সাত দিন আগে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক ধর্ষিত এবং খুন হন। সাত দিন ধরে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি শহর কলকাতা। ১৪ অগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে গোটা দেশ তার প্রতিবাদ জানাতে পথে নেমেছিল। ওই একই দিন, সকলের অজান্তে ঘটে গিয়েছে আরও এক নিন্দনীয় ঘটনা। আনন্দবাজার অনলাইনকে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিনেত্রী জানিয়েছেন, কাস্টিং কো-অর্ডিনেটরের ভুয়ো পরিচয় দিয়ে তাঁকে হেনস্থা করেছেন সুমন সরকার নামে এক ব্যক্তি। তাঁর দাবি, ইনস্টাগ্রামে অভিযুক্তের লক্ষাধিক অনুসরণকারী। আইএমডিবি-তে তাঁর নিজস্ব প্রোফাইল রয়েছে। একই সঙ্গে কথাবার্তায় দারুণ চোস্ত। ফলে, কথা বলে তিনি বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি, ওই ব্যক্তি নকল।
সহজে কাজ হাসিলের জন্য অভিনেত্রীকে লোভনীয় কাজের টোপ দিয়েছিলেন অভিযুক্ত। যেমন, জাতীয় স্তরের প্রথম সারির এক ওয়েব প্ল্যাটফর্মে হিন্দি ভৌতিক সিরিজ়ে কাজের সুযোগ। দু’টি সিজ়ন ধরে চলবে সিরিজ়টি, বলা হয়েছিল তাঁকে। একটি মেয়ে অতৃপ্ত আত্মার হাতে ধর্ষিতা হবে, গল্প এমনই। পরিচালনায় অনুভব সিংহ, ধর্ষিতার বাবা পঙ্কজ ত্রিপাঠী, দিদি ম্রুণাল ঠাকুর। এই সিরিজ়ে কাজ করলে অভিনেত্রী পাবেন এক কোটি ৪০ লক্ষ টাকা! শুধু নিখুঁত আবহ সাজিয়েই ক্ষান্ত হননি ভুয়ো ‘কাস্টিং কো-অর্ডিনেটর’। অভিনেত্রীর পরীক্ষা নিয়েই জানিয়ে দেন, তিনি পাশ করে গিয়েছেন। নভেম্বরে পাকা কথা হবে। তার আগে অভিনেত্রীর পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর নেবে সংস্থা। অভিনেত্রীর আক্ষেপ, “এত কিছু শোনার পর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। আগুপিছু চিন্তা না করে রাজি হয়ে যাই। ভাল করে খোঁজ নিইনি। এমনকি, কাউকে না সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষা দিতে চলে গিয়েছিলাম। এও মনে ছিল না, কোনও জাতীয় স্তরের ওয়েব প্ল্যাটফর্ম মৌখিক ভাবে কোনও অভিনেত্রীকে পাকা কথা দেয় না।”
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিনেত্রী বললেন, “ইনস্টাগ্রামে ওঁর প্রোফাইল থেকে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর পেয়েছিলাম। যোগাযোগ করার পর বলেন, তিনি কলকাতায় এলে ডেকে নেবেন। এর পর ১৪ অগস্ট পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ডাকেন।” পূর্ব পরিচিত না হওয়ায় নির্দিষ্ট দিনে সুমন তাঁকে প্রথমে রাজারহাট শপিং মলে কফির দোকানে আসতে বলেন। আলাপের পর অভিনেত্রীকে শপিং মল থেকে পনেরো মিনিট দূরে একটি ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। জানান, আলাদা ভাবে ডেকে প্রত্যেকের পরীক্ষা নিচ্ছেন। অথচ, সেখানে সুমন ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি নেই! কোনও চিত্রগ্রাহকও ছিলেন না। সেখানেই অভিনেত্রীকে খোলামেলা পোশাক পরিয়ে নানা ভাবে ছবি তোলেন সুমন। আচমকা তাঁর গোপনাঙ্গ স্পর্শ করেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে প্রতিবাদ জানিয়ে অভিনেত্রী দ্রুত ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি বলেছেন, “যাতে সন্দেহ না করি তাই সুমন নিজে টাকা দিয়ে ক্যাব বুক করে দিয়েছিলেন। অডিশনের ঢঙে প্রত্যেকটা কথা বলেছেন। গায়ে হাত দেওয়ার পরেও জানিয়েছেন, এটাও পরীক্ষার একটি অঙ্গ। সব ক্ষেত্রেই এটা হয়।”
কলকাতার এই অভিনেত্রীই কি ওই ভুয়ো ‘কাস্টিং কো-অর্ডিনেটরের’ প্রথম শিকার? অভিনেত্রী জানিয়েছেন, বছর দুয়েক আগে মুম্বইয়ের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে প্রায় একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তিনি। আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল তাঁর সঙ্গেও। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক মুম্বইয়ের সেই অভিনেত্রী বলেন, “সুমন সাধারণত ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল দেখে তুলনায় নতুন বা আনকোরাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার পর ভুয়ো কাজের টোপ দেখিয়ে শরীর স্পর্শ করেন, ছবি ও ভিডিয়ো তোলেন। আমাকে ‘অভয়’ছবির নাম করে অডিশনে ডেকেছিলেন। পরে জানতে পারি, ওই ছবির শুটিং অনেক দিন আগেই শেষ। আমার এক পরিচিত সে দিন সঙ্গে ছিলেন। সম্ভবত তাই সুমন কুপ্রস্তাব দিয়ে উঠতে পারেননি। পাশাপাশি, ফাঁকা ফ্ল্যাটে পরীক্ষা দিতেও রাজি হইনি। ফলে, সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে যাই।”
তাঁর বিরুদ্ধে দুই অভিনেত্রী হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন জেনেও, আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে নিজের ভুয়ো পরিচয়-ই (অভিযোগকারীদের দাবি অনুযায়ী ) আরও এক বার জোর গলায় জানিয়েছেন সুমন। তিনি গত আট বছর ধরে মুম্বইয়ের বাসিন্দা। কলকাতায় খুব কমই আসেন। এটি তাঁর ব্যক্তিগত ‘কাস্টিং কো-অর্ডিনেটর’ সংস্থা। অভিনেত্রীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মেধা অনুযায়ী কাজ দেন। সুমনের কথায়, “আমি কাউকে জোর করিনি। কলকাতার অভিনেত্রী স্বেচ্ছায় পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন। যা যা বলেছি তাই-ই করতে রাজি হয়েছিলেন। ওঁর ফেরার ব্যবস্থাও করে দিই। ঠিকঠাক ফিরেছেন কিনা, খবর নিই।” তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “এতই যদি আমার থেকে আপত্তিজনক ব্যবহার পেয়ে থাকেন, তা হলে আমাকে মুঠোফোন বার্তায় হাসিমুখের চিহ্ন দিয়ে কেন জানিয়েছিলেন, তিনি ঠিকমতো ফিরেছেন?” অভিযুক্তের দাবি, পুরোটাই পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো হচ্ছে। তিনি নির্দোষ।
কলকাতার অভিনেত্রী কি কোনও আইনি পদক্ষেপ করবেন? তাঁর বক্তব্য, “আমি সুমনের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগই রাখব না। ওঁর দেওয়া কাজও করব না। যত বার ১৪ অগস্টের ঘটনা মনে পড়ছে তত বার শিউরে উঠছি। আরজি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের মতো অবস্থা আমারও হতে পারত। কোনও ক্রমে বেঁচে গিয়েছি। তাই চাইছি, এই ঘটনা সংবাদমাধ্যমের মারফত ছড়িয়ে পড়ুক। যাতে আর কোনও অভিনেত্রীর আমার মতো অভিজ্ঞতা না হয়।”