তাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলন কে যুক্ত করেছিলেন ভারতের ধর্মের সঙ্গে, ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে, ভারতের উৎসবের সঙ্গে, ভারতের শাস্ত্রের সঙ্গে।
প্রথম যিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন আর সফল হয়েছিলেন তাঁকেই ভারত ‘লোকমান্য’ বলে জানে।
সেই সময় তিলক-অরবিন্দ সুরাট কংগ্রেসের অধিবেশনে ইংরেজ-প্রতাষ্ঠিত কংগ্রেস কে ভারতীয়করণের চেষ্টা করছেন।
বাংলা তে অরবিন্দ বিপ্লবীদের তৈরি করছেন আর তিলক ‘কেশরী’ পত্রিকায় তাঁর সমর্থন করছেন, যার পরিমাণ ৬ বছরের কারাবাস সুদূর মান্দালয়ে।
সেই সময় তিলক-অরবিন্দ জোট আলাদাভাবে বাঙালি বা মারাঠি না হয়ে ‘ভারতীয়’ হতে পেরেছিলেন ভারতের প্রাণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে — অরবিন্দ লিখেছিলেন ‘গীতার ভূমিকা ‘ আর কারাবাসের নির্জনতায় তিলক নিজের অসাধারণ স্মৃতিশক্তির প্রয়োগে লিখলেন ‘গীতা রহস্য’ ।
সেই গীতা রহস্যের বাংলা অনুবাদ করলেন কে ?
যার হাত ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখা শুরু করেছেন, গান গাওয়া শুরু করেছেন; সেই জ্যোতি দাদা। তিলকের গীতা রহস্যের অনুবাদ করতে পেরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ধন্য।
সেই অনুবাদের ভূমিকায় বিশ্বকবির ‘জ্যোতি দাদা’ লিখছেন —
“লোকমান্য মহাত্মা’ তিলক তাঁহার প্রণীত “গীতারহস্য” বঙ্গভাষায় অনুবাদ করিবার ভার আমার প্রতি অর্পণ করিয়া আমাকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন। তাঁহার অনুরোধক্রমে, বঙ্গবাসীর কল্যাণ-কামনায়, বঙ্গসাহিত্যের উন্নতিকল্পে,– অতীব দুরূহ ও শ্রমসাধ্য হইলেও- আমি এই গুরুভার স্বেচ্ছাপূর্ব্বক গ্রহণ করিয়াছিলাম।”
ভারতীয়ত্বের সেই সুরে বাঁধা হয়েছিল বলেই সারা ভারত জেগেছিল।
সেই সময় বাংলার নেতা অরবিন্দ ঘোষ তিলক সম্পর্কে বলছেন — “কংগ্রেস আন্দোলন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য মনোভাব, চরিত্র ও পদ্ধতির দ্বারা পরিচালিত ছিল। এটি ছিল কেবলমাত্র ইংরেজি-শিক্ষিত কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যার ভিত্তি ছিল ইংরেজ ইতিহাস ও ইউরোপীয় আদর্শের আলোকে দেশের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থের উপর — কিন্তু যার কোনো শিকড় ছিল না ভারতের অতীতে বা জাতির অভ্যন্তরীণ চেতনার মধ্যে। তিলকই ছিলেন প্রথম রাজনৈতিক নেতা যিনি এই কৃত্রিম, কিছুটা একাডেমিক ধাঁচের পদ্ধতির গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসেন, বর্তমান ও অতীতের মাঝে এক সেতুবন্ধন গড়ে তোলেন এবং জাতির রাজনৈতিক জীবনে ধারাবাহিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একটি নতুন ভাষা ও চেতনার সৃষ্টি করেন এবং এমন পদ্ধতি গ্রহণ করেন যা আন্দোলনকে ভারতীয় করে তোলে ও সাধারণ জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে।”
গণিত , সংস্কৃত আর আইন — অসাধারণ সমন্বয় !
বাল গঙ্গাধর তিলক ভারতবাসীর মানসিক দাসত্ব দূর করে ভারতের গৌরবময় ইতিহাস তাঁর শাস্ত্র থেকে বের করার চেষ্টা করেছিলেন।
ভারতীয় শাস্ত্রে বর্ণিত গ্ৰহ-নক্ষত্রের অবস্থান থেকে ঋগ্বেদের সময়কাল বের করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় শাস্ত্রের যে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের শুরু তিলক করেছিলেন তা আজ সাবালক হয়ে রামায়ণ – মহাভারত কে ভারতের ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে —- সেই দিক দিয়ে লোকমান্য তিলক ‘Archeo-astronomy’ নামক শাখার উদ্ভাবক।
তিলক বুঝেছিলেন ভারতাত্মা কে জাগাতে তাঁর নায়ক কে , তাঁর আরাধ্য কে সামনে আনতে হবে।
এখন মুম্বাইতে গণেশ চতুর্থীর উদ্দীপনা দেখলে তিলকের দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।
ভারতের স্বরাজের নায়ককে চিনিয়েছিলেন ‘লোকমান্য’ — যে ‘শিবাজী উৎসব’ তিনি শুরু করেছিলেন তাকে বাংলা পর্যন্ত এনেছিলেন আর সেই উৎসবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘শিবাজী উৎসব’ পাঠ করা হয়। তখন বাংলা আর মারাঠা এক হতে পেরেছিল কারণ ভারতীয়ত্বের পরিচয় নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।
তিলকের প্রভাব পড়েছিল কিশোর সাভারকারের মনে যার কর্মকাণ্ড পরিবর্তীকালে তাকে বীরের মর্যাদা দিয়েছিল।
আর এক কিশোর মগ্ন থাকতেন ‘কেশরী’ পত্রিকাতে। তিলকের বাড়িতে অতিথিও হয়েছিলেন একসময়। তিলকের চিনিয়ে দেওয়া ভারতীয়ত্বের কেন্দ্রকে চিনেই সেই কিশোর বাংলা-মারাঠী বিপ্লবীদের মধ্যে যোগসূত্র হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে পরিণত বয়সে তৈরি করেছিলেন ভারতের সর্ববৃহৎ সামাজিক – সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’ যার প্রভাব সম্পর্কে গবেষণার ভার পড়েছে বর্তমান প্রজন্মের উপর।
স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘লোকমান্য’ বাল গঙ্গাধর তিলকের প্রভাব সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন ইতিহাস বইগুলোতো আজও অধরা।
স্বাধীনতা আন্দোলন কে শুধুমাত্র সাল-তারিখ-ঘটনাক্রমের শুষ্ক তথ্য থেকে বের করে ‘ভারতবোধ’ জাগরণের উপযোগী করতে হলে ‘গণিত-সংস্কৃত-আইন’ এর মিশেল হয়েছিল যে মস্তিষ্কে তাঁর চিন্তন কে গভীরভাবে জানা জরুরী।
পিন্টু সান্যাল
