সুড়ঙ্গের অন্ধকার গলিপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে কন্যাহারা মায়েদের আর্তনাদ। গলিপথ ঘুরে ঘুরে তা ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যাচ্ছে। অন্ধকার থেকে আলোর পথে যেতে পারছে না কেউ। কারণ তারা নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসা কুসংস্কার অতিক্রম করে গ্রামের কোনও মহিলাই আর সেই আলোর পথে যেতে পারে না। ‘ছোরী’র প্রথম পর্বের গল্প যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকেই আবার দ্বিতীয় পর্বের চিত্রনাট্যের উল বোনা শুরু হয়েছে। ভৌতিক আবহের সঙ্গে সেই কাহিনিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে লোককথা, পুরুষতন্ত্র এবং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে নারীদের প্রতি অত্যাচার। তবে রান্নার সব উপকরণ হাজির হলেও ‘ছোরী ২’ দর্শকের জন্য উপাদেয় হতে পারল কি?
২০২১ সালে ওটিটির পর্দায় মুক্তি পেয়েছিল ‘ছোরী’। মরাঠি ছবি ‘লপাছপি’র অনুকরণ হলেও ‘ছোরী’ সমান ভাবে ভয় ধরিয়েছিল দর্শকমনে। মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করে বলি নায়িকা নুসরত ভারুচাও বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। সচরাচর প্রেম-হাস্যরসে ভরা চরিত্রে অভিনয় করেই নিজের পরিচিতি তৈরি করেছিলেন নুসরত। ‘ছোরী’তে অভিনয় করে নিজের তৈরি চেনা ছক নিজেই ভেঙে দিয়েছিলেন নুসরত। তার পর প্রায় সাড়ে তিন বছরের বিরতি। ‘ছোরী’র কাহিনি যে আবার নতুন করে এগোতে পারে তা বোধ হয় দর্শকও বুঝতে পারেননি। ‘ছোরী’র অন্তিম দৃশ্য সকল প্রশ্নচিহ্নের উত্তর দিয়েই দাঁড়ি টেনেছিল। কিন্তু পরিচালক বিশাল ফুরিয়া সেই শেষ থেকেই আবার নতুন শুরু করলেন। গল্পে জুড়লেন নতুন চরিত্র। আনলেন নতুন মোড়। ‘ছোরী’তে দেখা গিয়েছিল, কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়াই এক গর্ভবতী নারীর লড়াই।

‘ছোরী’র দ্বিতীয় গল্প শুরু হয় তার ঠিক সাত বছর পর। শহর থেকে বহু বহু দূরে চারদিকে আখের খেত। সেই খেতের ‘ভুল ভুলাইয়া’র মাঝে একটি কুয়ো। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে কুয়োর ভিতর। কুয়োর ভিতর অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় আদিমানবের গুহায়। সেই আদিমানবের আশীর্বাদেই ফসল হয়। সেই আদিমানবের নির্দেশে গ্রামে কোনও কন্যাসন্তান জন্মালেই তার মৃত্যু অনিবার্য। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সেই কুসংস্কার (গ্রামের প্রথা) ভেঙেই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শহরে পালিয়ে গিয়েছিল সাক্ষী (নুসরতের চরিত্রনাম)। তার পর সাত বছর কেটে গিয়েছে। কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে সাক্ষী। সূর্যের আলো পড়লেই সাক্ষীর কন্যার গায়ে চাকা চাকা দাগ হয়ে যায়। তাই জন্মানোর সাত বছর পরেও প্রায় গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাত সাক্ষীর মেয়ে। অতীতের অন্ধকার পাছে সাক্ষীর মেয়ের জীবন ঘিরে ফেলে সেই ভয়ে গুটিয়ে থাকত মায়ের মন। সেই ভয় এক দিন সত্যিও হল। অপহরণ করা হল সাক্ষীর মেয়েকে।
যে অতীত থেকে সাক্ষী পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, সেই অন্ধকারই গ্রাস করল মা-মেয়ের হাসিখুশি জীবন। ‘ছোরী ২’-এর কাহিনি ঠিক সেখান থেকেই নতুন মোড়ে বাঁক নেয়। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য আবার মরিয়া হয়ে ওঠে সাক্ষী। সওয়া দু’ঘণ্টা ধরে ভয়ের ঘরানার এই ছবিতে ভয়ের আবহ নির্মাণের চেষ্টা করা হলেও তাতে কোনও নতুনত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরনো এবং সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে যে ভাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা বড়ই হাস্যকর হয়ে ওঠে। বরং এই ছবিতে আলাদা ভাবে নজর কাড়ে হার্দিকা শর্মার অভিনয়। সহজ-সরল ভাবে শিশুচরিত্রে অভিনয় করে গিয়েছে সে। অভিনয়ে বিন্দুমাত্র জড়তা ছিল না একরত্তিটির। তার পরেই বলতে হয় সোহা আলি খানের কথা। বহু বছরের বিরতির পর অভিনয়ে ফিরলেন তিনি। এমন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করাও তাঁর জন্য নিঃসন্দেহে ‘চ্যালেঞ্জিং’ ছিল। স্নিগ্ধতা মাখা মুখে ভয় ধরানো অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার শতচেষ্টা করেছেন তিনি। দাসী মায়ের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে কোনও অংশে কার্পণ্য করেননি তিনি। নুসরতের অভিনয় আগের চেয়ে পরিণত হলেও তাঁকে ছাপিয়ে গিয়েছেন সোহা।

কাহিনির প্রায় শেষে পৌঁছে রহস্যের জট একে একে খুলতে শুরু করে। শোষিত হতে হতে নারীদের পিঠও দেওয়ালে ঠেকে যায়। তারাও গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করতে পারে— ছবির শেষে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা যেন মন ছুঁল না। ‘ছোরী’র সেই টানটান মুহূর্তগুলি দ্বিতীয় পর্বে অধরাই থেকে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ‘ছোরী ২’ দেখলে দু’-তিনটি দৃশ্যে দর্শক চমকে উঠবেন। তবে ভয় পাবেন না তা নিশ্চিত। ক্যামেরার কাজ কয়েকটি দৃশ্যে সত্যিই প্রশংসার্হ। গল্পের বুননও মজবুত। তবে প্রথম ‘ছোরী’র কাহিনির সঙ্গে তুলনা করতে বসলে মনে অনেক প্রশ্নই হাজির হয়। ‘ছোরী ২’ সেই প্রশ্নগুলির উত্তর দেয় না। বরং অন্তিম দৃশ্যে আরও জিজ্ঞাসাচিহ্নের জন্ম দিয়ে যায়। ইঙ্গিত দিয়ে যায় ‘ছোরী ৩’-এর অপেক্ষার।