে কোনও বিরোধী দলের প্রার্থী নেই। কিন্তু বিজেপির ক্ষেত্রে অপর্ণাই অনন্যা। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রার্থী নেই।

সেটা আবার হয়েছে রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের জেলায়। তাঁরই লোকসভা এলাকা বালুরঘাটের অন্তর্গত গঙ্গারামপুর বিধানসভার উদয় গ্রাম পঞ্চায়েতের নাকাইর গ্রামের প্রার্থী হয়েছেন অপর্ণা। বিজেপির দাবি, মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ওই আসনে তৃণমূল বা সিপিএম কোনও প্রার্থীই দিতে পারেনি। স্থানীয়রাও বলছেন, এই এলাকায় প্রায় সব পরিবারই বিজেপি করেন। কেউ কেউ অন্য দল করলেও তাঁদের বাড়ির কোনও মহিলা প্রার্থী হতে চাননি।

এত কিছু কিন্তু জানেন না অপর্ণা। তিনি যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে চলেছেন, তা মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়েও জানতেন না। প্রথম বার নির্বাচনে প্রার্থী হয়েই এমন জয়ে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি তিনি। আনন্দবাজার অনলাইনের ফোন পেয়ে জানালেন, তিনি রান্নায় ব্যস্ত রয়েছেন। পরে ফোন করতে হবে। সংসার অবশ্য খুব বড় নয়। স্বামী আর দুই ছেলেকে নিয়ে চার জনের রান্না। সে সব সেরে নিজেই ফোন করলেন। বললেন, ‘‘আমার স্বামী বরাবরই রাজনীতি করেন। ওঁর কথায় এবং নেতাদের কথায় প্রার্থী হয়েছি। তবে আমি জানতাম না ভোটের আগেই জিতে যাব। গ্রামের মানুষও খুব খুশি আমার জয়ের খবর শুনে। পঞ্চায়েত যদি আমাদের দখলে চলে আসে, আমি খুব কাজ করব।’’

18aparna Aparna Barman is the only BJP candidate won uncontested in Panchayat Election 2023

স্বামী সাগর বর্মণ আগে লরি চালাতেন। কিন্তু এখন সব্জির গাড়ি চালান। তাতে যে সংসারের সবটুকু প্রয়োজন মিটে যায়, তা নয়। তাঁকেও বিড়ি বেঁধে কিছু রোজগার করতে হয়। এর পরে সংসারের সব কাজ, দশম এবং পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া দুই ছেলের সব দায়দায়িত্ব পালন করে রাজনীতি করার সময় পাবেন? অপর্ণা হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘মেয়েরা সব পারে। কথায় বলে, যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে।’’ অপর্ণা চুল বাঁধেন কি না জানা নেই, তবে তিনি নিয়মিত বিড়ি বাঁধেন।

অপর্ণা না জানলেও তাঁর স্বামী সাগর জানেন যে, স্ত্রী নজির তৈরি করে ফেলেছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমাদের এখানে সবাই বিজেপি। বিরোধী বলে কিছু নেই। গত বারও আমরাই সব ভোট পেয়েছিলাম। তবে গণনায় গোলমাল হয়েছিল। এ বার অন্য দলের কেউ প্রার্থী খুঁজেই পায়নি। গ্রামের কেউ রাজি হননি।’’

রাজ্য সভাপতির শহর বালুরঘাট থেকে খুব দূরে নয় অপর্ণাদের গ্রাম। সাগর বললেন, ‘‘বালুরঘাটের কাছেই ফুলবাড়ি হাইস্কুল। একটু এগোলেই হনুমান মন্দির। তার পাশের গলিতে ঢুকলেই আমাদের বাড়ি।’’ বাড়ি মানে টিনের দেওয়াল, টিনের চাল। আবাস যোজনায় বাড়ি পাননি বিজেপির পঞ্চায়েত ভোটের প্রার্থী। উজালা প্রকল্পে রান্নার গ্যাসের সংযোগ পেলেও কাঠকুটো জ্বালিয়েই মূলত রান্না হয়।

গ্রামে যে খুব সমস্যা রয়েছে তা নয়। রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে। তবে এখনও জলের সমস্যা রয়ে গিয়েছে বলে জানালেন অপর্ণা। বললেন, ‘‘আমি বেশি খুশি হব এই জেলায় এ বার গোটা রাজ্যে যদি আমাদের দল ভাল ফল করে। নিজের জন্য প্রচারে যেতে হবে না, তবে আশপাশের এলাকায় যাব। হাত জোড় করে মানুষকে বলব, বিজেপি যেন বেশি করে পঞ্চায়েতে জিততে পারে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমি চাই, কোনও মানুষের ভাত থেকে জল, রাস্তা থেকে বিদ্যুৎ— কিছু নিয়েই যেন অভাব না থাকে।’’

নাকাইর গ্রামে মূলত তফসিলি সম্প্রদায় ভুক্ত হিন্দুদের বাস। কেউ কেউ ব্যবসা করলেও বাসিন্দারা মূলত কৃষক। অন্য অনেক কিছু হলেও নাকাইরের জমিতে বেশি হয় লঙ্কা। সাগর জানিয়েছেন, গন্ধে এবং ঝাঁজে নাম রয়েছে নাকাইরের লঙ্কার। তবে ওই গ্রামে রাজনীতির ঝাঁজ তেমন নেই। শান্ত গ্রামে ভোটের আগেই জয়ী অপর্ণাকে নিয়ে বিজয়োল্লাস শনিবারই পালিত হয়েছে। মিষ্টিমুখও করেছেন বিজেপি কর্মীরা। আসলে অপর্ণা তো একা নন, বিজেপির ইতিহাসেই জায়গা করে নিয়েছে নাকাইর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.